লাখপতির গল্প
পিনন-পণ্য বিক্রি করে লাখপতি রাঙামাটির ‘জলপরী’ কানিজ
রাঙামাটির মেয়ে সুলতানা কানিজ। যদিও তিনি ঢাকায় থাকেন। তাঁর অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের নাম ‘জলপরী’। চাকমা নারীর পোশাক পিনন দিয়ে তৈরি নানা পণ্য বিক্রি করে এরই মধ্যে লাখপতি বনে গেছেন কানিজ। এ সেক্টরে কাজ করছেন সাড়ে চার বছর। আর কিছুদিন পরেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। তাই বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন এ উদ্যোক্তা।
সম্প্রতি সুলতানা কানিজের সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। জানান তাঁর উদ্যোক্তা-জীবনের কথা। কী কী পণ্য নিয়ে কাজ করছেন? এনটিভি অনলাইনের এমন প্রশ্নের জবাবে সুলতানা কানিজ বলেন, ‘চাকমা নারীদের পোশাক পিনন দিয়ে তৈরি পিনন ল্যাপটপ ব্যাগ, পিনন ব্যাগপ্যাক, গহনার বাক্স, কুশন কাভার, পিনন হ্যান্ডপেইন্ট শাড়ি ও জামদানি শাল নিয়ে কাজ করছি। আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি।’
ঈদ ঘিরে কেমন পরিকল্পনা ছিল? সুলতানা কানিজ বলেন, ‘যেকোনো প্রোগ্রাম সামনে থাকলে পণ্য বিক্রি স্বাভাবিকের তুলনায় বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আমার পণ্যের ক্ষেত্রেও তাই। সামনে ঈদ। সাধারণ পিনন শাড়ির পাশাপাশি থাকছে ব্লক করা পিনন শাড়ি। পিনন শাড়িতে হ্যান্ডপেইন্টের কাজ করছি। পাশাপাশি ফুল সিল্ক পিনন শাড়ি। জলপরীর পেজে এসব পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।’
উদ্যোক্তা হতে পেরে কেমন লাগছে আর এ কাজে আপনার অনুপ্রেরণা কারা ছিল? সুলতানা কানিজের উত্তর, ‘বাবা-মা স্বপ্ন দেখত মেয়ে ডাক্তার হবে। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। পরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হই। নামের আগে ইঞ্জিনিয়ার শব্দ থাকবে। ভালো লাগবে। এটাই চেয়েছিলাম। পরে শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। ব্র্যাক ব্যাংকে জব করতাম। সাত বছর জব করার পর ছাড়তে হলো মেয়েকে দেখার কেউ ছিল না বলে। তারপর তো শুরু হলো নতুন জীবন। শুরু করলাম অনলাইন বিজনেস। মনের ভেতরে একটা সুপ্ত বাসনা ছিল মানুষের উপকার করা। মানুষ আমার কোনো একটা কাজে উপকৃত হবে, আনন্দ পাবে। সেটা মনে হয় আমি পেয়েছি এই উদ্যোক্তা-জীবনে। আমার প্রোডাক্টগুলো দিয়ে মানুষের ছোট ছোট আনন্দ দেখতে পেয়েছি, অনুভব করতে পেরেছি। যখন তারা বলে আপনার প্রোডাক্ট খুব ভালো, ভীষণ কাজের। ভীষণ ভালো লাগা কাজ করে। আমার ভেতরের স্বপ্নটা উদ্যোক্তা হয়ে পূরণ হচ্ছে। অনুপ্রেরণার কথা বললে প্রথমে আমি উপমাদির কথা বলব। উপমাদিকে দেখতাম নিজের হাতে বিভিন্ন ডিজাইন করা কুর্তি বানিয়ে সেল করছে, ভালো লাগত। আমি চাইতাম এমন কিছু করব। এরপর সুলতানা খুকি, আমার ননাশ; তিনি জবের পাশাপাশি বিজনেস করেন। এগুলো দেখেই অনুপ্রেরণা পাই।’
পরিবার থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন? সুলতানা কানিজ বলেন, ‘প্রথম দিকে বাবা-মা থেকে সেভাবে সাপোর্ট না পেলেও হাজব্যান্ড আর শ্বশুরবাড়ি থেকে সব সময়ই ফুল সাপোর্ট পেয়ে এসেছি। বিশেষ করে আমার ননাশ সুলতানা খুকি এ ব্যাপারে ভীষণ কড়া। যা-ই করি না কেন, বিজনেস ছাড়া যাবে না।’
কানিজের উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম বা উই-এর ফেসবুক গ্রুপের ভূমিকা অনেক। এ প্রসঙ্গ তুললে তিনি বলেন, ‘উই দেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম। কৃতজ্ঞতা নাসিমা আক্তার নিশা আপুকে, উই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন বলে নারীদের স্বপ্নগুলো পূরণ হচ্ছে। কৃতজ্ঞতা রাজিব আহমেদ স্যারের প্রতি। স্যারের পরামর্শ পেয়ে আমার মতো অনেক নারীর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বা হচ্ছে। উই-এর সদস্য হিসেবে থাকতে পেরে আমি নিজেকে নিয়ে গর্ব বোধ করি। উই-এর মাধ্যমে অনেক দেশি পণ্য আমরা চিনতে পারছি, কিনতে পারছি। বিলুপ্তপ্রায় পণ্যগুলো আবার দেখতে পাচ্ছি। হাজার হাজার নারী এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দেশি পণ্যকে প্রচার করে সংসারে অবদান রাখছে। উই-এর কারণে আজ অনেক নারী স্বাবলম্বী। কোভিডে একমাত্র উই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনেক নারী সংসার চালাচ্ছে। আসলে উই সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না।’
সুলতানা কানিজ আরও বলেন, ‘আমার সবগুলো প্রোডাক্ট দেশি। আমি আমার প্রোডাক্ট সম্পর্কে জানি, প্রোডাক্টের মানের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ করি না। তাছাড়া প্রোডাক্ট হাতে পাওয়ার পর কোনো সমস্যা থাকলে সেই প্রোডাক্ট চেঞ্জ করতে পারে বা প্রোডাক্ট রাখতে না চাইলে আমি ব্যাক করতে বলি সব সময়।’
সুলতানা কানিজ অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন ২০১৭ সালে। আর উদ্যোক্তা-জীবনের শুরু ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে। উই থেকে এ পর্যন্ত তাঁর বিক্রি এক লাখ ৭০ হাজার টাকা। কারিগর-তাঁতিসহ ছয় জন কাজ করছেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে।
এ উদ্যোক্তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ‘আমার পিনন দিয়ে তৈরি প্রোডাক্টগুলো দেশের প্রতিটা জেলায় পৌঁছানোর পাশাপাশি দেশের বাইরে যাবে, এটা আশা করি। আর পিনন শাড়িকে সবাই জানবে-চিনবে। প্রতিটা মেয়ে তার শাড়ির কালেকশনে পিনন শাড়ি রাখবে, এ প্রত্যাশা করি।’ সুলতানা কানিজের সেই প্রত্যাশা পূরণ হোক, এ কামনা সবার।