ছুটির দিনে
২২৩ বছরের সূর্যমণি মেলা
সূর্যমণির মেলা। যাঁরা এই মেলার সঙ্গে পরিচিত নন, চলুন না আজ একটু ঘুরে আসি আজ থেকে ২২৩ বছর পূর্বে সূর্যমণির মাঠে।
সূর্যমণির মেলার ইতিহাস
বর্তমান বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের বেতাল গ্রামের সূর্যমণির মাঠে ২২৩ বছর পূর্বেও চলত চাষাবাদ। সেই সময়ের কোনো এক দিনে জমিতে লাঙল চালাচ্ছিলেন এক কৃষক। হঠাৎ কিসে যেন লাঙলের ফলা আটকে গেল। কিছুতেই আর হালের গরু সামনে আগাতে পারছিল না। তাই নিরুপায় কৃষক কোদাল দিয়ে কিছু মাটি সরিয়ে দেখতে পেলেন, কালো মতন শক্ত কিছু। দৌড় দিয়ে সরকার বাড়ির কর্তাকে জানালেন। ছুটে এলো লোকজন। মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল কালো বর্ণের কষ্টিপাথরের সূর্যমূর্তি, লাঙলের ফলায় আটকে যার কানের এক অংশবিশেষ ভেঙে যায়।
মূর্তিটির সযত্নে ঠাঁই হলো সরকারবাড়িতে। কিন্তু বাড়ির গিন্নি স্বপ্নে পেলেন এক আদেশ। জমির যে স্থানে যে দিনে মূর্তিটি পাওয়া গেছে, সেখানে সেই দিনে করতে হবে সূর্যঠাকুরের পূজা। আর দিনটি ছিল মাঘী সপ্তমীর শুক্লপক্ষ।
খুব সম্ভব ১৭৯৫ খ্রি. এ পূজাকে কেন্দ্র করে প্রথম মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ কাহিনীর নিশ্চিত প্রমাণ না মিললেও জ্ঞানী-গুণী ইতিহাসবিদ ও স্থানীয়দের মাঝে কথিত ও গৃহীত ইতিহাস এটাই। মূলত সূর্যমূর্তির পূজাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এ মেলার প্রচলন। হিন্দু সম্প্রদায় বিশ্বাস করে, এ পূজা করলে সূর্যের তাপ, রাহু, রোগবালাই থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং বৃদ্ধি পাবে জমির উর্বরা শক্তি। শুরুতে মেলা একদিনই হতো। ১৯৬৫-৭০-এর দিকেও প্রচলিত ছিল তিন দিনব্যাপী এ মেলা। আর এখন ধীরে ধীরে মেলার ব্যাপ্তি বেড়ে ৩০ দিনে দাঁড়িয়েছে।
সরকারবাড়ির শেষ বংশ গঙ্গু সরকার ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় তাঁর বাড়িঘর-জমিজমা চেরাগ আলী মোল্লাকে দান করে যান, মতান্তরে বিক্রি করে যান। সেই থেকে মোল্লা পরিবার এই সূর্যমণির মাঠের মালিক। বর্তমান বংশধর জাকির মোল্লাসহ এ মেলার আয়োজনে রয়েছে মেলা আয়োজক কমিটি ও পূজা কমিটি।
পাঁচ ফুট লম্বা, চোখে রেডিয়াম লাগানো কষ্টিপাথরের এ ঐতিহাসিক সূর্যমূর্তিটি ১৯৬৮ সালে চুরি হয়ে যায়। তবে তাতে থেমে যায়নি পূজা ও মেলার প্রচলন। মাটির তৈরি সূর্যমূর্তি দিয়ে প্রতিবছর পালিত হয় এ মেলা।
এ বছর ২৪ জানুয়ারি মাঘী সপ্তমীর শুক্লপক্ষে সূর্যোদয়ের পরপর সূর্যঠাকুরের পূজার মধ্য দিয়ে উদ্বোধন ঘটে ২২৩তম বানারীপাড়া সূর্যমণির মেলায়। চলবে ২৩ ফেব্রুয়ারি অব্দি। গ্রাম্য মেলা, নাগরদোলা, বাতাসা আর নাড়– শব্দগুলো অনেকটাই যখন রূপকথা আর ইতিহাস হয়ে উঠছে প্রযুক্তির দ্রুত ধাবমান যাত্রায়, ঠিক তখন শত শত বছর ধরে পালিত হয়ে আসা লোককাহিনী সমৃদ্ধ এক গ্রাম্যমেলা যেন ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রথায়, সভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। তাই যাঁরা এই ঐতিহাসিক মেলার সাক্ষী হতে চান, তাঁরা আজই চলুন বানারীপাড়ার বেতাল গ্রামে সূর্যমণির মেলাতে।
যা পাবেন
শতাধিক স্টল সমৃদ্ধ এ মেলার মূল আকর্ষণের একটি হচ্ছে স্বল্পমূল্যের কাঠের আসবাব। পাবেন সেগুন, গর্জন, মেহগনি, কড়ই, রেন্ডিসহ নানান কাঠের টেবিল-চেয়ার, খাট-সোফা ইত্যাদি। রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্মণ দাস সার্কাস। সঙ্গে সার্কাসের প্রশিক্ষিত হাতি, বাঘ, ভালুক, গাধা, ঘোড়া ও বানর। এদের খেলা ছাড়াও রয়েছে বাইকের খেলা, যা সুনাম কুড়িয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচ ও যাত্রাপালা, হাউজি ও লটারি পুরো উপজেলার মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। যদিও এ বছর অনুমতি-সংক্রান্ত জটিলতায় বন্ধ রাখা হয়েছে হাউজি ও লটারি। স্থানীয়দের থেকে জানা যায়, গভীর রাতে যাত্রাপালা ও পুতুলনাচে বছরের পর বছর থেকে চলে আসছে।
গ্রাম্যমেলার এক মূল বৈশিষ্ট্য কাঠের নাগরদোলা তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে এ বছর নতুন সংযুক্ত হয়েছে নৌকা আকৃতির স্টিলের নাগরদোলা।
মেলায় খুব ভালো মানের নানা ধরনের খাবার পাওয়া যায়। মেলায় ওঠা বিভিন্ন ধরনের বরই সকলের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত। এ ছাড়া মেলায় ওঠা বিশাল আকৃতির মিষ্টির কদর রয়েছে, যা ঐতিহ্যবাহীও বটে।
১১ মাস চাষাবাদ আর এক মাসব্যাপী এ মেলার মাঠে রয়েছে শ্রীশ্রী সূর্যদেবের মন্দির, যেখানে রাখা মাটির সূর্যমূর্তির পূজা হয় এক মাসব্যাপী প্রতি সকালে। বংশানুক্রমে পূজার দায়িত্বে থাকা পুরোহিতদের বর্তমান বংশধর কৃষ্ণকান্ত ভট্টাচার্য। মন্দিরে গিয়ে আপনি শুধু ২০ টাকায় কিনতে পারেন আবদুল হাই বখশের লেখা ‘বানারীপাড়া সূর্যমণি মেলার ইতিহাস’ শীর্ষক এক পুস্তিকা।
যেভাবে যাবেন
বরিশাল নথুল্লাবাদ বা নতুন বাজার থেকে বাসে ৫০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা এবং মাহিন্দ্রতে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটে পৌঁছে যাবেন বানারীপাড়া উপজেলার বাসস্ট্যান্ডে। নতুন বাজার থেকে বানারীপাড়া যাওয়ার জন্য আলাদা ‘সেবা’র সেবা পেতে পারেন, ভাড়া মাত্র ৩৫ টাকা। নথুল্লাবাদ থেকে স্বরূপকাঠির বাসে উঠে নামতে পারেন বানারীপাড়া মাত্র ৩০ টাকায়, সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত যেকোনো সময়। আর মাহিন্দ্রে ২৪ ঘণ্টাই আপনি সুযোগ পাবেন যাতায়াতের; ভাড়া ৩৫ টাকা। বানারীপাড়া বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে একটি রিকশা নিতে পারেন ১৫-২০ টাকা ভাড়ায় আর ১০ মিনিটের মতো সময়ে পৌঁছে যাবেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য—সূর্যমণির মেলায়। নিজস্ব গাড়ি থাকলে বা ভাড়া করে নিলে তো আর কথাই নেই।
মেলায় ঘোরার জন্য নিরাপদ ও উপযুক্ত সময় বিকেল। অতি কৌতূহলী হলে রাতের জাঁকজমকের স্বাদও নিতে পারেন। তবে কাছাকাছি রাতে থাকার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি পরিচিত থাকে আর রুম খালি পান, তবে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় অবস্থান নিতে পারেন। সেখানে দুটি ভিআইপি রুম এবং ১০/১২টি সাধারণ রুমের ব্যবস্থা রয়েছে। আসার বা ফেরার পথে আপনি চাইলে আপনার পরিকল্পনায় রাখতে পারেন গুঠিয়া মসজিদ ও দুর্গাসাগর ঘুরে নেওয়ার প্রস্তুতি। কারণ পথেই আপনি অতি সহজেই পাচ্ছেন বরিশালের বিখ্যাত এ দুটি ভিজিটিং স্পটও।
সূর্যমণির মেলা দেখতে বানারীপাড়া উপজেলায় ঢোকাটাও বেশ মনোরম। আধুনিকতা ও গ্রাম্য জীবনের এক অপূর্ব মেলবন্ধন যেন। মসৃণ পিচঢালা রাস্তার দুপাশের বৃক্ষরাজির ছায়া এক অন্য আবেশ তৈরি করে রেখেছে।
কালক্রমে হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা ও ঐতিহ্যের মতনই আবার যেন না হারিয়ে যায় সূর্যমণির মেলা। তাই ঝুঁকি এড়াতে এবারই ঘুরে আসুন বানারীপাড়া সূর্যমণির মেলায়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যপ্রেমীদের জন্য এ এক দারুণ অভিজ্ঞতার হাতছানি।