‘চামড়া শিল্পে ফিউচার প্রুফ সোর্সিং ডেস্টিনেশন বাংলাদেশ’

Looks like you've blocked notifications!
গত ৩০ অক্টোবর চামড়া শিল্পের প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি : ফোকাস বাংলা

বিশ্বব্যাপী চামড়ার বাজারে বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ সম্ভবনাময় দেশ হিসেবে তুলে ধরতে এবং বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে ঢাকায় হয়ে গেলো তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদারগুডস ইন্টারন্যাশনাল সোর্সিং শো (ব্লিস)-২০১৯। ব্লিস-এর তৃতীয় সংস্করণের এবারের মূল বিষয় ছিলো : ‘ফিউচার প্রুফ সোর্সিং!’। এবারের প্রদর্শনীতে ফিউচার প্রুফ সোর্সিং সমাধান হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গল্প, প্রযুক্তি এবং অভিযোজনযোগ্যতা, স্থায়িত্বের দিকে অগ্রযাত্রা ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা এই চারটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এবারের প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়েছিল।

এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে এই শিল্পখাতের ক্রেতা, বিশ্ববাজারের খুচরা ক্রেতা এবং আন্তর্জাতিক সোর্সিং এজেন্টদের একই ছাদের নিচে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে, ফলে তাঁরা সরাসরি স্থানীয় উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন এবং বাংলাদেশকে এ খাতের একটি সোর্সিং হাব হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।

গত ৩০ অক্টোবর এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় বাংলাদেশ লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদারগুডসের উৎপাদক ও রপ্তানিকারকরা তাদের পণ্য দিয়ে বিআইসিসিতে সাজানো একটি প্যাভিলিয়ন প্রধানমন্ত্রী পরিদর্শন করেন। এ সময়ে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক্সপোর্ট কমপিটিটিভনেস ফর জবস প্রকল্পের ম্যাচিং গ্র্যান্ট উদ্বোধন করেন এবং পাশাপাশি আইএফসির অর্থায়নে বাংলাদেশ লেদার সেক্টরের জন্য তৈরিকৃত কমপ্লায়েন্সের জন্য ই-মডিউল উদ্বোধন করেন।

বাংলাদেশ বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডস ও ক্রেতাদের জন্য ফিউচার প্রুফ সোর্সিংয়ের গন্তব্য হতে পারে, যদি সরকার ও নীতিনির্ধারকরা এ খাতের অপার সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবিকভাবে প্রয়োগযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করে। এই প্রদর্শনীতে ৩০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও ব্র্যান্ড প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ, মধ্য-ব্যবস্থাপনায় নারীর ক্ষমতায়ন, টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন, ব্র্যান্ডিংয়ের সুযোগগুলো নিয়ে প্রদর্শনীর পাশাপাশি তিনটি ব্রেকআউট সেশন পরিচালনা করা হয়েছিলো।

ব্রেকআউট সেশনগুলোর প্যানেল ডিসকাশনে ছিলেন এলএফএমইএবি ও পিকার্ড বাংলাদেশ লিমিটেডের সভাপতি সায়ফুল ইসলাম, ইন্ডিয়ান সু ফেডারেশনের সভাপতি ভি. মুথুকুমারান, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর এবং বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক। এ ছাড়া প্যানেল ডিসকাশনে এই খাতের সংশ্লিষ্ট আরো অনেক প্রতিধিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন মুল্য, ক্রমবর্ধমান কমপ্লায়েন্স প্রাকটিস, দক্ষ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, ইউরোপ ও চীনা বাজারে বাণিজ্য অগ্রাধিকারের কারণে বাংলাদেশ, চীন, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ায় শিল্প স্থাপনের তুলনায় বাংলাদেশ সারা বিশ্বের চামড়ার বাজারে প্রতিযোগিতামূলক জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।

এই প্রদর্শনীটি বাংলাদেশের লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদারগুডস শিল্পখাতের সংশ্লিষ্ট সকলকে তথ্য, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আদান-প্রদানে সহায়তা করেছে। প্রদর্শনীতে ছিলো বাংলাদেশ থেকে উৎপাদিত আধুনিক ফ্যাশনের জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের সমাহার। জেন্টস, লেডিস ও কিডস সুজ, চামড়ার তৈরি ব্যাগ, ম্যানিব্যাগ, সুটকেস, ট্র্যাভেল ব্যাগ, বেল্ট, গ্লোভস ছাড়াও আরো বৈচিত্র্যময় পণ্য সামগ্রী প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডস, আন্তর্জাতিক ক্রেতা, ডিজাইনার, ফ্যাশন এক্সপার্টস, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, সোর্সিং এজেন্ট, রিটেইল চেইন, পরিবেশক, সম্ভাব্য বিদেশি এবং স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা।

বাংলাদেশ থেকে তৈরি এবং উৎপাদিত রপ্তানিমুখী পণ্যগুলো প্রদর্শন করার জন্য ১০টি প্যাভেলিয়ন ও ৩০টি বুথ ছিল। পণ্য প্রদর্শন করেছেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য স্থানীয় ও বৈদেশিক পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়িত এক্সপোর্ট কম্পেটিটিভনেস ফর জবস প্রকল্পের সহায়তায় ১০টি এসএমই প্রতিষ্ঠান এবারের প্রদর্শনীতে পণ্য প্রদর্শন করেছে। একটি নতুন ধরনের সোর্সিং সল্যুয়েশন অভিজ্ঞতা প্রদান, নেটওয়ার্কিং ইভেন্টস ও ব্যবসায়িক সহযোগিতা বাড়াতে সরাসরি ফ্যাক্টরি ভিজিটের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা খাতের সম্ভাবনা, ব্লিস-এ অংশগ্রহণকারী এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে তুলে ধরতে, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আইএফসির সহায়তায় মাসব্যাপী প্রচার এবং ডিজিটাল ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়েছে।

লেদার গুডস এবং পাদুকা শিল্পে অধিক শ্রম ও শক্তির প্রয়োজন, এই খাতে বর্তমানে ৬০ ভাগের বেশি নারী কর্মী রয়েছেন। বর্তমানে এই শিল্পে প্রায় দুই লাখ কর্মী নিযুক্ত রয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো কয়েক লক্ষ কর্মী নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে চামড়া শিল্প প্রায় ২২০টি ট্যানারি, সাড়ে তিন হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান, প্রায় ৯০টি বড় সংস্থা এবং ১৫টি বড় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশে বছরে ৩১০ মিলিয়ন বর্গফুট চামড়ার কাঁচামাল উৎপাদিত হয় যার মধ্যে ১.৮ ভাগ গবাদি পশু এবং ৩.৭ ভাগ ছাগল থাকে। বাংলাদেশে প্রায় ৭৬ ভাগ ট্যানারি রপ্তানিমুখী। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ১ বিলিয়নের বেশি এবং এটি আরএমজির পরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত হিসাবে তৈরি হয়েছে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশের পাদুকা শিল্পের তথ্য (উৎস : ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যার ইয়ারবুক-২০১৯) গত এক দশকে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের রপ্তানি ৫০০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ উৎপাদনে বিশ্বে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেছে এবং বিশ্বব্যাপী রপ্তানিতে ২০তম স্থান অর্জন করেছে।

বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে এবং ইউরোপিয় ইউনিয়ন ছাড়াও আরো ১০টি দেশে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া শিল্পে রপ্তানি আয় রেকর্ড ১০১৯.৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে অন্যান্য পাদুকা (চামড়াবিহীন) শিল্পের রপ্তানি আয় ১১.২৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে তৈরি পোশাক উৎপাদনের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য সরবরাহের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল গন্তব্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২২ সালের মধ্যে এই খাত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করা সম্ভব হবে।