বিজনেস আইকন

ব্যবসার মূলধন কথা দিয়ে কথা রাখা : হুমায়ুন রশিদ

Looks like you've blocked notifications!
এনার্জিপ্যাকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ। ছবি : এনটিভি

'দিনের শুরুটা করতে চাই খবরের কাগজের সুখবর দিয়ে। কিন্তু প্রতিদিনই একটা না একটা দুঃসংবাদ মেলে। এই সংবাদ মন খারাপ করলেও একটি চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য মনকে তৈরি করি।’ কথাগুলো বললেন এক স্বপ্নচারী মানুষ হুমায়ুন রশিদ। তিনি বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠান এনার্জিপ্যাকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এনটিভির নিয়মিত আয়োজন বিজনেস আইকনের এবারের পর্বে এসেছে সাধারণ মানুষটির অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প। বলেছেন জীবনের বাঁকে বাঁকে সংগ্রাম ও টিকে থাকার লড়াইয়ের কথা। জীবনের নানা দোলাচলের মাঝেই কেউ কেউ একে একে টপকে যান বাধার সিঁড়ি। তেমনি একজন মানুষ হুমায়ুন রশিদ।urgentPhoto 
অনেক আগে থেকেই সকালটা শুরু করতে চান ভালো কোনো সংবাদ দিয়ে। কিন্তু সব সময় তো আর তা হয় না। মাঝেমধ্যে খারাপ খবরও মেলে। কিন্তু তা নেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে, আরো ভালো কিছু করার প্রত্যয়ে। 

হুমায়ুন রশিদ প্রতিদিন নতুন কিছু করার জন্য, নতুন কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত হতে চান। 

ছোটবেলায় ছবি আঁকার প্রতি অন্য রকম ঝোঁক ছিল তাঁর। বড় হয়ে মস্ত বড় আঁকিয়ে হবেন—এমন স্বপ্নেও বিভোর ছিলেন কত কত কাল। এখনকার চারুকলা আর তখনকার ফাইন আর্টস কলেজে পরীক্ষাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সুযোগ মেলেনি। তার পরই যেন স্বপ্নপথের মোড়টাও ঘুরে যায় তাঁর। 

হুমায়ুন রশিদের জন্ম রংপুরে। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন জেলায়। কৈশোর কেটেছে যশোরে। আর স্কুল-কলেজ ঢাকাতেই। তবে তাঁর জীবনে বাবার আদর-ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ মেলেনি খুব একটা। 

‘আমি আমার বাবাকে ওভাবে দেখিনি। আমার বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন আমার বাবা মারা যান। তিনি ব্রিটিশ আর্মিতে কাজ করতেন। পরে পাকিস্তান রেলওয়েতে কাজ করেন। ১৯৬৩ সালে উনি মারা যান। বাবার স্নেহ মিস করেছি জীবনে। বাবার পরে যে ব্যক্তি ছিলেন, তিনি আমার মামা। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরে মারা যান।... ছোট মামার কাছেই বড় হয়েছি।’

তবে সব মিলিয়ে এখন সুখী পরিবারের এক অনন্য উদাহরণ যেন তাঁরা। স্ত্রী চাকরি করেন; আছেন শিক্ষকতা পেশায়। বড় ছেলে পড়াশোনা শেষ করে এখন তাঁর সঙ্গেই ব্যবসা দেখাশোনা করেন। ছোটরা যার যার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। আরেক ভাই আছেন, তিনি থাকেন কানাডায়।

পরিবারের ছায়া হয়ে রয়েছেন তাঁর মা। তিনি কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন। এখনো গোছানো এক মানুষ। হুমায়ুন রশিদের জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণাও মা-ই। 

প্রাণপ্রিয় মাকে নিয়ে হুমায়ুন রশীদের যখন এমন ভাবনা, তখন তাঁর মা-ই বা কী ভাবছেন ছেলেকে নিয়ে।

শুনতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু রান্না করাই তাঁর শখ। রান্নার হাত এত ভালো যে শ্বশুরবাড়ি গেলেও সবার আবদার মেটাতে কখনো কখনো তাঁকেই রান্না করতে হয়।

বাবার মৃত্যুর ধকলটা মামারা লাঘব করে দিলেও তাঁর পড়াশোনায় ছেদ পড়ে যায়। এসএসসি, এইচএসসির পর বিএ পাসও করেন কোনোমতে। তবে ভালোভাবে পড়াশোনার অভাবটা পুষিয়ে নিতে অংশ নিতেন নানা রকম ট্রেনিংয়ে। এখনো সুযোগ পেলে অংশ নেন। আর এভাবেই বুঝতে শিখেছেন পুঁথিগত বিদ্যার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি ভালো কিছু করতে হলে প্রকৃতি থেকেও শিখতে হয়।

ডিগ্রিতে পড়া অবস্থায়ই ব্যবসায় হাতেখড়ি তাঁর। ট্রান্সফরমারের ব্যবসা। সেখান থেকে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ১৯৮৫ সালে। একসময় মনে হলো, আমদানি না করে নিজেরাই তৈরি করলে কেমন হয়। যে-ই কথা সে-ই কাজ। সফলতাও আসে। ১৯৯১ সালে শুরু হয় নতুন যাত্রা।

এখন ভাবলেই শিহরণ জাগে, ভালো লাগে তাঁর। তাঁদের উৎপাদিত পণ্য এখন দেশের বাইরেও রপ্তানি হয়, আর সেখানে লেখা থাকে বাংলাদেশের নাম। তবে শুরুটা ছিল বেশ কঠিন। পুঁজি ছিল মাত্র দুই হাজার টাকা।

বিশ্বাস করেন, ব্যবসায় টাকা নয়, সাহস আর সদিচ্ছাই আসল। তবে বুঝতে হবে টাকাটা উঠে আসবে কি না। নিজের বেলায় এসব ভেবেই এগিয়েছেন। সভ্যতার যতই উন্নতি হোক, তিনি যেসব পণ্যের ব্যবসা করেন, তার চাহিদা থাকবেই।

তাঁর কাছে ব্যবসার মূলধন হলো কথা দিয়ে তা রাখা। হোক তা নিজের সঙ্গে কি অন্যের সঙ্গে। দেশের জন্য কিছু করার চিন্তাভাবনাটাও থাকতে হবে। লক্ষ্যটা ঠিক রাখতে হবে। শিখতে হবে চারপাশ থেকে। 

তাঁর ব্যবসা মূলত ইলেকট্রনিকস পণ্যের। এখন তিনটি কারখানায় কাজ হয়। ভারত, লাওস, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে সেসব পণ্য রপ্তানিও হয়। সামনে আরো বাড়ানোর ইচ্ছা আছে। তাতে মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আর তা করতে পারার মধ্যেও আলাদা একটা তৃপ্তি আছে।

তাঁর প্রতিষ্ঠানে এখন প্রায় হাজার পাঁচেক কর্মী আছেন। তাঁদেরও নানা রকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন, দেশে কখনো-সখনো, বিদেশেও। তাঁদের সুযোগ-সুবিধাগুলোও দেখেন গুরুত্ব দিয়ে।

তাঁর প্রতিষ্ঠানে সবাই বন্ধুর মতো। মিলেমিশে কাজ করেন সবাই। তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন, যেকোনো সাফল্যের জন্য টিমওয়ার্কটাই আসল। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে বিশেষ আয়োজনও থাকে তাঁর প্রতিষ্ঠানে।

তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোতে দিনের আলোতেই সব কাজ সেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়। যেন রাতের আঁধারে বিদ্যুৎটা কাজে লাগে প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো মানুষের। আর তাঁর ইচ্ছা আছে এমন একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যেখান থেকে তরুণরা নানা রকম প্রশিক্ষণ পাবে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো কিছু করার আগ্রহ তৈরি হবে। মনেপ্রাণে চান, তাঁর মৃত্যুর আগে এমন একটি দিন আসুক, যেদিন দেশে আর কোনো বেকার থাকবে না।