প্রাণহীন সাভারের ট্যানারি পল্লী

Looks like you've blocked notifications!

সীমিত পরিসরে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া আসা শুরু হয়েছে ঢাকার সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে প্রায় থমকে গেছে এখানকার শিল্প-কারখানা। এর বাইরে চামড়ার দর পড়ে যাওয়ায় কার্যত প্রাণহীন হয়ে পড়েছে চামড়া শিল্পাঞ্চলখ্যাত সাভারের ট্যানারি পল্লী।

চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিয়ে এবারও ক্ষোভের অন্ত ছিল না মৌসুমি ও ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের। তারা বলছেন, চামড়ার দরপতনের কারণে অন্যান্য বারের তুলনায় এবার পাড়া-মহল্লাগুলোতেও তেমন হাকডাক ছিল না মৌসুমি চামড়া সংগ্রহকারীদের।

আশানুরূপ চাহিদা না থাকায় মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোর পক্ষ থেকে সংগ্রহ করা অনেক চামড়া সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন চামড়া সংগ্রহকারীরা। শেষপর্যায়ে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে বিনামূল্যেও চামড়া তুলে দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেছেন, চামড়ার দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাদের কোনো হাত নেই। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভর করে সরকার দাম নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এবার বাজার নাজুক হয়ে পড়ায় এমনিতেই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এই শিল্প।

ট্যানারি শিল্প ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ ট্যানারিতে এখনো শুরু হয়নি কর্মচাঞ্চল্য। বেশ কয়েকটি ট্যানারি কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগেই কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে তা নিজেরাই প্রক্রিয়াজাতের কাজ শুরু করেছে।

মূলত সারাদেশ থেকে চামড়া ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ করে প্রথমে তা তোলেন নিজস্ব আড়তে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষ করে পরে তা পাঠানো হয় চামড়া শিল্পনগরীতে।

এদিকে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ট্যানারি মালিকদের কাছে আগের বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া থাকায় তাদের হাতে পুনরায় চামড়া তুলে দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না অনেকেই।

গতবারের অভিজ্ঞতায় চাহিদা না থাকায় পচে-গলে নষ্ট হয়েছে বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া।

সেই বিষয়টি মাথায় রেখে ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করে দীর্ঘ ৩১ বছর পর এবার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।

এমন সম্ভাবনা মাথায় রেখে চামড়া লবণজাত করলেও সরকারি নির্দেশ মেনে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অপেক্ষায় রয়েছেন ব্যবসায়ীদের অনেকেই। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে স্বাভাবিকভাবেই চামড়া সরবরাহও কমে যাবে।

সাভার চামড়া শিল্পনগরীর ১২৫টি ট্যানারি উৎপাদনে গেলেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) এখনও পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় ট্যানারি মালিকদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না চামড়া খাত দেখভাল ও গবেষণায় নিয়োজিত আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও বিভিন্ন সংস্থা।

এমন পরিস্থিতিতে চামড়াশিল্প নগরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) বাইরে এপেক্স ও বে ট্যানারি নামের দুটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিশেষ আগ্রহ এবং চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) তৈরির অনুমতি দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

পরিবেশবান্ধব কারখানায় উৎপাদন করতে না পারায় প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ভালো দামে বিক্রি করতে পারছেন না ট্যানারি মালিকরা।

চামড়া খাতের বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না মেলায় দেশের ট্যানারি শিল্প নিয়ে ক্রেতাদের আস্থাহীনতার কারণে রপ্তানিমুখী এই খাতটি এখন চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শুধু কোরবানির ঈদ ঘিরে সারা দেশ ১ কোটি ১০ লাখ থেকে সোয়া কোটি কাঁচা চামড়া সংগৃহীত হয়। এর মধ্যে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ গরুর চামড়া আসে। বাকি ৭৫ থেকে ৮০ লাখ ছাগল, ভেড়া, খাসি ও অন্য পশুর চামড়া। সারা বছরে যত চামড়া আহরিত হয় তার প্রায় অর্ধেকই আসে কোরবানির সময়ে। তবে বন্যা, করোনাসহ নানা কারণে এ বছর কোরবানি কিছুটা কমে যাওয়ার শঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত হাটে ছিল পশু সংকট। দামও ছিল চড়া।

চামড়া বাণিজ্যে স্থিতিশীলতার পাশাপাশি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা তৈরি এবং কারসাজির মাধ্যমে ট্যানারিগুলোর পানির দামে চামড়া কেনা এবং একচেটিয়া মুনাফা করার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে এবার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে কাঁচা চামড়ার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে আড়ত মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা ট্যানারিতে চামড়া সরবরাহের বিষয়ে ধীর নীতি অবলম্বন করলে নিসন্দেহে এই খাতের সংকটকে আরো প্রকট করে তুলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টতা।