গান কথা গল্প
সব সম্পর্কের ওপরে বন্ধুত্ব : তপু
বরিশাল ক্যাডেট কলেজের বন্ধুদের কাছে ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ছিল যে বালকটি, সে বড় হলো ঠিকই, কিন্তু বড় হয়ে বাবা-মায়ের দেওয়া সার্টিফিকেট নাম ‘রাশেদ উদ্দীন আহমেদ’কে পরিচিত করতে পারল না! অন্তত শ্রোতাদের কাছে নয়! যদিও এসএসসিতে স্ট্যান্ড করে ওই নামটি দিয়ে বাবা-মায়ের মাথা উঁচু করেছিল সে একবার। তবুও লাজুক, নিভৃতচারী এই ছেলেটি যখন যুবক হয়ে উঠল, তখন একটি মেয়ের পায়ের নূপুরের দৃশ্য বর্ণনা করেছিল নিখুঁতভাবে। যেন সে এক চিত্রশিল্পী। লাখো যুবকের মনের কথা এঁকে দিচ্ছে অবলীলায়। পড়ালেখা, চাকরি-বাকরির পাট চুকিয়ে মনের কথা নিজ কলমে আর কণ্ঠে ধারণ করে বড় ভাই আর একমাত্র বোনের আদরের ‘তপু’ এবার তাঁর ডাকনামটাকে ছড়ালেন সর্বত্র। বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে এই তপু এখন পাশের বাড়ির প্রিয় ‘গানবন্ধু’। বলছি এই প্রজন্মের গুণী গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী তপুর কথা। জন্ম ২ জুন, ঢাকায়। বাবার নাম সামসুদ্দীন আহমেদ। মা খালেদা খানম। লাকী আলী, ব্রায়ান এডামস, মাইকেল জ্যাকসন আর অঞ্জন দত্তকে সুরের অনুপ্রেরণা ভাবা এই তপু প্রথমবারের মতো তাঁর গানের জন্মকথা বললেন প্রাণ খুলে, আনন্দচিত্তে। তাঁর এই জনপ্রিয় গানগুলোর জন্ম নেওয়ার গল্প।
একটা গোপন কথা
এই গানটি লেখা হয় ২০০৩ সালে। আমার কোনো গানের কথা আগে হয়েছে আবার কখনো সুর আগে হয়েছে। আবার কোনো সময় দুটোই একসাথে হয়েছে। একটা গোপন কথা গানে গিটারের একটা সিগনেচার প্লাকিং আছে। এই গানটি তৈরির আগে আমি প্রথমে এই গানের প্লাকিংটা বের করি। আর আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম, এমন একটা গান করব যেটার কথাগুলো বেশি হবে এবং সেই কথাগুলো খুব কম সময়ে বলার মতো একটা গান হবে। তারপর আমি থিম নিয়ে চিন্তা করি। মজার বিষয় হলো আমার অধিকাংশ প্রেমের গানই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই লেখা। তখন অনেক বন্ধু ছিল, যারা হয়তো কাউকে পছন্দ করত কিন্তু বলতে পারত না। আবার সে চাইত যে অন্য কারো মাধ্যমে হলেও ওই মেয়েকে জানাতে যে সে তাকে পছন্দ করে। এই গানের বেসিক থিমটা সেখান থেকেই আসে মূলত। এখানে আরেকটা কথা অবশ্যই বলতে চাই, আমি আমার অধিকাংশ গানই নিজে লিখেছি। কিন্তু এই গানটির দুটো লাইন লিখেছিল আমার এক বন্ধু। তার নাম মন্টি। ওর সঙ্গে অনেক সময় একসাথে কাটাতাম। আমি এই গানটির কয়েকটা লাইন লেখার পরে ওকে শুনালাম। ও বলল, ‘অনেক সুন্দর হইছে দোস্ত, তুই এই গানটা শেষ কর।’ আমি বললাম, ‘আমার তো হ্যাং হয়ে আছে। আমি আর কী লিখব বুঝতে পারতেছি না।’ তখন সে পরের দিন আমাকে দুইটা লাইন দিয়ে বলল, ‘দেখ এই দুইটা লাইন যদি ভালো লাগে, তাহলে তুই এড করতে পারিস।’ ওর লেখা দুইটা লাইন ছিল..
‘ভেবেছি তাই এবার, যা কিছু হবে হবার, হোক তবু করে স্বীকার, পরাজয় মেনে নিয়ে, সবকিছু বলে দিয়ে, চাইব আমার অধিকার।’
এইটা লেখার পরে বাকি গানটুকু আমি লিখে ফেলি। তাই বন্ধু মন্টিকে ধন্যবাদ। ওর জন্যই এই গানের পুশটা হয় এবং গানটি আমি শেষ করতে পারি। এই গানের প্রধান সিগনেচার প্লাগটা এবং কর্ডগুলো আমার করা ছিল। পরে এর মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট আমি আর ইমরান নামের এক ছেলে মিলে করেছিলাম। আমরা দুজনই যাত্রী নামের ব্যান্ডটি শুরু করেছিলাম। পরে রাফা এই গানটিকে আমার ‘সে কে?’ নামের একটি একক অ্যালবামের জন্য রিমেক করেছিল।
বন্ধু বুঝে আমাকে
আমি তখন অনেকগুলো গান লিখে ফেলেছি। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যাডেট কলেজের বন্ধুরা মিলে বলল, দোস্ত তুই তো অনেক গান লিখেছিস, এবার বন্ধুত্ব নিয়ে একটা গান লেখ। তখন থেকে আমি এই গানটা লেখার একটা পরিকল্পনা নেই। মাথার মধ্যে সব সময় এটা ঘুরত যে বন্ধুদের নিয়ে গান করতে হবে। তখন আমি চিন্তা করা শুরু করি, বন্ধুত্ব কাকে বলে? এসব প্রশ্ন এমনি এমনি চলে আসত মাথায়। এই গানের প্রথম লাইনটা ছিল, ‘পুরো পৃথিবী একদিকে আর আমি অন্য দিক/ সবাই বলে করছো ভুল আর তোরা বলিস ঠিক।’
আসলে আমি যখন গান করা শুরু করি, তখন আমাকে অনেকেই বিশেষ করে মুরুব্বিরা বলতেন, ‘গান করে কী করবা? এই করে তো ভাত নাই! তো তুমি পড়াশোনা করো ঠিকমতো। চাকরি করো।’ অন্যদিকে আমার বন্ধুরা কিন্তু সব সময় বলছে, ‘দোস্ত তোর গান ভালো হচ্ছে তুই গানটাই কর।’ গানটা করার সময় আমার ওই অনুভবটা ছিল। আমি বিসিএস ক্যাডার হিসেবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম। আমি বাংলাদেশের একটা সর্বোচ্চ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিও করেছি। আমরা বন্ধুরা মিলে হঠাৎ করেই কক্সবাজার, সিলেট চলে যেতাম। যেটা আমি বাবাকে যদি বলতাম, তাহলে উনি পরিকল্পনা করতেন, ছুটি নিতেন তারপর হয়তো বা হতো। কিন্তু বন্ধুদের সাথে হুট করেই সব কিছু হয়ে যায়। অনেক ধরনের সম্পর্ক থাকে মানুষের, যেগুলো ক্ষণিকের, যেগুলো হয়তো স্বার্থসংশ্লিষ্ট না। তারপর কিছু সম্পর্ক বৈধ থাকে, কিছু অবৈধ। অনেকেই বলবে যে বাবা-মায়ের সম্পর্ক সবার উপরে হওয়া উচিত। তারপর ভাইবোনের সম্পর্ক। কিন্তু আমার কাছে সব সম্পর্কের ওপরে মনে হয়েছে ‘বন্ধুত্বটা’ হচ্ছে এক নম্বর। কারণ বাবার সাথে সম্পর্ক আপনার তখনই ভালো হবে, যখন আপনার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে। বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বাবা, মা, ভাই, বোন এবং স্ত্রীর সাথেও হতে পারে। পুরো গানেই আমি এই থিমটা তুলে ধরেছি। এই গানটাকে এখন অনেকেই বন্ধুত্বের অন্যতম একটা গান হিসেবে মনে করে।
রাফা যে কম্পোজিশনটা করেছে তা সুনামের দাবিদার। ও এই গানটা যা চেয়েছে সে অনুযায়ী সেই প্লাকিংটা বাজিয়েছে। গ্রামীণফোন এই গানটা ব্যবহার করেছে। একটা ব্যাপার ছিল যে, একটা মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে বাইরে কাজ করাটা স্বভাবতই ভালো চোখে দেখা হয় না। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা বেশে ভালো লেগেছিল যে, আমি গ্রামীণফোনের চাকরিটা ছাড়ার পরপরই তারা আমার এই গানটি তাদের বন্ধু প্যাকেজে ব্যবহার করে।
ভাঙা বারান্দা
গানটি আমার প্রথম গান। গানটি আমি এসএসসি পরীক্ষার পরে লিখি। ১৯৯৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় যশোর বোর্ডে আমি ১৩তম স্ট্যান্ড করেছিলাম। আমার বাবা তখন খুব খুশি হয়ে একটা গিটার উপহার দিয়েছিলেন। তখন আমি তিনটা কর্ড জানতাম। ‘জি’ ‘ডি’ আর ‘সি’। আর এই তিনটা কর্ড দিয়েই এই গানটি করেছিলাম এবং এই কর্ড অনুযায়ীই গানের সুরগুলো বসানো হয়েছিল। তখন আমার এই ভাবনাগুলো আসত, এখন কেউ মাঘ, বৈশাখ জানে না, মার্চ আর জুন চেনে। তখন আমার অনুভব হতো, অনেকের অনেক টাকা-পয়সা আছে, গাড়ি আছে। তখন আমার বাবা আর্মি অফিসার ছিলেন। টাকা-পয়সা ছিল না তাঁর। কিন্তু আমার অনুভব হতো, আমার তো সাইকেল আছে, কেন গাড়ির আশায় সারা জীবনটা নষ্ট করব? সাইকেল দিয়েই তো আমি যেতে পারছি। ওই চিন্তাগুলো আমি এই গানে রিফ্লেক্ট করেছি। এইগানে বন্ধুত্বের একটা কথা আছে এ রকম- যাদের মনে যত প্যাচ আছে বা যাদের চিন্তাভাবনা সরল না, তারাই দেখা যাচ্ছে কারো বন্ধু হচ্ছে। কিন্তু সরল মানুষটারই হয়তো আমার বন্ধু হওয়া উচিত ছিল। কারণ সে সত্য কথা বলবে, আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দেবে। অথচ যে আমার তোষামোদি করছে বা যে চটুল কথা বলছে তাকে কাছে টানা হচ্ছে। অনেক বন্ধুকে পছন্দ হতো, কাউকে হতো না। এই কথাগুলোই গানের মধ্যে বলার চেষ্টা করেছি।
এখনো যখন এই গানটি শুনি বা পড়ি, তখন আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই যে এই গানটা আমি অল্প বয়সে লিখেছিলাম! এই ব্যাপারটা বিশেষত এই গানটির জন্য অনুভব হয়। অন্য গানগুলোর জন্য আসে না। আমার মনে হয় এখন আর ওই কথাগুলোর মতো করে এভাবে চিন্তা করে লিখতে পারি না। কারণ ওই ছোট্ট সময়ে জানি না কী চিন্তা এসেছিল আমার মাথায়, কথাগুলো আমার কাছে এখনো মনে হয় অনেক সমৃদ্ধ। এটা বলা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু আমি আমার ইমোশন থেকে বলছি, মাঝে মাঝে আমি নিজেই এই গানের কথাগুলো পড়ে মুগ্ধ হই। ওই সময় আমি আসলে খুবই ইন্ট্রোভার্ট এক ছেলে ছিলাম। সবাই দুষ্টুমি করছে কিন্তু আমি হয়তো তেমন দুষ্টুমি করতে পারতাম না। চাইতাম, ভালো লাগত দুষ্টুমি দেখতে, কিন্তু করতে পারতাম না। তবে আমি যেটা করতাম, সেটা হলো আমি সব সময় চিন্তা করতাম যে কী হচ্ছে আশপাশে, এগুলো যদি কোনোভাবে বলতে পারতাম তাহলে ভালো হতো। তখন মনে হতো, গানের মধ্য দিয়ে বলা হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর একটা মাধ্যম। যেটা মানুষের মনে ঢুকে যায়।
সোনার মেয়ে, তোমায় দিলাম ভুবনডাঙার হাসি
আমি কিন্তু অন্য কারো কথা-সুরে গান করি নাই। এই গানটাই আমার একমাত্র গান যেটা আমার লেখা এবং সুর করা না। প্রিন্স মাহমুদ ভাইয়ের কথা এবং সুর। আমি সব সময় নিজে লিখেছি, নিজে সুর করেছি। প্রিন্স ভাইদের গান শুনেই তো বড় হয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড টেলেন্টেড মিউজিশিয়ান প্রিন্স মাহমুদ ভাই। যার রেটিং আরো উপরে হওয়া উচিত ছিল। কারণ উনি যেসব গান করেছেন, এটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করার মতো। আমাকে যখন জি সিরিজের খালেদ ভাই বললেন, ‘তুমি প্রিন্স মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করো। যেহেতু তুমি অন্য কারো সাথে গান করো নাই। কিন্তু ওনার সাথে অন্তত একটা গান করো।’ আমি চোখ বন্ধ করে রাজি হওয়া যাকে বলে, তাই হলাম। আর প্রিন্স ভাইয়ের একটা ব্যাপার হলো যে, তাঁর যদি শিল্পী পছন্দ না হয় তাহলে কিন্তু গান করান না। প্রিন্স ভাই আমাকে অনেক বেশি পছন্দ করেন বলে মনে হয়েছে এবং তিনি খুব যত্ন করে এই গানটা তৈরি করে আমাকে বলেছিলেন, ‘তপু, এই গানটা আমি চাই যে তুমি করো।’ আর গানটা প্রথম শুনেই আমার খুবই ভালো লাগে। সব সময় শিল্পী এবং সংগীত পরিচালকের মধ্যে সিংক হতে হয়। আমার আর ওনার মধ্যে এই জিনিসটা হয়েছিল। এরপর তো এই গানটি শ্রোতারা দারুণভাবে নিয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর একটা গান। আমার সাথে ন্যান্সি গানটি চমৎকার গেয়েছে। আমার বিশ্বাস এই গানটি অনেকদিন বেঁচে থাকবে।
মানুষ মাত্রই ভুল
আমার বন্ধুদের তুলনায় আমার পরে বিয়ে হয়েছে। আমার এই ছোট্ট জীবনে আমার চারজন বন্ধুর ডিভোর্স দেখেছি, আরো ২০-২৫ জনের ব্রেকআপ দেখেছি। এগুলোর পর তাদের জীবন কীভাবে পরিবর্তন হয়েছে, কীভাবে একটা ছেলে তার ট্রেক হারিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে তা দেখেছি। অনুভব করেছি যদিও পার্থক্য করা ঠিক না, একটা নারীর জন্য এক বন্ধু জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। যেটা করা একদম কাপুরুষের কাজ। তাদের পরামর্শ দিতেই আমি এ গান গেয়েছি। বিয়ের আগে মেয়ে এবং ছেলে উভয়কেই পরস্পরকে ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত। কারণ একটা মেয়েকে যখন পছন্দ করা হবে, দেখে নিতে হবে সে তোমার লেভেলের শিক্ষিত কি না। এই শিক্ষাটা লেখাপড়ায় না, মানসিকভাবে মিল আছে কি না! তার সাথে মানসিক যোগাযোগটা ঠিক হচ্ছে কি না, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় একটা মেয়ের নাক, চোখ, মুখ চেহারা ভালো লাগছে, কিন্তু একসময় এর কোনো কিছুই আর হৃদয়স্পর্শ করবে না। পরে যদি মানসিক যোগাযোগটাই ঠিক না থাকে, তাহলে সব গুড়েবালি। এই বিষয়গুলো নিয়ে এই গানের থিমটা সাজিয়েছি। আমি মনে করি Offense is the best defence তাই নিজেকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেই এই গানটি লিখেছি, যে মানুষ মাত্রই ভুল, আমিও মানুষ।
একপায়ে নূপুর তোমার অন্য পা খালি
আমি যখন কোনো গান লিখি, তখন আমার সামনে একটা ছবি চিন্তা করার চেষ্টা করি। কিন্তু এক পায়ে নূপুর আমি দেখেছি। জীবনে কোনোকিছুই মৌলিক না। আমি একটা মেয়ের পায়ে দড়িবাঁধা একটা নূপুরের মতো দেখেছিলাম এবং এটা কারো পায়ে আর দেখি নাই। তার পাগুলো অনেক সুন্দর ছিল। আমার ওই দৃশ্যটা চোখে লেগে ছিল। তারপর আমি ওই দৃশ্যের সাথে সাগরের কথা চিন্তা করলাম। চিন্তা করলাম, একটা ছেলে খুব সাধারণভাবে একটা মেয়েকে ভালোবাসার কথা বলছে। সেই ছেলেটি কি বলতে পারে? আমি নিজেকে সব সময় অসহায় মনে করতাম। কারণ আমি মেয়েদের সাথে অত কমফোর্টেবল ছিলাম না। আমি নিজে অসহায়। কোনো চাকরি বাকরি তো তখন চিন্তায় নাই। একটা মেয়েকে আমি কী উপহার দেব? আমার হাতখরচ খুব কম ছিল। তখন ওই থিমটাই আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যে, আমার কিছুই নাই, একজন ভালো বন্ধু হিসেবে থাকতে পারবে তো? আমার নৌকাটাও ছোট, তো তুমি যদি নৌকায় আসতে চাও তাহলে স্বাগত জানাচ্ছি। আমি শুধুমাত্র ভালোবাসা দিতে পারব। শুধু ভালোবাসা যারা দিতে পারবে তাদের জন্যই এই গানটি করেছি।
এই নূপুর গানটি আমার অ্যালবাম হিসেবে প্রথম প্রকাশ হওয়া গান। ব্লাক ব্যান্ডের ড্রামার টনি ভাই তখন ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম করছিলেন। আমি অনেকদিন ধরে তাঁকে বলছিলাম ভাইয়া আমি তো গান করি, যদি কোনো সময় মনে হয় আমাকে ডাকবেন। তো ওই ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম করার সময় টনি ভাই আমাকে বললেন, ‘তপু আমার তো ব্যান্ড মিক্স কিন্তু তুমি তো সোলো আর্টিস্ট। তো তুমি একটা ব্যান্ড ফর্ম করে এই গানটা জমা দাও।’ এভাবেই আমাদের যাত্রী ব্যান্ডের শুরু হয়। তখন আমার লেখা ও সুর করা ‘এক পায়ে নূপুর’ গানটি করা ছিল। টনি ভাই আমার এই গানটাতে ড্রামস প্লে করেছিলেন। আরো মজার একটা তথ্য দিই, এই গানের একটা জায়গায় ‘চাঁদের আলো আজ যদি ভালো লাগে’ এই লাইনটি টনি ভাইয়ের কণ্ঠে ছিল এবং আমি গানটা নিয়ে এতই কেয়ারলেস ছিলাম যে, টনি ভাইকে বলেছিলাম, ‘আপনি এই দুটি লাইন গেয়ে দিন। আপনার একটা সিগনেচার থাকল আবার পরে কবে গান করি এর তো ঠিক নাই।’ এভাবেই রেকর্ড হয়েছে, বন্ধুদের ধরে, ভাই একটু গিটার বাজিয়ে দাও। ভাই একটু কিবোর্ড বাজিয়ে দাও। এভাবে ধরে ধরে করা হয়েছে। একদমই সিরিয়াস ছিলাম না। গান করব, আমার গান মানুষ শুনবে, অ্যালবাম বের করব ভাবিনি। এই গানের পরে এখনো অনেকে এক পায়ে নূপুর পরে এবং ওই স্টাইলটা স্ট্যাবলিশড হয়ে যায়।
আমি এই গান করার পর আর গান করব না ভেবেছি। কারণ এসএসসিতে স্ট্যান্ড করেছি কিন্তু কিছু মার্কসের জন্য এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করি নাই। এই একটা দুঃখ ছিল। বাবা বললেন, ‘তোমাকে নিয়ে আমার এত আশা, তুমি স্ট্যান্ড করলে না?’ এই গানটি যখন আমি লিখি, তখন আমি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড কিংবা থার্ড সেমিস্টারে পড়ি। তখন আমি পড়াশোনায় খুব সময় দিচ্ছি। বাবা অত গান শুনতেন না। তখন এফএম রেডিওগুলো এসেছে মাত্র। তো একদিন আমি বাবার সাথে গাড়িতে যাচ্ছি, এমন সময় এফএম-এ হঠাৎ আমার ‘এক পায়ে নূপুর’ গানটি বেজে উঠল। আমার এই গান শুনে বাবার মুখের যে অভিব্যক্তি এইটা আমি আর জীবনেও ভুলব না। বাবা যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। সাথে সাথে বাবা তাঁর যত বন্ধুবান্ধব সবাইকে ফোন করে বলতে লাগলেন, ‘এই জানিস আমার ছেলের গান রেডিওতে শোনা যাইতেছে।’ আর এটাই ছিল একটা টার্নিং পয়েন্ট, বাবা তখন বললেন, ‘তোমার মন যা চায়, তুমি শতভাগ মনোযোগ দিয়ে তাই করো।’
আমার যত অ্যালবাম বের হয়েছে সব হচ্ছে ব্যান্ড যাত্রীর নামে। আমার নিজের নামে বা একক কোনো অ্যালবাম বের হয়নি। এর মধ্যে ফুয়াদ ভাই বিদেশ থেকে এসেছেন। ফুয়াদ ভাই তখন বিভিন্ন শিল্পীদের নিয়ে একট প্রজেক্ট করছিলেন। আনিলা ওনার বন্ধু। আমি তখন আমার একক ক্যারিয়ার শুরু করার পরিকল্পনা করছি। তখন আমি আনিলা আপুকে বলি যে ‘আমার এক পায়ে নূপুর গানটি আরো কীভাবে সুন্দর করা যায়?’ তখন আনিলা আপু ফুয়াদ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরে আমি আনিলা আপুর সাথে বসে গানের কথা কিছু কিছু পরিবর্তন করলাম। ফুয়াদ ভাই খুব সুন্দরভাবে মিউজিকটা করলেন। পরে আমার প্রথম একক অ্যালবাম ‘বন্ধু হবে কি’তে আনিলা আপুর সাথে ‘এক পায়ে নূপুর’ গানটা আরো আমাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিল।
মন ভালো নেই
এই গানটা আমার খুব প্রিয় একটা গান। কিন্তু এইটা খুব একটা হিট করেনি। কিন্তু অনেক মানুষের অন্তরে আছে। এইটা একটা মিক্সড অ্যালবামের গান ছিল। গানটার থিমটা হচ্ছে একটা ছেলে মারা গেছে। তারপরও ওই ছেলের প্রেমিকা মেয়েটি তাকে দেখতে পায়- ছেলেটি স্বর্গে থাকুক আর চাঁদে থাকুক- ওইখান থেকে ভালোবাসার মানুষটাকে দেখছে। কিন্তু ছেলেটার কথা মেয়েটা শুনতে পাচ্ছে না।
তো আমি একবার অস্ট্রেলিয়া গেলাম শো করতে, যে অর্গানাইজার ছিল সে জানাল, একটা ছেলে আমার যাওয়ার কথা শুনে প্রতিদিন তাকে অনুরোধ করে যেন আমি তার বাসায় একবার হলেও যাই। শো শেষ করে ফিরে আসার তিন-চারদিন আগে বললাম, চলেন আপনার ওই ছেলেটার সাথে দেখা করে আসি। তো সেই ছেলে তার বাসায় আমি যাব শুনে তার সব বন্ধুদের ডেকে এনেছে। অনেক খাবার-দাবারের আয়োজন করে। আমি ওদের সঙ্গে অনেক গল্পটল্প করলাম, গান শুনালাম। একপর্যায়ে ওই ছেলে আমাকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে বলে, তার একটা মেয়ের সাথে ১০ বছরের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের কথাও ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মেয়েটি তাকে বলে যে, সে সম্পর্ক রাখবে না। এই কথা শুনে ছেলেটি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে অনলাইনে তার এক বন্ধুর সাথে বিষয়টি শেয়ার করল। বন্ধুটি ওই ছেলেকে আত্মহত্যা না করার জন্য কোনোভাবেই মানাতে না পেরে আমার ‘মন ভালো নেই’ গানটির লিংক পাঠিয়ে বলে, ‘তোকে একটা গান দেই গানটা শোন, তারপর তুই যা ইচ্ছা তাই কর।’ পরে আমার এই গানটি টানা দুদিন শুনে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ছেলেটি। ছেলেটি ভেবেছিল তার মতো আমিও বোধহয় প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি। তো এই কষ্ট নিয়ে যদি পৃথিবীতে অন্য কেউ বেঁচে থাকে তাহলে সে বাঁচবে না কেন? আমার ‘মন ভালো নেই’ গান শুনে এই ভাবনাটাই তাকে আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। এটা ভাবলেই আমার সংগীত জীবনটা ধন্য মনে হয়।
মেয়ে তুমি এখনো আমায় বন্ধু ভাব কি
এই গান একটা নির্দিষ্ট বয়সের ছেলেমেয়েরা খুবই শোনে। তাদের ভালো লাগে। গানটি লেখার একটা মজার ইতিহাস আছে। আসলে আমার জীবনে নারী সংস্পর্শ খুবই কম। কো-এডুকেশনে পড়িনি। আমি বরিশাল ক্যাডেট কলেজে ছিলাম। তারপর কলেজ জীবন শেষে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আসি, তখন দেখি যে হঠাৎ করে মেয়েবন্ধু বেশি হয়ে গেছে! তখন দেখতাম, মেয়েরা খুব সেজেগুজে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত। আমি আবার ঢোলাঢালা কাপড় পরেই বিশ্ববিদ্যায়ে চলে যেতাম। সত্যি কথা বলতে কি, আসলে মেয়েদের ইমপ্রেস করার মতো আমার মধ্যে কিছু ছিল না। চুলও কম। লম্বাও তেমন না। না বাবার অনেক টাকা আছে, যে টাকা ওড়াচ্ছি। কিছুই ছিল না। কিন্তু পড়াশোনায় খুব সিরিয়াস ছিলাম। আমি ছোটবেলা থেকেই গণিতে খুবই ভালো ছিলাম। যেহেতু আমাদের সহপাঠীদের অধিকাংশ মেয়েরা গণিতে খুব দুর্বল ছিল। ওই একটাই রাস্তা ছিল যে, মেয়েরা আমার কাছে আসতে পারে। ওই গণিত বোঝাবুঝির হাত ধরেই প্রথম আমার নারীদের সংস্পর্শে আসা। আর যেহেতু আমি মেয়েদের সাথে তেমন মিশতাম না, এই সংস্পর্শটাই আমার মধ্যে এক ধরনের ভাবনা জাগাল। ওরা কি শুধুই গণিত বুঝতেই আসত, না অন্যকিছু? এই প্রশ্নটাও মনে আসছিল বারবার। কিন্তু পরে শুধু গণিত বুঝতেই আসত বলে মনে হতো। অন্যকিছু না। মেয়েরা বুঝে চলে যেত। অন্য বন্ধুরাও মেয়েদের গণিত বা কিছু না কিছু বোঝাত। কিন্তু মেয়েরা ওই সব বুঝেই চলে যেত। তো এসব কথা এবং নিজের কথা চিন্তা করেই এই গানটি আমি লিখি। মেয়ে তুমি এখনো আমায় বন্ধু ভাব কি? কখনো কি আমায় ভেবেছিলে বন্ধুর চেয়ে একটু বেশি।