ক্রিকেট মাঠে যত বল টেম্পারিং

টেস্ট ক্রিকেটে দিন যত গড়ায় বলটার মূল্য যেন তত বেড়ে যায়। যত দ্রুত বল পুরোনো হবে, বোলাররা রিভার্স সুইং কিংবা লেট সুইংয়ে ব্যাটসম্যানদের ছোবল দিতে পারবেন তত দ্রুত। স্বাভাবিক নিয়মে বল পুরোনো হওয়ার অপেক্ষা কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা অনেক সময়ই করতে চান না ক্রিকেটাররা। চেষ্টা করেন কৃত্রিম উপায়ে নষ্ট করার। এটাই পরিচিত ‘বল টেম্পারিং’ নামে।
পাড়ার ক্রিকেটে একটু প্রতারণার আশ্রয় নেওয়াই যায়, কিন্তু তাই বলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও? তবে হাজার হাজার দর্শকের সামনেও বল টেম্পারিংয়ের মতো বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। টেম্পারিংয়ের অভিযোগ তোলায় পাকিস্তান দল মাঠই ছেড়ে চলে গিয়েছিল। জানলে অবাক হতে হবে এমন ঘটনায় জড়িয়ে আছে শচীন টেন্ডুলকারের নামও! অবশ্য পরে ক্রিকেটের অন্যতম ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত ব্যাটিং মায়েস্ত্রর নামের পাশ থেকে সে অভিযোগ তুলে নেয় আইসিসি।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বল টেম্পারিংয়ের ঘটনায় চারদিকে সমালোচনার ঝড়। মজার ব্যাপার ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে প্রোটিয়া অধিনায়ক ফাফ দু প্লেসি নিজেও অভিযুক্ত হয়েছেন এমন ঘটনায়। বল টেম্পারিংয়ের শিকার যেমন সবচেয়ে বেশিবার হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, তেমনি বল নষ্ট করার ঘটনায় এগিয়ে তারাই।
জেনে নেওয়া যাক ক্রিকেট ইতিহাসের তেমন কয়েকটি বল টেম্পারিংয়ের ঘটনা :
পকেটে রাখা ধুলো দিয়েই টেম্পারিং
সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার মাইক আথারটন ১৯৯৪ সালে পকেটে রেখে দিয়েছিলেন ধুলো। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সে টেস্টে ধুলোবালি দিয়েই ঘষে নষ্ট করতে চেয়েছিলেন বলের ঔজ্জ্বলতা। সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও পারেননি টিভি ক্যামেরা থেকে লুকোতে। পরে অবশ্য নিজের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন, ধুলো নাকি তিনি পকেটে রেখেছিলেন হাতকে শুকনো রাখতে। সেই যুক্তি অবশ্য কাজে দেয়নি, পুরো ২০০০ পাউন্ড জরিমানা গুনতে হয়েছিল বর্তমানের বিশ্ববরেণ্য এই ক্রিকেট ধারাভাষ্যকারকে।
শচীন টেম্পারিং করেছেন, শচীন করেননি
২০০১ সালে পোর্ট এলিজাবেথে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শচীন টেল্ডুলকারের বিরুদ্ধে ম্যাচ রেফারি মাইক ডেনিস তুলেছিলেন বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ। ভারতীয় এই ব্যাটিং কিংবদন্তিকে দেখা যায় বলের সিম টানতে। অবশ্য শচীন সিম লেগে থাকা ঘাসগুলো সরানোর চেষ্টা করছিলেন বলেই পরে প্রমাণিত হয়। শচীন নিজেও মুক্তি পেয়েছিলেন সেই অভিযোগ থেকে। তবে প্রয়াত স্কটিশ ম্যাচ রেফারি ডেনিস আর সে সিরিজে থাকতে পারেননি ম্যাচ রেফারি দায়িত্বে।
টেম্পারিংয়ের অভিযোগে মাঠ ছেড়েছিলেন ইনজামামরা
পুরো পাকিস্তান দলের বিরুদ্ধেই অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার তুলেছিলেন টেম্পারিংয়ের আঙুল। পাঁচ রান পেনাল্টির সঙ্গে মাঠে ঢুকেছিল নতুন বল। তবে সেদিনের টি-ব্রেকের পর ইনজামাম-উল-হকের দল প্রতিবাদ স্বরূপ মাঠেই নামেনি। ক্রিকেট আইন অনুযায়ী ইংলিশরা সে টেস্ট জিতে নিলেও কার্যত আম্পায়ার হেয়ারের ক্যারিয়ারটাই শেষ হয়ে যায় সেখানে।
অ্যান্ডারসন-ব্রড কেলেঙ্কারি
ইংলিশদের হয়ে বোলিংয়ের উদ্বোধনই নয় শুধু, এই দুই পেসার জুটি বেঁধেছিলেন বল টেম্পারিংয়েও। বলকে মাটিতে রেখে জুতোর স্পাইক দিয়ে ঘষে অবৈধ পন্থায় এই পেস-যুগল চাইছিল বলকে পুরোনো করতে। তবে প্রতিপক্ষ দল থেকে লিখিত অভিযোগ না আসায় শেষমেশ আর কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি ব্রড কিংবা অ্যান্ডারসনকে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিডল-কাণ্ড
২০১২ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নাকি বলের সিমই তুলে ফেলতে চাইছিলেন অসি পেসার পিটার সিডল। ম্যাচে পাঁচ উইকেট নেওয়া এই পেসারের বিপক্ষে ম্যাচ রেফারির কাছে নালিশ জানিয়েছিল লঙ্কানরা। অবশ্য কোনো শাস্তি ছাড়াই অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন সিডল।
দুবাইয়ে দু প্লেসির বল নষ্টের চেষ্টা
পাকিস্তানের বিপক্ষে দুবাইয়ে নিজের ট্রাউজারের চেইনে ঘষে বল নষ্ট করতে দেখা গিয়েছিল ফাফ দু প্লেসিকে। ২০১৩ সালের সেই ঘটনায় পাকিস্তান পাঁচ রান পেনাল্টির সঙ্গে পেয়েছিল নতুন বল। ঠিক যেন ইংল্যান্ডে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সে ঘটনার উল্টোটা।
ফিল্যান্ডারের আঁচড়ে বল নষ্ট করার প্রচেষ্টা
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০১৪ সালে প্রোটিয়া পেসার ভারনন ফিল্যান্ডার আঁচড় দিয়ে বল নষ্ট করতে চেয়েছিলেন। ম্যাচটা তাঁর দল জিতলেও, ডানহাতি পেসারকে ম্যাচফির ৭৫ শতাংশ জরিমানা গুনতে হয়েছিল।
ফের দু প্লেসি, এবার অসিদের মাঠে
মুখের চুইংগামের রস ব্যবহার করে বল টেম্পারিংয়ের চেষ্টা করার অভিযোগ নিয়ে তোলপাড় চলেছিল বিশ্বক্রিকেটে। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোবার্টে সে টেস্টসহ সিরিজটাও জিতেছিল দু প্লেসির দল।
টেম্পারিংয়ের ঘটনাগুলো কোনোভাবেই ক্রিকেটের মূল উদ্দেশ্যকে সমর্থন দেয় না। তবুও ম্যাচ জেতার জন্য অনেক ক্রিকেটার, অনেক দলই চেষ্টা করেছে বল নষ্ট করে অবৈধভাবে সুবিধা নেওয়ার। তবে সব সময় যে টেম্পারিংটা হয়েছে ইচ্ছেকৃতই তেমন কিন্তু নয়, মাঝেমধ্যে আম্পায়ারের ভুল সন্দেহেও ক্রিকেটারদের গায়ে লেগেছে অভিযোগের তাপ।