সুন্দরবন ভ্রমণ
রোমাঞ্চকর করমজল ও হাড়বাড়িয়ায় কিছু সময়
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, বিপুল বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবন ক্রমেই সৌন্দর্যপিপাসু ভ্রমণকারীদের জন্য হয়ে উঠেছে তীর্থস্থান। আপনি কেন বাদ থাকবেন সুন্দরবন ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা থেকে। ঘুরে আসুন সুন্দরবন, চারপাশে বানরের খেলা, কুমিরের চলাচল এবং হরিণের মায়াবী চোখ, কাঠের ট্রেইলে বনে হাঁটা আপনাকে দেবে এমন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, যার স্মৃতি বয়ে বেড়ানো যায় সারা জীবন।
করমজলে ও হাড়বাড়িয়ায় যা দেখবেন
মোংলা ফেরিঘাট থেকে করমজলের দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার, জাহাজ বা ট্রলারে পৌঁছে যাবেন ঘণ্টা দেড়েক এর মধ্যে। ঘাটে নামার আগেই নদীর পাড় দিয়ে বানরের খেলা দৌড়ঝাঁপ আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে। পশুরের ঘোলা পানির মৃদু ঢেউ নৌযানের সঙ্গে দুলিয়ে দেবে আপনার মনটাকেও। ঘাটে নামতেই পাবেন বন বিভাগের কার্যালয়, সুন্দরবনের বড় একটা মানচিত্র। চোখ বুলিয়ে এগোতেই দেখতে পাবেন, দেয়ালে, গাছে বসে আসে, ঝুলছে অনেক রেসাস বানর, কৌতূহলী দৃষ্টিতে আপনার দিকে তাকিয়ে জানাচ্ছে উষ্ণ অভ্যর্থনা। সামনে এগোলেই ওয়াচ টাওয়ার, ওপরে উঠে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন বনের উপরিভাগে। তবে বানর থেকে সাবধান, আপনাকে জ্বালাতে তারা কিন্তু আছে সব জায়গাতেই। এর সঙ্গেই লাগোয়া হরিণ প্রজনন কেন্দ্র, দেয়ালে আবদ্ধ হরিণের গায়ে হাত বুলিয়ে সামনে এগোলেই পাবেন ডলফিন শেড। এখানে দেওয়া বিভিন্ন ডলফিনের ছবি ও তথ্য থেকে ডলফিন সম্পর্কে পাবেন বিস্তর ধারণা। এরই অপর পাশে বড় এক শেডে দেখতে পাবেন সুন্দর করে সাজানো কুমিরের ডিম, ছোট ছোট কচ্ছপ, অনেক কুমিরের ছানা। হ্যাঁ, এটা হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র লোনাপানির কুমির ও কচ্ছপ প্রজজন কেন্দ্র। এর পাশের পুকুরেই থাকে রোমিও ও জুলিয়েট নামের চমৎকার দুটো কুমির, নাম ধরে ডাকতেই সাড়া দিয়ে চলে আসবে আপনার কাছে।
রোমিও-জুলিয়েটকে বাই বলে সামনে এগোন। ঘন বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে একটি কাঠের তৈরি ট্রেইল, নাম মানকি ট্রেইল। পা দিয়েই বুঝতে পারবেন নামের সার্থকতা। চারদিকে সবুজ আর সবুজ, গোলপাতা, সুন্দরী গাছ, কত পাখির কলতান, নিচে তীক্ষ্ণ শ্বাসমূল, আহ্, ট্রেইলে হাঁটার কী যে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আপনি পাবেন। হাঁটতে হাঁটতে অপর পাশ দিয়ে চলে আসবেন দেড় কিলোমিটারের ট্রেইলটির শেষ প্রান্তে, পাবেন একটি বড় শেড, বসার জায়গা। কিছুক্ষণ সেখানে রেস্ট নিয়ে নিতে পারেন। তারপর আশপাশে আরেকটু ঘুরেফিরে দেখতে পারেন। দেখা শেষ হলে বানরগুলোকে আবার বাই বলে করমজল ত্যাগ করে যাত্রা শুরু করতে পারেন পরবর্তী গন্তব্য হাড়বাড়িয়ার দিকে।
হাড়বাড়িয়া করমজল থেকে অল্প কয়েক কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত। যেতে যেতে দেখবেন নদীপথে ব্যস্ততা কতটা বেড়ে গেছে, ছুটে চলছে ছোট-বড় কত নৌযান, এর কোনোটা পণ্যবাহী, কোনোটা পর্যটকবাহী। হাড়বাড়িয়া যেতে যেতে নদীর দুপাশের সৌন্দর্য দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যাবে, কারণ বন এদিকে আরো ঘন, আরো সুন্দর। দেখবেন নদীর তীরে বানর হরিণ এক ঘাটে পানি খাচ্ছে, ওড়াউড়ি করছে কত নাম না জানা পাখি। জাহাজে গেলে একটু দূরেই থেমে ট্রলারে ঘাটে যেতে হবে। ট্রলারে গেলে খালের দুধারে গোলপাতা, ছোট ছোট ঢেউ পেরিয়ে সরাসরি পৌঁছে যেতে পারবেন ঘাটে। এখানেও ঘাট থেকে নেমে একটু দূরেই বন বিভাগের কার্যালয়। বসার জন্য এদিকে-ওদিকে বেশ কয়েকটি সুন্দর ছাউনি। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ ঘুরে যাত্রা শুরু করতে পারেন বনের ভেতর।
প্রথমেই ছোট খাল, খালের ওপর চমৎকার ঝুলন্ত সেতু। সেতু পেরোলেই একটি পুকুর, পুকুরের দুদিক দিয়ে চলে গেছে দুটো রাস্তা, ইট বিছানো। হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ে নানা ধরনের কাঁকড়া, পশুর পায়ের ছাপ। ইটের রাস্তা শেষ হতেই উঁচু একটি ওয়াচ টাওয়ার, উপরে উঠে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন এদিক-ওদিক, কী অপূর্ব। নেমে আবার হাঁটা শুরু করুন কাঠের ট্রেইলে, সেই একই রোমাঞ্চ। নিচে তাকালে কত কাঁকড়া, প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখা যায়। নাম না জানা নানা পাখির কলতানে মুগ্ধতা নিয়ে হাঁটতে থাকি। এই এলাকায় বাঘের আনাগোনা বেশি, হাঁটতে হাঁটতে একসময় বাঘের পায়ের ছাপও দেখে ফেলবেন কোথাও না কোথাও। চোখে পড়বে আরেকটি সুন্দর খাল, এটি কুমিরের অভয়ারণ্য। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে এলে কুমিরের দেখা মেলা সহজ, রোদ পোহাতে উপরে উঠে আসে তারা। এখানে দেখা মেলে মায়াবী চোখের মায়া হরিণ। হাঁটতে হাঁটতে আবার চলে আসবেন পুকুরের অন্যপ্রান্তে, লাল ইটের রাস্তায়। দেখবেন বানর লাফাচ্ছে, তাকিয়ে আছে আপনার দিকে, আপনিও তাকিয়ে থাকুন। কেউ কেউ ভেংচি কাটবে, কেউ আবার লজ্জায় লুকাবে বনে। পুকুরের মাঝখানে সুন্দর একটা বসার জায়গা, কাঠের পথ। এখানে একটু বসে রেস্ট নিয়ে, খোশগল্প করে ফিরতে পারেন
নৌযানের দিকে।
শুরুতেই জানা প্রয়োজন
সুন্দরবন ভ্রমণ দেশের অন্যান্য স্থানে ভ্রমণের চেয়ে একটু আলাদা। কারণ বনাঞ্চল হওয়ায় মেনে চলতে হয় বেশ কিছু নিয়মকানুন, যেমন বন বিভাগের অনুমতি নেওয়া, গার্ড নেওয়া ইত্যাদি। ফলে নিজের ব্যবস্থাপনায় গেলে ভ্রমণের আনন্দের চেয়ে বিড়ম্বনাই বেশি হতে পারে। ঝামেলামুক্ত, সহজভাবে এবং স্বল্প খরচে সুন্দরবন ভ্রমণে ট্রাভেল এজেন্সির সহায়তা নেওয়াই ভালো। ট্রাভেল এজেন্সিগুলো প্রতি শুক্র, শনি ও রোববার খুলনা থেকে একা কিংবা দলগত, একদিনের কিংবা তিন দিনের প্যাকেজ অফার করে থাকে। আপনি সেখানে গিয়ে কিংবা আগেই যোগাযোগ করে বুকিং দিতে পারেন। আপনার সুন্দরভাবে এবং নিরাপদে ঘুরে আসার সব দায়িত্ব তারাই নেবে। একদিনের প্যাকেজ সাধারণ ভ্রমণ করার সুন্দর নৌযানের মাধ্যমে 'মোংলা-করমজল-হাড়বাড়িয়া- মোংলা' ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। তিন দিনের ভ্রমণে ব্যবহার হয় বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় সুন্দর জাহাজ। থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থা জাহাজেই থাকে। তিন দিনের প্যাকেজে রোড দুটি, একটি হচ্ছে 'মোংলা-করমজল-হাড়বাড়িয়া-কটকা-হিরণপয়েন্ট-দুবলার চর-মোংলা', অপররটি 'মোংলা-করমজল-হাড়বাড়িয়া-কচিখালি-ডিমের চর-মোংলা'। একদিনের প্যাকেজ জনপ্রতি ১৫০০-২০০০ টাকা, তিন দিনের প্যাকেজ জনপ্রতি ৮০০০-১০০০০ টাকা পর্যন্ত হয়। এই খরচটা নির্দিষ্ট, কারণ প্রচুর টাকা নিয়ে গেলেও বাড়তি খরচের উপায় নেই।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার বিভিন্ন বাসস্টেশন থেকে সরাসরি মোংলা যায় পর্যটন সার্ভিসের অনেক বাস, নামতে পারেন খুলনাও, পরে খুলনা থেকে মোংলা। বাস ভাড়া ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকার মধ্যেই। পৌঁছানোর পর আপনার প্যাকেজ অনুযায়ী যাবতীয় ব্যবস্থা ট্যুর এজেন্সিই করবে।
কোথায় থাকবেন
জাহাজে তিন দিনের ভ্রমণে গেলে থাকা-খাওয়ার সব সুব্যবস্থা জাহাজেই থাকে। একদিনের ভ্রমণে গেলে সারা দিন বেড়িয়ে এসে রাতে থাকতে পারেন বন্দর শহর মোংলায়। এখানে আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল পশুর (০৪৬৬২-৭৫১০০)।
সতর্কতা
নৌকায় ভ্রমণের আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বয়া আছে কি না। বনরক্ষী ছাড়া জঙ্গলের ভেতরে ঢুকবেন না। হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রের কোনো প্রাণীকে খাবার দেবেন না। করমজলে বানরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে খাবার লুকিয়ে রাখুন, মোবাইল, ক্যামেরা, ব্যাগ ইত্যাদি শক্ত করে ধরে রাখুন।
[দ্বিতীয় পর্বে থাকছে কটকা, টাইগার টিলা ও হিরণ পয়েন্ট ভ্রমণ]