১৯৭১
আর ফিরে আসেননি শহীদুল্লা কায়সার
শহীদ সাংবাদিক, বামপন্থী রাজনীতিক, অমর কথাশিল্পী, আজীবন সংগ্রামী শহীদুল্লা কায়সার। ১৯২৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ফেনীর মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এ দেশের প্রধান শত্রু আলবদরের ঘাতকরা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর এই দেশপ্রেমিক, সাংস্কৃতিক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে চোখে কালোকাপড় বেঁধে বাসা থেকে ধরে নিয়ে রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে হত্যা করে। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি, শহীদুল্লা কায়সারের অনুজ শহীদ জহির রায়হানকে আলবদরের ঘাতকরা মিথ্যা কথা বলে ডেকে নিয়ে মিরপুরে হত্যা করে। একই পরিবারের দুজন সাংস্কৃতিক নক্ষত্রকে ঘাতকরা হত্যা করে বাংলাদেশের তথা গোটা বাঙালি সংস্কৃতির ঘর শূন্য করে দেয়, যা আর সহজে পূরণ হবে না।
শহীদুল্লা কায়সারের পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর বাবার নাম মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ্ এবং মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। 'সরকারি মডেল স্কুলে' এবং পরে 'মাদ্রাসা-ই-আলিয়া'র অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি ভর্তি হন 'প্রেসিডেন্সি কলেজে'। ১৯৪৬ সালে তিনি এখান থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন এবং অর্থনীতিতে এমএ পড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। একই সাথে তিনি 'রিপন কলেজে' (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজ) আইন বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করেন।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তাঁর বাবা ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ ভর্তি হন। তবে এ ডিগ্রি লাভ করার আগেই পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটান। শহীদুল্লা কায়সার ১৯৫৬ সালে কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিচালিত 'সাপ্তাহিক ইত্তেফাক' পত্রিকায় যোগদান করেন। এভাবেই তিনি যুক্ত হন সাংবাদিকতায়। পরে তিনি ১৯৫৮ সালে 'দৈনিক সংবাদ'-এর সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে এ পর্যায়ে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আটক রাখা হয়। মুক্তি লাভ করেই তিনি 'দৈনিক সংবাদ'-এর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেন। 'সাপ্তাহিক ইত্তেফাক' পত্রিকা থেকে সাংবাদিক জীবনের হাতেখড়ি হলেও তাঁর সাংবাদিক জীবনের সব কৃতিত্ব ও পরিচিতি 'দৈনিক সংবাদ'-কে ঘিরে আবর্তিত।
লেখালেখি ছিল তাঁর যুদ্ধ। সাধারণ মানুষ যাতে দুমুঠো ভাত খেয়ে, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান পেয়ে সুখে জীবনযাপন করতে পারে তার জন্য রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন শোষণহীন একটি সমাজ। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সারাজীবন রাজনৈতিক লড়াই করেছেন, জেল খেটেছেন, আন্ডার গ্রাউন্ডে দিনাতিপাত করেছেন। আর সেই স্বপ্ন পূরণের রাজনৈতিক বিবরণ লিখেছেন তার কল্যাণগুলোতে। শোষণহীন, সুখী–সুন্দর জীবনের ছবি এঁকেছেন তার অসামান্য দুটো উপন্যাস ‘সারেং বউ‘ ও ‘সংশপ্তক‘-এ।
শহীদুল্লা কায়সারের প্রধান উপন্যাস সারেং বউ (১৯৬২)-এ মানুষ ও তার অস্তিত্বের সংগ্রামের কথা বর্ণিত হয়েছে। তাঁর কাম্য ছিল সুস্থ ও পরিশীলিত জীবনভিত্তিক একটি উন্নত সমাজ। সংশপ্তক (১৯৬৫), কৃষ্ণচূড়া মেঘ, তিমির বলয়, দিগন্তে ফুলের আগুন, সমুদ্র ও তৃষ্ণা, চন্দ্রভানের কন্যা, কবে পোহাবে বিভাবরী (অসমাপ্ত) তাঁর অন্যান্য উপন্যাস। রাজবন্দীর রোজনামচা (১৯৬২) ও পেশোয়ার থেকে তাসখন্দ (১৯৬৬) তাঁর স্মৃতিকথা ও ভ্রমণবৃত্তান্ত। সারেং বৌয়ের কাহিনী অবলম্বনে উন্নত মানের একটি চলচ্চিত্র এবং সংশপ্তক অবলম্বনে একটি জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক নির্মিত হয়েছে।
শহীদুল্লা সাহিত্যকর্মের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬২) এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২) লাভ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার বাসভবন থেকে তিনি অপহৃত হন এবং আর ফিরে আসেননি।