চালের সর্বনিম্ন দাম ৪০ টাকা, ১০ বছরে দ্বিগুণ

Looks like you've blocked notifications!

মো. মোনাহার ঢাকায় রিকশা চালান। বাড়ি জামালপুরে। তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি এলাকায় থাকেন। তিন সন্তান, স্ত্রীসহ পাঁচজনের সংসার। রিকশা চালিয়ে প্রতিদিন আয় করেন সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। প্রতিদিন বাড়ি ফেরার সময় আড়াই কেজি চাল কিনতে হয় মোনাহারকে। ওই চালের পেছনেই তাঁর খরচ হয় ১০০ টাকা। 

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে চাল কিনছিলেন মোনাহার। তিনি জানান, মোটা চাল কেনেন তিনি। এর দাম এখন প্রতি কেজি ৪০ টাকা। বাজারে সবচেয়ে কম দামের চাল এটাই! 

দর্জির দোকানে কাজ করেন দেলোয়ার। প্রতিদিন আয় করেন ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা। তিনি জানান, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়। মাস শেষে হাত পাততে হয় অন্যের কাছে।

সংসারের জন্য প্রতিদিন দুই কেজি চাল কেনেন। আর চালের পেছনেই খরচ হচ্ছে প্রতিদিনের আয়ের সবচেয়ে বেশি অংশটা। বাকি কিছু থাকলে তা দিয়ে সবজি বা মাছ হয়। 

কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, রাজধানীতে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। মাঝে মাঝে দু-এক টাকা কমে আবার বাড়ে। কিন্তু গড়ে বাজারে সবচেয়ে কম দামি চালের দাম ৪০ টাকা। ব্যবসায়ীরা জানালেন, রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষ ওই চালই কেনেন। 

১০ বছর আগে বাজারের সবচেয়ে কম দামি চাল ছিল বিআর ১১/৮। ২০০৬ সালে প্রতি কেজি বিআর ১১/৮ চাল বিক্রি হয় ১৮ টাকা ২৫ পয়সায়, যার দাম গত বছর ছিল ৩৫ টাকা ৪১ পয়সা। 

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি স্বর্ণা ও পারিজা চাল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, বিআর আটাশ ও ঊনত্রিশ ৪৩-৪৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

মিনিকেট এক নম্বর ৫২ থেকে ৫৪ টাকা; নাজিরশাইল ৫০ থেকে ৫২ টাকা, দেশি বাসমতি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। 

অন্যদিকে প্রকার ভেদে চিনিগুড়া চাল কেজিপ্রতি ৮৫ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দামে বিক্রি করছে প্যাকেটজাত চিনিগুড়া চাল। প্রাণের এক কেজির প্যাকেট ১২০ টাকা, চাষী ও এরফান ১১০ টাকা এবং রূপচাঁদা ১১৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।  

কারওয়ান বাজারের ক্রেতা মোনাহার ও দেলোয়ার দুজনই জানালেন, তাঁদের স্ত্রীও কাজ করে সংসারে জোগান দেন। কিন্তু সেটাও অল্প। চালের পেছনেই বেশির ভাগ অর্থ চলে যাচ্ছে। তার ওপর আছে ঘরভাড়া, সন্তানদের কাপড়। আর এর ওপর স্কুলে যাওয়ার কথা উঠলে হিমশিম খেতে হয়।  

দেলোয়ার বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমাদের খেতেই যদি সব চলে যায়, তাহলে ছেলেমেয়েদের কী হবে?

রাজধানী বাবুবাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী নিজাম জানান, মিনিকেট-২৮ প্রতি কেজিতে বেড়েছে ১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২ টাকা পর্যন্ত ।
 
নিজাম জানান, মিল মালিকদের কারণে চালের দাম বাড়ে। অন্যথায় বাড়ার কথা নয়। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের নজরদারি। 

কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সারোয়ার আলম বলেন, ‘চালের বর্তমান যে দাম সেটা সরকার চাইলে কমাতে পারে। একটা সিন্ডিকেট আমাদের চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ সিন্ডিকেট  ভেঙে দিতে পারলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে।’

১০ বছরে দাম দ্বিগুণের বেশি
গত ১০ বছরে পাঁচ ধরনের চালের দাম নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, সব ধরনের চালের দাম ১০ বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই বিশ্লেষণ করা হয়। 

গত ১০ বছরে বাংলাদেশে তিনটি সরকার ছিল। ২০০৬ সালের শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। ওই সময় চালের দাম যা ছিল গত ১০ বছরে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। 

২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুই বছর ওই সরকার দেশ পরিচালনা করে। ওই সময় থেকে চালের দাম বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দেশ পরিচালনা করেন। ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে ওই পাঁচ ধরনের চালের দাম কিছুটা কমেও যায়। কিন্তু পরে দ্রুত বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে দেশ পরিচালনা শুরু করে শেখ হাসিনার সরকার। তিন বছর শেষে বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম।   

ক্যাবের দেওয়া তালিকায় দেখা যায়, মিনিকেট চালের দাম ২০০৬ সালে ছিল প্রতি কেজি ২৭ টাকা ৯৫ পয়সা। ২০১৬ সালে ওই চালের দাম হয় ৪৮ টাকা ৩৪ পয়সা। ২০০৬ সালে নাজিরশাইলের দাম ছিল ২৫ টাকা ৫৪ পয়সা। ২০১৬ সালে ওই চালের দাম হয় ৫৫ টাকা ৭৮ পয়সা। ২০০৬ সালে পাইজাম চালের দাম ছিল ২৩ টাকা। গত বছর ওই চালের দাম ছিল ৪০ টাকা ৩৭ পয়সা। ২০০৬ সালে পারিজা/স্বর্ণার দাম ছিল ১৯ টাকা ২৫ পয়সা। গত বছর ওই চালের দাম ছিল ৩৭ টাকা ১৯ পয়সা। ২০০৬ সালে বিআর এগারো/আটের দাম ছিল ১৮ টাকা ২৫ পয়সা। গত বছর ওই চালের দাম ছিল ৩৫ টাকা ৪১ পয়সা।  

‘প্রয়োজন সরকারের মনিটরিং’
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুর রশিদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদেরকে গত মৌসুমে বেশি দামে ধান কিনতে হয়েছে। তাই চালের দাম একটু বাড়িয়েছি। প্রতি কেজিতে স্বর্ণা চালে ১ টাকা ৫০ পয়সা এবং মিনিকেট ৫০ পয়সা করে বাড়িয়েছি। তবে অন্য সকল চাল আগের দামে আছে।’ 

আবদুর রশিদ বলেন, ‘যারা বাজারে অস্বাভাবিক দাম বাড়ায়, তাদের ব্যাপারে সরকার চাইলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রয়োজনে সরকার বাজার মনিটরিং করতে পারে। তাহলে আসল তথ্য জানা যাবে।’ 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘গরিব মানুষের জন্য দাম বাড়ানোটা কোনোভাবেই যৌক্তিক না। চালের দাম বাড়ানোর কোনো কারণ এখন নেই।’ 

গোলাম রহমান আরো বলেন, ‘দিন দিন এসব মানুষ নিজের পরিবার চালাতে হাঁপিয়ে উঠছে। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া দরকার।’