‘২০ টাকায় চামড়া কিনছি, কারণ এতে মাংস আছে, কেউ খাওয়ার জন্য নেবে’
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2019/08/13/photo-1565668449.jpg)
খুলনা নগরীতে ছাগল আর ছোট গরুর চামড়ার কোনো দামই নেই। কিনছেন না কোনো আড়তদার। ফলে বিভিন্ন স্থান থেকে ছাগল আর ছোট গরুর চামড়া নিয়ে বিক্রি করতে না পেরে ফেলে রেখে যাচ্ছেন কেউ কেউ।
ঈদের দিন থেকে নগরীর বিভিন্ন স্থানে শামিয়ানা টানিয়ে যে চামড়া ক্রয় করা হতো, সেই চিত্র এখন আর নেই। দেখা মেলেনি কোনো মৌসুমি ব্যবসায়ীর। খুলনায় একসময় ৪০ থেকে ৪৫টি চামড়ার আড়ত থাকলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র তিন থেকে চারটিতে। এককথায় চামড়াশিল্পে যেন ধস নেমে এসেছে।
ছাগলের চামড়া বা ছোট গরুর চামড়ায় লবণ লাগিয়ে এবং কাটাকাটি করতে ব্যয় হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। কিন্তু সেই ছাগলের চামড়া ট্যানারিতে বিক্রি হয় মাত্র ৩০ টাকায়। ফলে কোনো আড়তদার আর ছাগলের চামড়া কিনছেন না। তবে চামড়ার গায়ে যে মাংস লেগে থাকে, তা কেনার জন্যই কেবল একটি ছাগলের চামড়া ১০ থেকে ২০ টাকায় কিনছেন অনেকে।
কেউ কেউ ভ্যান, রিকশা, ইজিবাইকে করে নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে বেশি দামের আশায় চামড়া নিয়ে আসছেন শেরেবাংলা রোডের কয়েকটি চামড়ার আড়তগুলোতে। কিন্তু চামড়ার দাম শুনে বিক্রেতারা অনেকটা হতভম্ভ হয়ে পড়ছেন। অনেকে আবার চামড়া ফেলে চলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, চামড়াশিল্পের এই ধস কওমি মাদ্রাসার জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুটি ছাগলের চামড়া মাত্র ২০ টাকায় কেনার পর একজন ক্রেতা বললেন, ‘ছাগলের চামড়া চলছে না। ছাগলের চামড়ার কাটছাঁট হয় বেশি। সে জন্য চামড়াগুলো চলে না। এ জন্য আমরা চামড়াগুলো কিনছি না। ২০ টাকা দিয়ে চামড়া কিনেছি। কারণ, চামড়ায় মাংস লাগানো আছে, কেউ খাওয়ার জন্য নেবে, সে জন্য।’
গরুর চামড়ার দাম জানতে চাইলে ওই ক্রেতা বলেন, ‘গরুর চামড়ার দাম ৪০০, ৫০০ ও ৬০০; সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা। সর্বনিম্ন ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।’ কী জন্য দাম কম—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দাম কেন কম বলা যাচ্ছে না। এটা ট্যানারি মালিকরা বলতে পারবেন।’
চামড়া ক্রেতা এক আড়তদার বলেন, ‘চামড়ার দাম নেই, ছোট চামড়া মার্কেটে কোনো দামে বিক্রি হয় না। এই চামড়া মার্কেটে বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। এ জন্য আমরা এই চামড়া কিনছি না। এই চামড়ায় লবণ খরচ করতে গেলে লবণে লাগবে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। গাড়ি ভাড়ায় খরচ হবে ১০০ টাকা। কিন্তু বিক্রি হবে ৩০ বা ৪০ টাকায়। তাহলে চামড়া কিনে কী করব? গত বছর আমরা লস করে চামড়া বিক্রি করেছি। এ পর্যন্ত আমরা টাকা পাইনি। এ জন্য চামড়ার এই অবস্থা।’
খুলনায় একসময় ৪০টা আড়ত ছিল, এখন তা নেমে মাত্র তিনটিতে চলে এসেছে। অনেক আড়তদার দেউলিয়া হয়ে অন্য ব্যবসা করছেন বলে মন্তব্য করেন চামড়া ব্যবসায়ী আবু জাফর। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ৩৫ থেকে ৪০ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। আমাদের এখানে ৪০ থেকে ৪৫টা চামড়ার ঘর। এখন চামড়ার ঘর দু-তিনটা আছে। এই চামড়াওয়ালারা ঢাকায় বেচতে বেচতে এখন তারা দেউলিয়া হয়ে সবাই পালিয়ে গেছে। গত পাঁচ বছর থেকে কোনো টাকা পেমেন্ট দেয় না ট্যানারিওয়ালারা। এ কারণে অনেক চামড়াওয়ালা দেউলিয়া হয়ে গেছে। কোনো কোনো চামড়াওয়ালা আমড়া বিক্রি করে, রিকশা চালায়, কেউ লেবারি করে। এখন সেই চামড়াশিল্পের ভেতরে কেউ নেই। আমরা দু-একজন চামড়া ব্যবসার মধ্যে নাম রাখার জন্য এই ব্যবসাটা করছি। তাও গত বছরে আমরা কষ্ট করে কিছু চামড়া বিক্রি করেছি। তার একটা টাকাও আমরা পাইনি। ঢাকার ট্যানারিওয়ালারা কোনো টাকাই দেয় না। আমাদেরও একটা টাকাও দেয়নি। আমরা এখন সুদে-লাভে নিয়ে চামড়া কিনছি। কপালে কী আছে, আল্লাহ জানেন।’
এ রকম পরিস্থিতির কারণ জানতে চাইলে আবু জাফর বলেন, ‘ট্যানারিওয়ালারা বলছে তারা মাল বেচতে পারছে না, আন্তর্জাতিক বাজার কম।’
চামড়া বিক্রেতা মাওলানা তাজুল ইসলাম বাইজিদ বলেন, ‘চামড়ার দাম কম। এক লাখ ৬০ হাজার টাকার গরুর চামড়ার দাম ৩৭৫ টাকা। মাঝারিগুলোর দাম দেড়শ টাকা। আর ছাগলের চামড়ার দামই নেই। আর মাদ্রাসাগুলোর বড় একটা অংশ চামড়ার টাকায় চলে। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, আগামীতে এই চামড়ার মূল্য যেন একটু বেড়ে যায়। যেভাবে বাড়ালে আমরা যেন চলতে পারি, মাদ্রাসাগুলো চলতে পারে। গরিব অসহায় ছাত্ররা খেয়ে যেন পড়াশোনা করতে পারে, এটাই সরকারের কাছে আবেদন।’
অন্যদিকে চামড়াশিল্পের এই ধসের কারণে আগামীতে কওমি মাদ্রাসা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন মুফতি রশিদ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের কওমি মাদ্রাসাগুলোর লিল্লাহ বোর্ডিং আছে। লিল্লাহ বোর্ডিং দুটো ইনকামের ওপর চলে। একটা হলো কোরবানির চামড়া, আরেকটা হলো রমজানের জাকাত। এই কয়েক বছর থেকে যা অবস্থা, আমাদের কওমি মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো আর চালানো সম্ভব হবে না। কারণ, আমরা এক-একটা চামড়া তিন হাজার, চার হাজার, এমনকি পাঁচ হাজার টাকা দিয়েও বিক্রি করেছি। এখন সেসব চামড়া ১০০, ২০০, এমনকি আড়াইশ টাকা দিয়েও নিতে চায় না। এমন পরিস্থিতিতে মাদ্রাসাগুলো কীভাবে চলবে? আমাদের তো খরচের টাকাও উঠবে না।’