জেনে নিন কলকাতার ভূতদের ঠিকানা!
ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, ভারতের কলকাতা শহরের বুকে বহু পুরোনো বাড়িতে রাত নামলে সত্যিই নেমে আসে অদ্ভুত নীরবতা। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী একাধিক বড় বড় বাড়িতে এখনো যাঁরা রাতে পাহারায় থাকেন, তাঁরা ওই সব চিহ্নিত জায়গার নাম শুনলেই রীতিমতো ওপরওয়ালার নাম জপতে শুরু করেন।
চলুন জেনে নিই কলকাতার কোন কোন ঐতিহ্যবাহী স্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ভুতুড়ে কাহিনী।
লালবাজার
আপনি বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, কলকাতার খোদ পুলিশি কার্যালয় লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপে ভূত আছে বলে সেখানকার কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময় কলকাতার একজন সমাজবাদী নেতা লালবাজার সেন্ট্রাল লকআপে বন্দি ছিলেন। সেই সময় সময় তিনি দেখতেন একটু রাত হলেই সেন্ট্রাল লকআপের আশপাশে কোনো পুলিশ সদস্য যেতে চাইতেন না। বিষয়টি দেখে তিনি খুব অবাক হয়েছিলেন। পরে তাঁর সহবন্দিদের কাছে তিনি জানতে পারেন, লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপের কাছে নাকি নকশাল নেতা চারু মজুমদারের ভূত আছে।
১৯৭২ সালের ২৮ জুলাই লালবাজার সেন্ট্রাল লকআপে রহস্যজনকভাবে মারা যান চারু মজুমদার। অনেকেই মনে করেন, চারু মজুমদারের মৃত্যু নাকি স্বাভাবিক ছিল না। তার পর থেকে বহুবার খোদ লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপের আশপাশে চারুবাবুর অশরীরী আত্মাকে বহুবার ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। তাই এখনো রাত গভীর হলে কোনো পুলিশ সদস্য পারতপক্ষে ওমুখো হতে চান না। শোনা যায়, রাত গভীর হলেই নাকি সেন্ট্রাল লকআপের আশপাশে চারু মজুমদারের ছায়ামূর্তি দেখা যায়। একবার দেখা দিয়েই মিলিয়ে যান তিনি। সেই সঙ্গে মাঝেমধ্যে শোনা যায় আর্তচিৎকার। ফলে রাত গভীর হলে লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপের ধারেকাছে ঘেঁষেন না কেউই।
জাদুঘর
কলকাতা জাদুঘরের ঠিক পাশেই সদর স্ট্রিটে কয়েকশ বছরের পুরোনো একটা বাংলো ছিল। ওই বাংলোতে ওয়ারেন হেস্টিংসের মেম্বার কাউন্সিলের স্পিকস সাহেব থাকতেন। একদিন বাংলোতে একটি আর্জি নিয়ে দেখা করতে আসেন এক শিখ যুবক। ওই শিখ যুবকের সঙ্গে স্পিকস সাহেবের তীব্র কথাকাটাকাটি হয়। তারপরই রাইফেলে গুলির শব্দ শোনা যায়। মাটিতে লুঠিয়ে পড়ে শিখ যুবকের দেহ। আজও নিশুথি রাতে সেই স্মৃতি ফিরে আসতে দেখেছেন অনেকেই। কথাকাটাকাটি, গুলির শব্দ সবই শোনা যায় এখনো।
আর তাই তো রাত নামলে এখনো জাদুঘরের ওই চত্বরে যান না কেউই। রাতে পাহারায় থাকা প্রহরীরাও জাদুঘরের ওই দিকে ভুলেও পা বাড়ান না। এ ছাড়া শোনা যায়, একবার জাদুঘরের ছাদে স্কাই লাইট পরিষ্কার করতে গিয়ে দুটি শোকেসের মাঝখানে চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছিল এক মজুরের। রাত নামলে দেখা যায় কে যেন প্রতি রাতে কাপড় মুড়ি দিয়ে জাদুঘরের ছাদ থেকে নেমে আসছে।
ন্যাশনাল লাইব্রেরি
কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিকে ঘিরে নানা ধরনের গল্প শোনা যায়। অনেকেই নাকি মাঝরাতে লাইব্রেরির মাঠে এক অশ্বারোহীকে ছুটে যেতে দেখেছেন। ন্যাশনাল লাইব্রেরির বল ডান্সের ফ্লোর থেকে ভেসে আসে কনসার্টের সুর। শোনা যায় পালকি চলার আওয়াজ। এসব ভৌতিক ঘটনাবলির সঙ্গে ইতিহাসের যোগ রয়েছে বলেও বিশ্বাস করেন অনেকে।
১৭৮০ সালের ১৭ আগস্টের সকাল। ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে ফিলিপ ফ্রান্সিসের গুলির লড়াই শুরু হয়। কথিত আছে, এই গুলির লড়াইয়ের নেপথ্যে ছিলেন এক অসামান্য সুন্দরী নারী। তাঁর নাম ম্যাডাম গ্রান্ট। সেই লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ ফ্রান্সিসকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পালকি করে। আর এখানে হেস্টিংস আসতেন ঘোড়ায় চেপে। সেই সব স্মৃতি আজও প্রতি রাতে খণ্ড খণ্ড হয়ে ফিরে আসে বলে ধারণা করা হয়।
কলকাতা করপোরেশন
কলকাতা মিউনিসিপাল করপোরেশন। খোদ ধর্মতলার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ১৯ শতকের এই লালবাড়িটি বহু ইতিহাসের সাক্ষী। তবে রাতের সময়টা এখানে একটু বেশিই থমথমে। রাত নামলেই এখানে শোনা যায় কোনো এক নারীর চাপা স্বরের আওয়াজ। অস্পষ্ট স্বরে কারো সঙ্গে যেন কথা বলেন ওই নারী। পরে শোনা যায় কান্নার আওয়াজ। যদিও সেই নারী আসলে কে তা নিয়ে ইতিহাসের স্মৃতি রোমন্থন করতে পারেননি কেউই। তবে রাত গভীর হলে এখনো যে ওই নারীর অস্তিত্ব পাওয়া যায় তা একবাক্যে মেনে নিয়েছেন অনেকেই। এই ভবনের পেছন দিকে রাতের অন্ধকারে আজও যেতে চান না কোনো নৈশপ্রহরী।
রাইটার্স বিল্ডিং
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য প্রশাসনিক দপ্তর হিসেবে নবান্ন ব্যবহৃত হলেও দীর্ঘদিন ধরে রাইটার্স বিল্ডিং ছিল রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয়। আগামী দিনেও এই রাইটার্স বিল্ডিং যে তার স্বমহিমায় ফিরে আসতে চলেছে তার ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমানে সংস্কারের কাজ চলছে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। কলকাতার অন্যতম এই রাইটার্স বিল্ডিংয়ে রাত নামলে জনশূন্য অলিন্দ যেন হয়ে ওঠে অশরীরীদের আখড়া। একথা স্বীকার করে নেন এখানে রাত কাটানো প্রতিটি নৈশপ্রহরী। জানা যায়, এই রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পাঁচ নম্বর ব্লকটি মোটেই সুবিধার স্থান নয়। রাত নামতেই এখানকার বারান্দা দিয়ে কারা যেন হেঁটে বেড়ায়। দৌড়ে গিয়েও দেখা যায় না কাউকেই। এখানকার ঘরগুলো থেকে শোনা যায় একটানা টাইপের আওয়াজ। দোতলায় কারা যেন ভেসে উঠে মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। ইতিহাস বলছে, এখানেই একসময় ছিল কলাগাছের জঙ্গল। একবার বেশ কয়েকজন ইংরেজকে এখানেই কবর দেওয়া হয়েছিল বলেও জানা যায়। লর্ড ভ্যালেনটিনের তথ্য মতে, ঘোড়ায় টানা গাড়ির খেলা বা ডুয়েল (বন্দুকযুদ্ধ) চলত এই এলাকায়। লেগে থাকত খুন-জখম। এমন বহু ঘটনার কথা আজও এই এলাকায় মুখে মুখে ফেরে। এখানে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনয়-বাদল-দীনেশের হাতে কর্নেল সিমসনের খুন হওয়ার ঘটনাও ফেলে দেওয়া যায় না। সব মিলিয়ে খোদ এই সরকারি দপ্তরটিতে অশরীরীদের অস্তিত্ব আজও অস্বীকার করতে পারেন না কেউই।
আকাশবাণী
কলকাতার পুরোনো ভূতদের বাড়ির মধ্যে এক নম্বর গাস্টিম প্লেস। রেডিওর প্রথম অফিস। পরে অবশ্য আকাশবাণী ভবন হলে দপ্তরটি চলে যায়। কিন্তু পুরোনো এই আকাশবাণী অফিসটিতে ভূতদের দৌরাত্ম্যের কথা আজও অস্বীকার করার সাহস নেই কারো। রাত গভীর হলে অনেকেই দেখেছেন সাহেবের ছায়া উবু হয়ে কাজ করছে। কেউ দেখেছেন, মাঝরাতে এখানকার রেকর্ডিং রুমের বারান্দায় কারা যেন গান শুনছে। নাকি সুরে সুরে গুন গুন করে গানের আওয়াজও শুনেছেন অনেকেই। ফলে ভুতুড়ে এসব ঘটনা এখনো ভুক্তভোগীদের রীতিমতো তাড়া করে ফেরে।