লাখপতির গল্প
শখের রান্না থেকে সফল উদ্যোক্তা নাহিদ জাহান
গৃহিণীরা ঘরে বসে তৈরি করেন নানা পদের মুখরোচক খাবার, যা দৈনন্দিন খাবার হিসেবে আমরা খাই। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, এই খাবার অনলাইনে বিক্রি করে মাসে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। আর তা প্রমাণ করেছেন নাহিদ জাহান চৌধুরী।
নাহিদের খাবারের বিশেষত্ব হলো, কোনো প্রকার কেমিক্যাল নেই এবং সব ধরনের হাইজিন মেইনটেইন করে তৈরি করা হয়। তাঁর ঘরে তৈরি খাবারের তালিকায় রয়েছে সস, আচার, ঘি, সেমাই, ফ্রোজেন ফুড ইত্যাদি।
প্রতিষ্ঠানের নাম নাহিদ ফুড। হোম মেইড ফুডের ধারণা কীভাবে এলো নাহিদের? এনটিভি অনলাইনকে বললেন, ‘আমি নিজের পরিবারের আপনজন ও সন্তানের জন্য যেভাবে যত্ন ও ভালোবাসা দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার তৈরি করি, ঠিক সেভাবে কাস্টমারের জন্য তৈরি করি। বাসায় বানানো খাবারে কোনোপ্রকার রাসায়নিক থাকে না। কোনো চাকচিক্য থাকে না, এটি সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত। হোম মেইড ফুড মানে একটা বিশ্বাসের জায়গা, একটা আস্থার জায়গা; যা আমরা নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে খেতে পারি।’
কত দিন ধরে কাজ করছেন আর সাড়াই বা কেমন পাচ্ছেন, এনটিভি অনলাইনের এমন প্রশ্নে নাহিদের উত্তর, ‘সস, আচার ও ফ্রোজেন ফুড আমি ২০-২১ বছর ধরে করছি। তবে শুধু আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবের মাঝে, শিক্ষকতা করার পাশাপাশি। গত দুই বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে প্রচারের চেষ্টা করছি। এখন আমার উদ্যোগে অনেক সাড়া পাচ্ছি, এতেই আমি সন্তুষ্ট। কারণ, আমি কিছু ট্রেনিং ও কোর্স করছি। সেইসঙ্গে বিজনেস নিয়ে লেখাপড়া করছি।’
নাহিদের ভাষ্যে শুরুটা এমন, ‘আমি ১৬ বছর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি করেছি, পারিবারিক কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু বাসায় কোচিং করিয়েছি, যা থেকে মাসে ৫০ হাজারের ওপর আয় হতো। ২০১৯ সালের শেষের দিকে মনে হলো, এত স্বল্প পরিসরে ব্যবসা করে হবে না। পুরোপুরি ব্যবসায় নেমে যেতে হবে। পেজ সেটআপ করা ছিল, কিন্তু পেজ পরিচালনা করতে টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো জানা ছিল না। তাই অ্যাডভান্স ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্সে ভর্তি হলাম। এরপর উই গ্রুপে (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম—উই) যুক্ত হয়েছি। উই গ্রুপে যুক্ত হয়ে রাজিব স্যারের মাধ্যমে জানতে পারলাম, আমাকে আরো শিখতে হবে, পড়তে হবে, জানতে হবে। খুব ভালো করে উপলব্ধি করলাম, বেসিক না জেনে ব্যবসা শক্তভাবে দাঁড় করানো সম্ভব নয়। বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে, যেমন—এফ-কমার্স, ই-কমার্স, পেজ মেইনটেইন করা ইত্যাদি।’
নাহিদ জাহান জানান, খাবার তৈরিতে তিনি হাইজিন মেইনটেইন করেন এবং খাবার নির্ভেজালভাবে তৈরি করেন। মানে কোনোপ্রকার রাসায়নিক, যেমন—রং, ফ্লেভার, টেস্টিং সল্ট, প্রিজারভেটিভ ইত্যাদি ব্যবহার করেন না।
উদ্যোক্তা-জীবনের মধুর স্মৃতি? উত্তরে নাহিদ জাহান বলেন, ‘আমি উই গ্রুপের সিগনেচার পণ্য, মানে শুধু আচার নিয়ে পোস্ট দিতাম। একসময় একটু বিরক্ত লাগছিল এবং আচারের পোস্টটি পরিবর্তন করে গত বছরের কুরবানি ঈদের আগে ঘিয়ে বানানো লাচ্ছা সেমাইয়ের একটি পোস্ট দিই। উই গ্রুপে ঝড়ের বেগে এত অর্ডার এলো যে সাত দিনে প্রায় ৬০টির ওপরে অর্ডার এবং শুধু সেমাই থেকে ৩০ হাজার টাকার বেশি সেল হয়। এরপর সবাই রিভিউ ও কমেন্টে আমাকে জানায়, সেমাইগুলো এত মজার ছিল যে কাস্টমারের ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল—সেই স্বাদ, সেই ঘ্রাণ। কাস্টমারের এই অনুভূতি এবং সন্তুষ্টি আমার চোখে পানি নিয়ে এসেছিল। আমি তাদের এতটুকু হলেও আস্থার জায়গাটা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। এই স্মৃতি আমার কাছে অনেক মধুর। আমার শখের রান্না সবাই খায়, বিষয়টি অনেক আনন্দের।’
সফল হতে কাদের ভূমিকা বেশি ছিল? নাহিদ জাহান বলেন, ‘আমার উদ্যোক্তা-জীবন সফল হতে আমার পার্মানেন্ট হেল্পিং হ্যান্ডের সহযোগিতা অনেক বেশি। সে আমার বাসার সব সামলেছে এবং আমি বিভিন্ন ট্রেনিং, কার্যক্রম এবং লেখাপড়া করতে পেরেছি। এরপর অবশ্যই বলব রাজিব স্যারের কথা। উদ্যোক্তা হতে গেলে লেখাপড়া করতে হয়, এটা জানা ছিল না। স্যার শিখিয়েছেন, ভালো উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য বেসিক জানা খুব দরকার। এর জন্য লেখাপড়ার বিকল্প নেই। আমি গত বছর লেখাপড়া এবং ট্রেনিংয়ে বেশি সময় দিয়েছি। এ বছর থেকে আমি আমার বিজনেসকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারব। সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য একজন মেন্টর অবশ্যই দরকার, আর সেই মেন্টর যদি হন রাজিব স্যার, তাহলে কেউ কোনোদিন ঠকবে না। স্যারের জন্য দোয়া রইল।’
উদ্যোক্তা হতে পেরে গর্বিত নাহিদ জাহান। বলেন, প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছেন। সৃজনশীল কাজেই তাঁর আনন্দ এবং তৃপ্তি অন্যরকম, যা বলে বোঝানো কঠিন। এখন মাসে ৫০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়। তবে লেখাপড়ায় ব্যস্ততার কারণে উদ্যোগে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। নাহিদের প্রত্যাশা, এ বছরে পর্যাপ্ত সময় দেবেন আর তিনগুণ বিক্রি বাড়ানোর পরিকল্পনা তাঁর।
নাহিদ জাহানের অন্য গুণও অবশ্য আছে। টেইলারিং, ব্লক, বাটিক, হ্যান্ড এমব্রয়ডারি, ড্রইং, পেইন্টিং, স্কেচিং, পেপার ক্রাফট ইত্যাদি পারেন। ওই যে আগেই বলা হলো, সৃজনশীল কাজে আনন্দ নাহিদের। এখন নাহিদের প্রতিষ্ঠানে কর্মীসংখ্যা তিন জন। নতুন বছরে কর্মীর সংখ্যা ছয় থেকে আট জনে পরিণত হবে, এ প্রত্যাশা এ সফল উদ্যোক্তার।
দেশের বেকার সমস্যা নিরসনে নাহিদ জাহানের পরামর্শ, ‘বেকার সমস্যা নিরসনে সরকার যথেষ্ট সুযোগ ও সব রকম সহায়তা করছে এবং অনেকগুলো সেক্টরে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। যার যে সেক্টর ভালো লাগে, সে সেটিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে কাজে নেমে পড়তে পারে। তবে আজ কাজ শুরু করলাম, আগামীকাল বেনিফিট পাব, এমন নয়। কমপক্ষে এক বছর লেগে থাকতে হবে এবং নিজেকে একজন দক্ষ কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। অন্যের ওপর ভরসা করা যাবে না। নিজে চেষ্টা করলে, আমার মনে হয়, অসাধ্য বলে কিছু নেই।’ নাহিদের মতো উদ্যোক্তাদের পথ অনুসরণ করে নারীরা স্বাবলম্বী হোন, এ প্রত্যাশা সবার।