রমজানে কি ভোগ্যপণ্যের সংকট কাটবে, কমবে কি দাম?
বাংলাদেশে রমজান এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে। সেখানে এবার রোজার আগেই বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তি। রমজানে চাহিদা বাড়ে এমন পণ্যের আমদানিও গত বছরের তুলনায় কমেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে, তাই সংকট হবে না। একই আশ্বাস দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রীও। তিনি ভোক্তাদের একসঙ্গে বেশি পণ্য না কেনার আহ্বান জানিয়েছেন। ভোক্তা অধিকারকর্মীরা মনে করেন, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে জরুরি।
বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম
আগামী মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশে রোজা শুরু হচ্ছে। প্রায় দেড় মাস বাকি থাকলেও গত দুই সপ্তাহে মুরগি ও ডিমের দাম শতকরা ২৫ ভাগ বেড়েছে। প্রতিদিনই তা ক্রমাগত বাড়ছে।
দুই সপ্তাহ আগে প্রতিটি ডিমের দাম ছিল ৯ টাকা। তবে, এখন তা বেড়ে ১২ টাকায় ঠেকেছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকা। একইভাবে সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ।
রাজধানীর কাঁঠালবাগান বাজারের মাছ বিক্রেতা রতন মিয়া জানান, ‘মাছের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। রোজায় আরও বাড়বে। কারণ তখন চাহিদা আরও বেড়ে যাবে। কম দামের পাঙ্গাস ও তেলাপিয়াও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।’ তার দাবি, ‘সরবরাহ কম তাই মাছের দাম বাড়ছে। আর সব কিছুর দাম বাড়ায় মাছের দামও বাড়ছে। একটা বাড়লে আরেকটা বাড়ে।’
রাজধানীর কলাবাগানের মুরগি বিক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, ‘ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। গত একদিনে বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। সোনালী মুরগির প্রতি কেজি দাম এক সপ্তাহে ২৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৩২০ টাকা হয়েছে।’
কমেছে আমদানি
রমজানে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, ছোলা, খেজুর ও পেঁয়াজের। তাই রমজানের আগে এই ছয়টি ভোগ্যপণ্যের আমদানি বাড়ে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এসব পণ্য আমদানি কমেছে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি। ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলায় সমস্যার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। পর্যাপ্ত আমদানি না হওয়ায় বাজারে সেগুলো দাম বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত বছর রমজানে ছোলার দাম ছিল প্রতি কেজি ৭০ টাকা। এখন রোজা শুরুর আগেই কেজি ৯০ থেকে ৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্যানুযায়ী, গত নভেম্বর থেকে জানুয়াারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ৭০৫ টন। এক বছর আগে একই সময়ে সয়াবিন তেল আমদানির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ২৩ হাজার ৩৮৪ টন।
এলসি খোলার পর বাইরে থেকে পণ্য আমদানি করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। গত তিন মাসে ছোলার আমদানি কমেছে শতকরা ৫০ ভাগ। তবে চিনির আমদানি স্বাভাবিক আছে৷ তারপরও দাম বাড়ছেই।
আমদানি কমেছে খেজুরেরও। গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খেজুর আমদানি হয় ২২ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৪০ হাজার টন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ এই দুই মাস এবং পরবর্তী রমজানের এক মাসের চাহিদা অনুযায়ী ওই ছয়টি পণ্য আমদানিতে ১৫৩ কোটি মার্কিন ডলারের প্রয়োজন। আর শুধু রমজানের এক মাসের চাহিদা পূরণে এসব পণ্য আমদানিতে প্রয়োজন ৫৬ কোটি ডলার। কিন্তু মার্কিন মুদ্রার সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি আরোপে এবার ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত এলসি খুলতে পারেননি।
বিশ্ববাজারে দাম কমার সুফল কি মিলবে?
টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার বলেন, ‘পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। রোজার পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এলসি খুলতে পারছি। তবে নভেম্বর-জানুয়ারিতে এই সুবিধা ছিল না। ফলে রমজানে গতবারের মতো আমদানি করা পণ্যের সরবরাহ থাকবে না।’
মোস্তফা হায়দার আরও জানান, ‘বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলসহ আরও কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম কমেছে। তবে বাংলাদেশের বাজারে দাম কেমন হবে তা নির্ভর করছে চাহিদা ও সরবরাহের ওপরে। চাহিদার তুলনায় পণ্য কম হলে দাম বাড়তি হবে।’
এদিকে, খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সেখানেও আমদানি করা পণ্যের সরবরাহ কম।
বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, রমজানে খেজুর, সয়াবিন তেল, চিনিসহ যেসব নিত্যপণ্য ভোক্তাদের বেশি প্রয়োজন হয়, সেগুলোর জন্য পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক ২ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের হিসেব দিয়ে এই কথা বলেছেন। তার মতে, ‘যদি পণ্য সরবরাহ ও সাপ্লাই চেইন নিবিড়ভাবে তদারকি নিশ্চিত করা যায়, পণ্যগুলো যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে সহজভাবে সরবরাহ করা যায়, তাহলে রোজার মধ্যে কোনো পণ্যের ঘাটতি হবে না।’
মেজবাউল হক আরও বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় আমরা বাজার মনিটরিং করছি। যখন যে জায়গায় যে ধরনের নীতি সহায়তা দরকার হচ্ছে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিচ্ছে। এলসির ক্ষেত্রে আরও কোনো সহযোগিতা দরকার হলে তা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
সিন্ডিকেট বন্ধের আহ্বান
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যে তথ্য দিচ্ছে তাতে রমজানে আমদানি করা পণ্যের সংকট হওয়ার কথা নয়। তবে আমদানি পণ্যের সিন্ডিকেট আছে। কয়েকজন আমদানিকারক বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই তাদের এই সিন্ডিকেট বন্ধ করতে পারলে সংকট হওয়ার আশঙ্কা নেই। যখন ডলার সংকট বা এলসি খোলায় সংকট ছিল না তখনও তো তারা সংকট তৈরি করেছে। তাই এই সিন্ডিকেটকেই নজরে রাখতে হবে।’
এদিকে, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী রমজান মাসের জন্য ক্রেতাদের সব পণ্য এক সঙ্গে না কেনার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘রমজানের প্রথম সপ্তাহে ক্রেতারা যেভাবে বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়েন, সেটা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। দোকানে যখন ১০০ কেজি মাল থাকে, তখন যদি ১০ জন ক্রেতার প্রত্যেকে একসঙ্গে ১০০ কেজি করে কিনতে চায়, তখন মনে হয় সংকট, যেটা আর্টিফিশিয়াল সংকট।’