সহায়তার প্রতিটি অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহারের পরামর্শ
বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহায়তা করার জন্য ব্যয় করা প্রতিটি অর্থ যেন সর্বোত্তম উপায়ে ব্যবহৃত হয়, তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার।
গতকাল বুধবার ‘বাংলাদেশের অগ্রাধিকারসমূহ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের পর এই পরামর্শ দেন সংস্থাটির প্রধান ড. বিয়র্ন লোমবোর্গ। ‘বাংলাদেশের অগ্রাধিকারসমূহ’ শীর্ষক এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের জন্য শ্রেষ্ঠ নীতিমালাগুলো চিহ্নিত করা, যাতে করে ব্যয় করা অর্থের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের সর্বোচ্চ কল্যাণ হয়।
ড. বিয়র্ন বলেন, বাংলাদেশকে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিনটির নাম দারিদ্র্য। এই খাতে উন্নয়নের জন্য এখনো বহু পথ পাড়ি দিতে হবে দেশটিকে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক-এর সহযোগিতায় কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার এই গবেষণা করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিবিদরা এই প্রকল্পের ব্যয় ও সুবিধা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব পেয়েছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ড. বিয়র্ন বলেন, ২০০০ সালে দেশটির চরম দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা হয় ৩৪ শতাংশে। এই মুহূর্তে সেই হার দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। এখনো দেশের ২০ মিলিয়ন মানুষ হতদরিদ্র। ৪৩ টাকা বা তার চেয়ে কম পরিমাণ অর্থে একদিন কাটানো সত্যিই কষ্টকর। দরিদ্রতা এমন এক ফাঁদ যেখান থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব। এসব হতদরিদ্র মানুষের নিজেদের জমি নেই। এরা সাধারণত দিনমজুর হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে। আগামী দিনের জন্য জমিয়ে রাখার মতো কিছুও থাকে না তাদের কাছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার একটি লক্ষ্য ঠিক করে জানিয়ে ড. বিয়র্ন বলেন, এতে ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ছয় মিলিয়ন মানুষকে হতদরিদ্র অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়। প্রায় একই রকম লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্য বেঁধে দিয়েছে জাতিসংঘ। একে বলা হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। এর মাধ্যমে মানুষের হতদরিদ্র অবস্থার অবসান ঘটানো হবে।
বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহায়তা করার জন্য ব্যয় করা প্রতিটি অর্থ যেন সর্বোত্তম উপায়ে ব্যবহৃত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে বলে মত দেন ড. বিয়র্ন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অগ্রাধিকারসমূহ’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল থেকে বোঝা যায় যে, এসব মানুষকে সহায়তা করার আরো অনেক কার্যকর উপায় রয়েছে।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য মোকাবিলা করার তিনটি উপায় বিশ্লেষণ করে দেখেছেন ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের অর্থনীতিবিদ মুনশী সুলাইমান এবং রোটারড্যামের ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারজানা মিশা। তাঁদের মতে, ‘উত্তরণ’ প্রকল্পটি এ জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় কৌশল। এর মাধ্যমে প্রাপককে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সাহায্য করা হয়। সব মিলিয়ে, বাংলাদেশে উত্তরণ কর্মসূচিতে প্রতি এক টাকা ব্যয় করে দুই টাকা সমান সামাজিক কল্যাণ সম্ভব বলে মত এই দুই অর্থনীতিবিদের।
উত্তরণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা প্রথমে নগদ বা খাদ্যরূপে একটি ছোট উপহার পান, যা তাঁদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার খরচের চাপ কমায়। একই সঙ্গে তাদের সঞ্চয় করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। এর পরে, তাঁরা একটি সম্পদ পান, তা হতে পারে একটি গরু বা একটি ছাগল কিংবা আর্থিক ও কারিগরি শিক্ষা।
এ জন্য পশু বিশেষজ্ঞ দ্বারা পশুপালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হয় যেন অংশগ্রহণকারীরা কোনো জরুরি অবস্থায় সম্পদ বিক্রি করে দিতে বাধ্য না হয়। সবশেষে অংশগ্রহণকারী সামাজিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন যা দারিদ্র্য বিমোচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অথচ প্রায়ই এই আত্মবিশ্বাসের বিষয়টিই উপেক্ষা করা হয়।
অন্যদিকে, নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করা হলে বিনি য়োগের ব্যয়িত প্রতি এক টাকায় এক টাকার কম ফেরত পাওয়া যায়। নগদ অর্থ হস্তান্তর অন্যান্য কৌশলের তুলনায় কার্যকরী না হওয়ার পেছনে একটি কারণ হলো সময়ের সাথে এর প্রভাব কমে যাওয়া। চরম দরিদ্রতায় বাস করা কারও জন্য একটি এককালীন অর্থ-সাহায্য অল্প সময়ের জন্য সহায়ক হতে পারে, কিন্তু এর প্রভাব ক্ষণস্থায়ী বলেও মত দেন দুই অর্থনীতিবিদ।