ঘোরাঘুরি
মেঘ পাহাড়ের দেশে

বুয়েট থেকে আমাদের ১১ জনের দলটি ভুটানের পথে পাড়ি জমায় ২১ ডিসেম্বর রাতে। বাজেট স্বল্প থাকায় আমরা আকাশপথের জায়গায় সড়কপথে ভ্রমণ বেছে নিয়েছিলাম। যার কারণে অদ্ভুত সুন্দর দেশটা আমরা দেখতে পাই। ভুটান যেতে কোনো ভিসা লাগে না, কিন্তু ট্রানজিট ইন্ডিয়া হওয়ায় ইন্ডিয়ার ট্রানজিট ভিসা লেগেছিল। পুরো দলের মধ্যে এই ভিসার অভিজ্ঞতা আমার সবচেয়ে খারাপ ছিল।
কিছুদূর সামনেই ভুটানে প্রবেশের রাজকীয় গেট। আমরা ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে অবশেষে ভুটানের মাটিতে পা রাখলাম। শহরটার নাম ফুটশোলিং। বলতে দ্বিধা নেই গেটের এপার আর ওপারে আকাশ-পাতাল তফাত। এখানে রাস্তায় একটা ময়লা পর্যন্ত নেই, জেব্রা ক্রসিংয়ে দাঁড়ানো মাত্র যানবাহন থেমে যেতে বাধ্য। কোনো প্রকার দূষণের সঙ্গে এরা পরিচিত বলে মনে হলো না। ওদের বিল্ডিংগুলো দেখে আমরা অবাক হচ্ছিলাম। কোনটা মন্দির, কোনটা বাসাবাড়ি আর কোনটা অফিস—পার্থক্য করা মুশকিল।
প্রতিটি বিল্ডিং সুন্দর কারুকার্য করে বানানো। সব জায়গায় টানানো ছিল অনেক রঙিন কাগজ আর গাছের গোড়াগুলোয় ছিল ছোট ছোট রঙিন পাথর। এগুলোর অর্থ আমরা পরে জানতে পেরেছিলাম। এখানের কিছু দোকানপাট ঘুরে দাম সম্পর্কে যা শুনে এসেছিলাম, তা পরিষ্কার হয়ে গেল। যদি শখ করে কিছু কিনতেই হয়, পকেট ভারি করে আসতে হবে।
পরদিন সকালে আমরা রওনা হলাম ভুটানের রাজধানী থিম্পুর উদ্দেশে। পথে এক জায়গায় আমরা সকালের নাশতা করার জন্য থামলাম। তখন সেখানে তাপমাত্রা ৫-৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমাদের সবার জন্য এত নিম্ন তাপমাত্রার অভিজ্ঞতা প্রথম হওয়ায় যার যত শীতের কাপড় ছিল সব পরার পরও শীতে কাঁপছিলাম। ওই হোটেলে ফ্রাইড রাইস আর চাউমিন খেয়ে আমাদের ভুটানের খাবারের প্রতি অভক্তি চলে এসেছিল।
পথে গাড়ি নষ্ট হওয়ায় আমাদের থিম্পু পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তবে আমরা সাইটসিইং করতে করতে যাচ্ছিলাম। প্রতিটি জায়গায়ই ছবির মতো সুন্দর। চারপাশে শুধু পাহাড় আর রঙিন কাগজ। পথে একটা সুন্দর ঝর্ণাও পেলাম আমরা, যেটার পানি বরফের মতো ঠান্ডা। যত বেলা বাড়ছিল, বাড়ছিল ঠান্ডা বাতাস আর কমছিল তাপমাত্রা।
আমাদের প্ল্যান ছিল ওই দিন থিম্পু শহরটা ঘুরে দেখব। লিস্টে ছিল ন্যাশনাল মেমোরিয়াল, আর্চেরি গ্রাউন্ড, রয়্যাল প্যালেস, বুদ্ধা পয়েন্ট, ভুটান পার্লামেন্ট, বিবিএস টাওয়ার। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমরা হোটেলে ফ্রেশ হয়ে আশপাশে পায়চারি করে ঘুরে দেখি। হোটেলের পাশেই ছিল ক্লক টাওয়ার। তখন তাপমাত্রা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। আমরা ডিনার করেই হোটেলে ফিরে গেলাম।পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমরা সরাসরি বুদ্ধা পয়েন্ট দেখতে গেলাম। সেখানে আছে গৌতম বুদ্ধের বিশাল সোনার মূর্তি আর বুদ্ধের ১০০ রূপ। তারপর আমরা রওনা হলাম ভুটানের মূল আকর্ষণ পারোর টাইগার নেস্টের দিকে। পথে দেখলাম রয়্যাল প্যালেস। যেটা শুধু দূর থেকে দেখারই অনুমতি আছে। বলে রাখা ভালো, ভুটানিরা যেমন ধার্মিক তেমনই রাজার প্রতি ভক্তিও কম নয়। প্রায় কিছুদূর পরপরই ডিসপ্লে বোর্ডে রাজা-রানির ছবি।
পারোতে পৌঁছে হোটেলে যাওয়ার আগেই আমরা সরাসরি গেলাম টাইগার নেস্টের গোড়ায়। ভুটানের মাটি থেকে কয়েকশ ফুট ওপরে মন্দিরটার অবস্থান। আমরা আগেই জেনে নিয়েছিলাম সেখানে উঠতে লাগে তিন ঘণ্টা আর নামতে লাগে দুই ঘণ্টা। দুপুর ১২টায় আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করি। উচ্চতা যত বাড়ছিল, অনেকের শ্বাসকষ্ট ও হচ্ছিল। আমাদের দলের দুজন কিছুদূর গিয়েই হার মেনে নেয়। একজনের যাত্রা শেষ হয় অর্ধেক রাস্তা পার করে অবস্থিত ক্যাফেতে। ট্র্যাকিং করতে করতে আমরা হাঁপিয়ে গিয়ে কিছুদূর পরপরই বিশ্রাম নিচ্ছিলাম আর পানি খুঁজছিলাম। তবে পানি যত কম খাওয়া যায়, তত সহজে পাহাড় বেয়ে ওঠা যায়। অনেক ট্যুরিস্ট তখন টাইগার নেস্ট দর্শন শেষে নেমে যাচ্ছিলেন। আমরা সবাইকে প্রশ্ন করতে করতে যাচ্ছিলাম গন্তব্যস্থল আর কত দূরে।ভুটানিজদের ব্যবহার অমায়িক। একপর্যায়ে যখন আমাদের কোনো শক্তিই অবশিষ্ট ছিল না, কিছু ভুটানিজরা আমাদের কমলা খেতে দেন। আমরা ভিউপয়েন্ট পর্যন্ত পৌঁছে ৬০০ সিঁড়ি নেমে আবার ওঠার সাহস সঞ্চয় করতে পারলাম না। দলের মধ্যে শুধু একজনই টাইগার নেস্ট ঘুরেফিরে আসতে পারে। ভেতরে আছে কিছু সুন্দর ভাস্কর্য আর ঐতিহাসিক নিদর্শন। কিন্তু সেখানে ছবি তোলা নিষেধ! আমরা যখন নামা শুরু করি, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। একসময় আমরা পথ চিনে নামতে পারছিলাম না। তখন আবার একজন ভুটানিজ আমাদের সাহায্য করেন। তিনি আমাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যান। এই যাত্রা দিনের আলো থাকতেই শেষ করা ভালো, কারণ পথ খুবই বিপজ্জনক এবং অন্ধকারে পার হওয়া কষ্টসাধ্য। তবে যেতে যেতে ভুটানিজ ভদ্রলোক তার দেশ সম্পর্কে অনেক তথ্য দিলেন আমাদের। দেশজুড়ে ওই রঙিন কাগজগুলোতে তাদের প্রার্থনামন্ত্র লেখা থাকে এবং গাছের গোড়ায় পাথরগুলো তাদের পূর্বসূরিদের আত্মার স্মরণে রাখা। আমরা কিছু ভুটানিজ খাবারের নামও জানলাম।
ওই দিন হোটেলে ফিরে আমাদের আর নড়াচড়া করার মতো অবস্থা ছিল না। রাতে খেয়েই শুয়ে পড়তে হয়। পরদিন আমাদের গন্তব্য ছিল চেলেলাপাস। ওখানে যাওয়ার আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বরফ দেখা। যেতে যেতেই আমরা অনেক জায়গায় বরফ দেখতে পাই। কিন্তু তখন রোদ উঠে যাওয়ায় অনেক জায়গার বরফই গলে গিয়েছিল। দূরের পাহাড়ের চূড়ার বরফে যখন রোদ চিকচিক করছিল, সে এক অপার্থিব দৃশ্য।
সেখানে পাহাড়ে কিছুক্ষণ বেরিয়ে আমরা পারোর হোটেলে আবার ফিরে আসি। ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করতে বের হই। এই কয়দিন আমরা রুটি আর ভাত খেয়েছি সব বেলাতেই। একেকদিন একেক রেস্টুরেন্টে কিন্তু বলে রাখা ভালো, খারাপ না হলেও কোথাওই ইন্ডিয়ান খাবার তৃপ্তি করে খাওয়ার মতো নয়। ওই দিন আমাদের ভুটান ভ্রমণের শেষ দিন হওয়ায় আমরা ঠিক করি। ভুটানিজ খাবার টেস্ট করব, ভাগ্যক্রমে আমরা যেই রেস্টুরেন্ট বেছে নেই সেখানে খাবারের স্বাদ ছিল দারুণ। আমরা ফ্রাইড ভেজ মোমো আর এমাডাটশি (চিলি, চিজ, আলু/মাশরুম আর স্টিকি রাইস) নেই। এবং ঠিক করি রাতেও এখানেই খেতে আসব।
এরপর আমরা শপিংয়ে বের হই। কেনার মতো সুন্দর জিনিস অনেক, কিন্তু দামটাও বেশি। তাই বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের জন্য ছোট ছোট স্যুভেনির কিনি। রাতে হোটেলের কাছে এক সুন্দর লেক ঘুরে হোটেলে ফিরে আসি।
পরদিন সকালে আমরা ইন্ডিয়ার বর্ডারের উদ্দেশে রওনা হই। তখন তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভুটান ভ্রমণে ইচ্ছুকরা যদি বাজেট একটু বেশি রাখতে পারেন, তাহলে আকাশ যাওয়ার পরামর্শ দেবো, কারণ বর্ডারে অনেক ফর্মালিটিজ পূরণ করতে হয়, যাতে অনেক সময় ব্যয় হয়। আর বাই রোড গেলে বর্ডারেই টাকা/ডলার ভাঙিয়ে রুপি করে দেয়, তাই সেটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। সন্ধ্যায় আমরা ঢাকাগামী বাসে উঠে সকালে পৌঁছে গেলাম।
আফসোস থেকে গেল থিম্পু আর পারোর অনেক জায়গাই ঘুরে দেখতে পারলাম না সময়স্বল্পতার কারণে। পুনাখা যাওয়ারও ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ফেরার তাড়াতে আর হয়ে উঠল না। আমরা ফিরলাম আবার ভুটান দর্শনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।