মিরপুরের বুকে স্বপ্নরা আর না ভাঙ্গুক

ঠিক আজ থেকে ৯-১০ বছর আগের বাংলাদেশ দলটার দিকে একটু তাকাই। টাইগাররা তখন যেন শৈশব পার করে সদ্য পা রেখেছে কৈশোরে। যারা শুধু স্বপ্ন দেখতেই শিখেছিল। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল তারুণ্যের পথে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনাটা তাদের ছিল অচেনা।
স্বপ্নসারথি হবেন আর জানবেন না স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার ভয়, তা কী করে হয়? এমন এক শীতের দিনেই তরুণ সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালরা পেয়েছিলেন খুব কাছাকাছি গিয়েও শিরোপা হাতছাড়া হওয়ার তিক্ত স্বাদ।
২০০৯ সালে সেই ম্যাচটা ছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। শুরুতে সেদিন খুব একটা দাপট দেখাতে পারেনি ব্যাটসম্যানরা। রকিবুল হাসানের অর্ধশতকে স্কোরটা পেরিয়েছিল দেড়শ রানের কোটা। আরো একটা পরাজয় যেন দিব্যচোখেই দেখছিল সবাই। কিন্তু সকালের সূর্য কি সব সময় পুরো দিনের বর্ণনা দিতে পারে? হোম অব ক্রিকেটের বুকে লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার মিছিলে ব্যস্ত রেখেছিলেন মাশরাফি-নাজমুলরা।
১৫২ রানের লক্ষ্যমাত্রাটা সাঙ্গাকারাদের কাছে ঠেকছিল পাহাড়ের মতই। একা লড়াই চালিয়ে সাকিবের বলে ফিরলেন যখন সাঙ্গাকারা, জয় তখন হাতছানি দিচ্ছিল বাংলাদেশকে। ১৩৩ বলে ৫৯ রানের ইনিংসে ব্যাটিংটা যে সেদিন ‘ছেলেখেলা’ ছিল না, ভালোই বুঝিয়ে সাজঘরের রাস্তাটা ধরেছিলেন লঙ্কার কিংবদন্তি।
কিন্তু মঞ্চে হঠাৎই আগমন ঘটে বেরসিক মুরালিধরনের। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের জ্বালিয়েছেন বল হাতে। এদিন অবশ্য বলের ঘূর্ণিতে না, মুরালি টাইগারদের পুড়িয়েছিলেন ব্যাটের ঘূর্ণিতে। রুবেল হোসেন হয়তো বা কোনোদিনই ক্ষমা করবেন না লঙ্কান এই স্পিন জাদুকরকে। ২০ রানের এক ঝড়ে ম্যাচটা যে বাংলাদেশ আসলে হেরে গিয়েছিল তার ওভারেই। প্রথমবারের মতো বড় কোনো ট্রফি জয়ের কাছে গিয়ে বাংলাদেশের অর্জনটা ওই খালি হাত। তবে বুক ভরা সাহস অবশ্য পাওয়া গিয়েছিল।
শেরেবাংলা তখন একটু একটু করে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালের কষ্ট ভুলছিল। এর মাঝে বছর তিন পেরিয়ে গিয়ে আবারও এশিয়া কাপের ফাইনালের জন্য প্রস্তুত মিরপুরের মাঠ। ৩৬ মাস আগের কষ্ট তাহলে কি এবার ঘুচবে? ২০১২ সালের এশিয়া কাপ ফাইনালে কি পাকিস্তানকে পরাজিত করে বুনো উল্লাসে হোম অব ক্রিকেটের বুকে দাপিয়ে বেড়াবেন মুশফিকরা?
উত্তরটা ইতিবাচক করে তোলার দিতে অনেকখানিই এগিয়ে গিয়েছিলেন মুশফিক-সাকিবরা। টানটান উত্তেজনার ম্যাচে শেষ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ৯ রান। চতুর্থ বলে আইজাজ চিমা মাহমুদউল্লাহর রাস্তাটা আটকে দাঁড়িয়েছিলেন পাড়ার বখাটে ছেলের মতো। তিনটা রান এলো বটে, তবে রাজ্জাক চলে গেলেন স্ট্রাইকে। পরেরটা তো শেষ বলে দুই রানের আকুতির গল্প। শাহাদাতের পায়ের ফাঁক গলে বলটা যখন সরফরাজের হাতে, রিয়াদের অশ্রুতে গ্লাভসজোড়া ভিজে গেছে। সাকিব আর মুশফিকের কান্নায় গলা মিলিয়ে শেরেবাংলার বুক ফেটেও কথা বের হলো একটাই, ‘এত কাছে তবু দূরে?’
এশিয়া কাপ এরপর আবার বাংলাদেশে যখন ফিরেছে, মাঝে সময় গড়িয়ে গেছে চার বছর। আগেরবার ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হারতে হয়েছিল। এবার সেই পাকিস্তানকে পরাজিত করেই মিরপুরের ফাইনালে ভারতের সঙ্গী হলো বাংলাদেশ। তবে মিরপুরের মাঠটার অভিমানটা আর মিটল না। মুখ ভার করে মাশরাফির দলের সঙ্গে শেরেবাংলাও দেখল ধোনিদের হাতে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক।
ঘরের মাঠে শেষ কবছরে বাংলাদেশের অর্জনের শোকেসটায় উঠেছে ভূরি ভূরি ট্রফি। হারানো গেছে পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বড় শক্তিদের। একটা জায়গা কিন্তু খালি, ধুলো জমে গেছে বড় ট্রফির জায়গাটায়।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল দর্শন হয়েছে, দেখা হয়েছে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালও। সেই কাপ জেতার স্বপ্নটা হয়তো বা তেমন কেউ দেখেওনি। কিন্তু নিজেদের পুরো ক্রিকেট ইতিহাসে একবার মাত্র ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়ের রেকর্ডটা অন্তত এই বাংলাদেশের সঙ্গে যায় না। ২০০৭ সেই সিরিজের বাকি দুই দলের নামও ছিল না এত ভারী—কানাডা ও বারমুডা।
বছর নয় আগে শেষবার ঘরের মাটিতে বাংলাদেশের নেমেছিল ত্রিদেশীয় সিরিজের লড়াইয়ে। সেবারে ফাইনালে পেতে হয়েছিল স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। নয় বছর পর এসে টাইগার দাঁড়িয়ে সেই ফাইনালে, সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই। ঠিক আগের ম্যাচেই হতে হয়েছে ভয়ানকভাবে বিপর্যস্ত। অধিনায়ক মাশরাফি তো বলেছেনই, ফাইনালের আগে অমন পরাজয় অবশ্যই সতর্কবার্তা।
তাই সতর্ক থাকুক বাংলাদেশ দল, সতর্ক হয়েই বগলদাবা করুক কাপটা। প্রতাপের সঙ্গে সিরিজে প্রথম তিন জয় পাওয়া বাংলাদেশ আরেকবার ফিরুক শনিবারের ফাইনালে। মিরপুরের বুকে জমাট বাঁধা কষ্টে একটু প্রলেপ পড়ুক। সাকিব-তামিমদের ব্যর্থতায় যে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় শেরেবাংলার মাঠটাই!