অনেক প্রশ্নের জবাব দেওয়া একটি জয়

বল হাতে দৌঁড়ে আসছেন ইসুরু উদানা, স্ট্রাইকে মাহমুদউল্লাহ। ধারাভাষ্যকারদের রুম থেকে ভেসে আসছে ‘লেটস সি, লেটস সি’! একটু পরেই তিনজন ধারাভাষ্যকারই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন ‘ওহ মাই গড’! ততক্ষণে মাহমুদউল্লাহর দুহাত ছড়িয়ে উঁচুতে লাফ দিয়ে জয় উৎযাপন। দলের এই ‘সাইলেন্ট কিলার’ বল যে পাঠিয়ে দিয়েছেন সীমানার বাহিরে। অবিশ্বাস্য জয় নিয়ে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে টাইগাররা।
যে কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা যেমন আনন্দের, তেমনি বিদেশের মাটিতে স্বাগতিকদের হারিয়ে ফাইনালে উঠলে আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশ ঘরের মাঠেই কেবল ভালো খেলে, এই ধারণার মূলোৎপাটন অনেক আগেই করে ফেলেছিল টাইগাররা। তবে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটা বাংলাদেশের জন্য আলাদা। বলতে দ্বিধা নেই, এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেকটাই খালি। তাই পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশই। তবে গতকাল ম্যাচে জয়ের পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের জয়টা নিছক সৌভাগ্যবশত এমন ভাবনার অবকাশ নেই। গতকাল ম্যাচের শুরু থেকেই টাইগারদের শরীরী ভাষা বলে দিচ্ছিল জয়ের জন্য কি তীব্র ক্ষুধা পুষে রেখেছিল তারা।
যে ম্যাচ হেরে যায়, সে ম্যাচে টাইগার শিবিরে আক্ষেপ হয়ে থাকে সাকিব আল হাসান। ইশ! যদি সাকিব থাকত! সাকিব থাকা মানেই দলের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়া। সাকিবের মতো অলরাউন্ডার যেকোনো দলে সংযোজন, দলকে নির্ভার রাখতে সাহায্য করে। গতকাল ম্যাচেও প্রতিপক্ষ দল শ্রীলঙ্কাকে মানসিক চাপে রেখেছিলেন এই অলরাউন্ডার। লঙ্কান শিবিরের দ্রুত প্রথম উইকেট নিয়ে ম্যাচের শুরুতেই তাদের চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন এই নির্ভরশীল তারকাই।
ভুল থেকে শিক্ষা, সেই শিক্ষা নিয়েই সামনের পথে এগিয়ে যাওয়া। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ যে সামনের পথে এগিয়ে যেতে পারে, কথাটা গতকাল ম্যাচে কি প্রমাণ করতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ? টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে ভারতের বিপক্ষে ১ রানের হারের আক্ষেপ ভোলাটা কি এতই সহজ? সেই পরাজয় পুড়িয়েছিল পুরো দলকে। চাপের মুখে ভুল শট খেলার অতীত অভিজ্ঞতা মাহমুউল্লাহকে দিয়েছে যে দারুণ শিক্ষা। যে শিক্ষার প্রতিফলন গতকাল চাপের মুখেও ম্যাচ বের করে জয় ছিনিয়ে আনা। যে কাজটা দারুণভাবেই করেছেন অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ।
চার বলে যখন টাইগার শিবিরের প্রয়োজন ১২ রান, লঙ্কান শিবিরে তখন জয়ের পূর্ব প্রস্তুতি। আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে মাঠের মধ্যেই বিবাদে জড়িয়ে পড়েন মাহমুদউল্লাহরা। সাকিবের খেলা ছেড়ে উঠে যাওয়ার ইঙ্গিত, খেলবেন কি খেলবেন না- এই দোলাচলে যখন দুলছিল টিম টাইগার- তখনো কি কেউ ভেবেছিল কী চমক অপেক্ষা করছে সামনে?
দলের এমন বাজে সময়েও মাহমুদউল্লাহর শরীরী ভাষা জানান দিচ্ছিল এখনো হেরে যাইনি। আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের জবাবটা যেন তাঁর হয়ে ব্যাটই দিতে শুরু করল। বিবাদের অবসান ঘটিয়ে ক্রিজে ফিরেই বল ঠেলে দিলেন বাউন্ডারির দিকে। পরের বলে ঝুঁকি নিয়েও দুই রান যোগ করলেন। দুই বলে যখন প্রয়োজন ৬ রান, অতীত অভিজ্ঞতা বলে বাংলাদেশের উইকেটের পতন ঘটবে কিংবা ডট বল হবে। কিন্তু মাহমুদউল্লাহকে এতটুকু বিচলিত দেখা যায়নি।বেশ ঠান্ডা মাথায় দৃঢ়তার সাথেই উড়িয়ে বলকে করেছেন সীমানা ছাড়া। যে ম্যাচ হেরে যাওয়ার কথা, সে ম্যাচে ১ বল বাকি থাকতেই টাইগারদের জয়।
রানের হিসেবে খুব বড় রান নয়। যে ম্যাচটি দেখেনি সে ভাবতেই পারে, এ আর এমন কি, মামুলি ব্যাপার। কিন্তু গতকাল মাহমুদউল্লাহর ইনিংসটা স্বচক্ষে অবলোকন করেছে, সে জানে ১৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংসের মাহাত্ম্য কতখানি! ম্যাচ শেষে এই স্বল্প রানকেই মাহমুদউল্লাহ তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসের তকমা তো আর এমনিতেই জুড়ে দেননি। ৪৩ রানের ক্ষুদ্র ইনিংসটাই যে অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছে নীরবে। বিদেশের মাটিতেও বাংলাদেশকে পাইয়ে দিয়েছে ফাইনালের টিকেট।
ক্রিকেটের মাঠে ও মাঠের বাহিরে এই ম্যাচ অনেক অঘটনের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু ক্রিকেটের রেকর্ড বইয়ে কোথাও লেখা থাকবে না মাঠের ঘটনা। লেখা থাকবে ফলাফল। যে ফলাফলে বিজয়ীর মুকুট টাইগারদের মাথায়ই। অভিনন্দন টিম টাইগার।