বৈদেশিক ঋণমুক্ত বিকল্প বাজেট প্রস্তাব অর্থনীতি সমিতির

Looks like you've blocked notifications!

চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের চেয়ে প্রায় আড়াইগুণ বাড়িয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ১২ লাখ ৪০ হাজার ৯০ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণমুক্ত বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাত বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৯-২০ তুলে ধরেন।

আগামী ১৩ জুন জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করার কথা রয়েছে অর্থমন্ত্রীর। তার ১৯ দিন আগে এ বিকল্প বাজেটের প্রস্তাব দেয় অর্থনীতি সমিতি। ঢাকাসহ দেশের ২৬টি জেলা শহরে একই দিনে একই সময় এটি অনুষ্ঠিত হয়।

‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৯-২০’ শিরোনামে এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির পক্ষে এ প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেন সমিতির সভাপতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত।

সমিতির প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১২ লাখ ৪০ হাজার ৯০ কোটি টাকা যা অর্থমন্ত্রীর সম্ভাব্য প্রায় ৫ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বাজেটের অাড়াই গুণ। প্রস্তাবিত রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১০ লাখ ২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৬৯ শতাংশ হবে প্রত্যক্ষ কর ও ৩১ শতাংশ হবে পরোক্ষ কর। অর্থাৎ মোট বাজেট বরাদ্দের প্রায় ৮১ শতাংশের যোগান দেবে সরকারের রাজস্ব আয়।

আবুল বারকাত বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের উৎস হিসেবে ২০টি নতুন উৎস নির্দিষ্ট করেছি যা আগে ছিল না। এর মধ্যে অর্থপাচার রোধ, কালো টাকা উদ্ধার ও সম্পদ কর এই তিনটি নতুন উৎস থেকেই সরকার মোট ৯৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে পারে। আর এ টাকা দিয়ে প্রতি বছর তিনটি পদ্মা সেতু করা সম্ভব।’

অর্থনীতি সমিতির সভাপতি বলেন, ‘সমিতির প্রস্তাবিত বাজেট অর্থায়নে কোনো বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন হবে না, প্রস্তাব অনুযায়ী বাজেটের আয় কাঠামোতে মৌলিক গুণগত রূপান্তর ঘটবে। আমাদের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, কেউ হয়তো বলবেন অনেক বড় ঘাটতি। এক্ষেত্রে বলতে চাই জাপানে বাজেট ঘাটতি ২৫৬ শতাংশ। ঘাটতি বাজেটে অসুবিধা হলে এক পয়সাও ঘাটতি না রেখে আমাদের প্রস্তাবিত রাজস্ব আয় দিয়েও মোট বাজেট প্রস্তুত করতে পারেন। আজকের উন্নত দেশের প্রায় সবাই যখন উন্নতি করছিল ১৯৩০-১৯৭০ দশক পর্যন্ত সময়ে তখন তাদের সবারই সরকারি ব্যয় বরাদ্দ ছিল বেশ বেশি, প্রবৃদ্ধির হারও ছিল বেশি।’

অর্থনীতি সমিতির অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খাতওয়ারি সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রস্তাব করেছে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে, মোট ২ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তারপর আছে জনপ্রশাসন, পরিবহন ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, স্বাস্থ্যখাত, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাত।

চলতি বছরের সরকারি বরাদ্দের চেয়ে বেশি সমিতির প্রস্তাবিত অন্য খাতগুলো হলো- কৃষি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিস, জনশৃঙ্খলা-নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা।

কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার বিষয়ে আবুল বারকাত বলেন, ‘আমরা মনে করি যে প্রস্তাবিত বাজেট বছরেই কৃষি ও কৃষক ভাবনার যথার্থতা বিচারে ১ লাখ ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে ২ লাখ বিঘা কৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত দেওয়া সম্ভব, আর পাশাপাশি ২০ হাজার জলাহীন প্রকৃত মৎস্যজীবী পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ হাজার বিঘা খাস জলাশয় বন্দোবস্ত দেওয়া সম্ভব। বিষয়টি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে এ লক্ষ্যে ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দসহ বাস্তবায়ন কৌশল সংশ্লিষ্ট পথনির্দেশনা দেওয়া জরুরি।’

কৃষি ফসলের উৎপাদন অঞ্চল গঠন ও কৃষককে কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজারমূল্য দেওয়ার প্রস্তাব করে বারকাত বলেন, এ বছর বোরো ধানে কৃষকের প্রকৃত লোকসান হবে কমপক্ষে ৫০০ টাকা। এ নিয়ে সরকারের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা মনে করি কৃষককে তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজারমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য জরুরিভাবে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারিভাবে সংগ্রহের ক্রয়মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় কমপক্ষে ২০ শতাংশ বাড়াতে হবে, সেক্ষেত্রে এ বছরের বোরো ধানের মণপ্রতি বিক্রয়মূল্য হতে হবে কমপক্ষে ১২০০ টাকা।

দেশে প্রতিবছর ৩০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে কিন্তু তার মধ্যে ২০ লাখ মানুষেরই কর্মসংস্থান হয় না উল্লেখ করে ক্রমবর্ধমান মানব বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা দূরীকরণ, শিক্ষা ব্যবস্থার মূলধারার অধিকহারে বৈষম্য রোধ, কর্মসংস্থান বাড়ানো ও বেকারত্ব কমাতে অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি ‘জাতীয় কর্মসংস্থান পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কোষ’ গঠন, যুবকদের উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবক হতে উৎসাহিত করতে স্টার্ট আপ পুঁজি সরবরাহ এবং শিক্ষাখাতে জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ  বরাদ্দের প্রস্তাব দেন আবুল বারকাত।

শিক্ষার সব স্তরে বাংলা ভাষাকে জ্ঞানচর্চার মূল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বারকাত বলেন, সমগ্র শিক্ষা কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে। এর অর্থ এই নয় যে আমরা অন্য কোনো ভাষা শিখব না। অবশ্যই শিখব। উচ্চশিক্ষা স্তরে সব শিক্ষার্থীর জন্য কমপক্ষে দুটি বিদেশি ভাষাশিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে তাঁর অন্যতম প্রস্তাবগুলো হলো, দরিদ্র নারীদের সরকারিভাবে ক্ষুদ্র-অনুদান, প্রশিক্ষণ, গার্মেন্টসসহ কর্মজীবী নারীদের আবাসন ও ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন, একশভাগ নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট বরাদ্দ ৪ গুণ বাড়ানো, ক্রীড়া খাতে মেয়েদের জন্য বরাদ্দ ৪ গুণ বাড়ানো, মাধ্যমিক স্কুলে মেয়েদের বিজ্ঞান শিক্ষায় বরাদ্দ ৩ গুণ বাড়ানো এবং নারীর প্রতি সহিংসতা রোধসংশ্লিষ্ট বরাদ্দ এখনকার তুলনায় কমপক্ষে ৩০ গুণ বাড়ানো।

খেলাপী ঋণ প্রসঙ্গে আবুল বারকাত প্রস্তাব করেন, অভ্যাসগত ঋণখেলাপিদের মোকাবিলার জন্য সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে তাদের পূর্ণউদ্যমে চালু শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ঠিক হবে না। সমস্যাটি জটিল তবে সমাধান সম্ভব বলে মনে করি।