অধ্যাপক মলয় ভৌমিকের প্রথম বেতন ৭৫০ টাকা

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যকার, নির্দেশক ও শিক্ষাবিদ মলয় ভৌমিক। পেশায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক হলেও নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবেই বেশি পরিচিত। নাটকে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত অনুশীলন নাট্যদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাংলাদেশে পথনাটক আন্দোলন, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে মুক্ত নাটক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাও। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে ৭ নং সেক্টরের অধীনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

অধ্যাপক মলয় ভৌমিক ১৯৫৬ সালের ১ মে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার কানসোনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্রয়াত শিবেন্দ্রনাথ ভৌমিক ছিলেন কলেজ অধ্যক্ষ ও মা নিয়তি ভৌমিক গৃহিণী। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তাঁর অবস্থান তৃতীয়।

যখন মলয় ভৌমিক মুক্তিযুদ্ধে যান তখন সবেমাত্র ক্লাস টেনে উঠেছেন। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর ১৯৭২ সালে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সলপ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। তারপর সিরাজগঞ্জের বেলকুচি কলেজে তাঁর কলেজজীবন শুরু হয়। তাঁর বাবাও একই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি এইচএসসি সম্পন্ন করেন। ভালো ছাত্রের মতো প্রথম বেঞ্চে বসে ক্লাস করা কিংবা প্রথাগত পড়ালেখা তিনি কখনো করেননি। ছোটবেলা থেকেই তাঁর শিক্ষাজীবন সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে কেটেছে।

কবিতা আবৃত্তি, নাটকে অভিনয়সহ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাঁর বিচরণ স্কুলজীবন থেকে। কলেজজীবনেও তিনি নাটকে অভিনয় ও নির্দেশনা দিয়েছেন।  কলেজের রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী উৎসবে অংশ নিয়ে বড় বড় চিত্রকর্ম আঁকতেন। এমনকি কলেজের সরস্বতী পূজায় নিজেই মৃৎশিল্পী হয়ে প্রতিমা তৈরি করে দিতেন। তিনি এগুলোকে লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতেন না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আরো বেড়ে গেল। বাংলা গানের প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর ছিলেন তাঁর বন্ধু। এন্ড্রু কিশোর কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইলে মলয় ভৌমিক সেখানে উপস্থাপনা করতেন। পড়ালেখার পাশাপাশি ১৯৭৭ সাল থেকে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। প্রথমে দৈনিক সংবাদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, পরে  রাজশাহী প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৫ সালে ব্যবস্থাপনা বিভাগে বিকমে (সম্মান) ভর্তি হন। ১৯৭৭ সালে উচ্চতর দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থানে বিকম (সম্মান) সম্পন্ন করেন। পরের বছর একই বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানে এমকম সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায় নিয়মিত ক্লাস করতেন না। ক্লাসের বাইরের কার্যক্রম তাঁকে খুব অল্প পড়ালেখা করেই সব বিষয় সহজে আয়ত্ত করতে সাহায্য করেছে।

মলয় ভৌমিক চাকরিজীবন শুরু করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮২ সালে ব্যবস্থাপনা বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। তাঁর কর্মজীবনের প্রথম বেতন ছিল ৭৫০ টাকা।

নিজের শিক্ষা ও কর্মজীবন সম্পর্কে মলয় ভৌমিক বলেন, ‘স্কুলজীবন থেকেই চার দেয়ালের শিক্ষা আমাকে টানত না। বাইরের কর্মকাণ্ডের বিচরণ করায় আমি কম পড়ালেখা করেই আয়ত্ত করতে পারতাম। শিক্ষার ক্ষেত্রে রেজাল্টের কোনো মূল্য নেই। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হলো সমাজের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া। ছাত্ররা পড়ালেখার পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ছাত্র সংসদে যুক্ত হলে শিক্ষাসমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। ছাত্রজীবনে আমি সেই কাজগুলোই করেছি এবং শিক্ষক হওয়ার পরেও সেগুলো অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু এখন আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জ্ঞানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন চার দেয়ালের শিক্ষা মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্ররা সহশিক্ষা কার্যক্রমে বিমুখ হয়ে পড়েছে। এ জন্য আমি ছাত্রদের দায়ী করব না। আমাদের শিক্ষক এবং শিক্ষাব্যবস্থা এর জন্য দায়ী। জ্ঞানশিক্ষা রেজাল্টের সাথে সম্পর্কিত নয়। এই যে শিক্ষার পাশাপাশি আমি যে কাজগুলো করেছি, এ ধরনের শিক্ষা দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।’

১৯৮৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক জোট প্রতিষ্ঠিত হলে দীর্ঘ সাত বছর (১৯৮৪-১৯৯৩) মলয় ভৌমিক জোটের আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মুক্ত নাটক দলের জাতীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। আইটিআই (ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট) বাংলাদেশ কেন্দ্রের অন্যতম নির্বাহী সদস্য তিনি। ২০১০ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য। তিনি ইনস্টিটিউট অব কালচার অ্যান্ড থিয়েটার ফর ডেভেলপমেন্টের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। তিনি এ পর্যন্ত অসংখ্য নাটক রচনা-নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন। বর্তমানে তিনি অনুশীলন নাট্যদলের দলপ্রধান।

মলয় ভৌমিক ১৯৯২ সালে ঢাকার লোক নাট্যদল নাট্যকর্মী পদক প্রদান করে। ২০০৮ সালে মুনির চৌধুরী সম্মাননা ও ২০০৯ সালে আরণ্যক নাট্যদল কর্তৃক আরণ্যক দীপু স্মৃতি পদক, ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ আরো অনেক সম্মাননাপ্রাপ্ত হন।

ব্যক্তিজীবনে এত অর্জনের পরও এ প্রাজ্ঞজন নিজেকে সফল ভাবেন না মলয় ভৌমিক। তিনি মনে করেন, মানুষ একা সফল হতে পারে না।

মলয় ভৌমিক বলেন, ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক সফলতার চিন্তা সমাজের সামগ্রিক মঙ্গল থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাফল্য অর্জিত হয় যখন আমরা সবাই মিলে সফল হই। আমাদের মধ্যে যখন মানবিকতাবোধ জাগ্রত হবে এবং মানুষে-মানুষে বৈষম্য থাকবে না, তখন আমরা সবাই মিলে সফল।’ তিনি এখনো সেই আশায় আছেন, যখন মানুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকবে না, মানুষের ভেতরে মানবিক গুণাবলী ও সহমর্মিতা জাগ্রত হবে।

বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘ক্যারিয়ার’ গঠনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ। তিনি মনে করেন, ক্যারিয়ার বলতে কেবল নির্দিষ্ট কিছু চাকরিকে তরুণদের বোঝানো হচ্ছে। ফলে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। এমন ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষ থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করছে। কিন্তু কোনো মানবীয় গুণাবলী অর্জন করছে না। এতে আসলে ক্যারিয়ার তৈরি হচ্ছে না।

তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে মলয় ভৌমিক বলেন, ‘একজন যদি মানুষের মতো মানুষ হয় এবং তার মধ্যে যদি সব মানবীয় গুণাবলী থাকে, তাহলে আর কিছুই লাগে না। আমরা কতগুলো পেশাকে সামনে নিয়ে বলছি, এসবই ক্যারিয়ার। বিচ্ছিন্নভাবে ক্যারিয়ার হয় না। বিসিএস পরীক্ষায় প্রতিবছর প্রায় চার লাখ ছাত্র পরীক্ষা দেয়, কিন্তু চাকরি পায় তিন থেকে চার হাজার জন। যারা প্রস্তুতি নিচ্ছে, তারা তো সবাই চাকরি পাবে না। কিন্তু বছরের পর বছর আরো নতুন ছাত্র যোগ হচ্ছে বিসিএসে। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একটা সময় পর তারা হতাশ হয়ে পড়ে। আমাদের ছাত্রদের মধ্যে এই অদ্ভুত জিনিসটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা দেশ ও মানুষ নিয়ে ভাবে না। এতে আজকাল ছাত্রদের মধ্যে যোগ্য নেতৃত্বও তৈরি হচ্ছে না।’

উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মলয় ভৌমিক বলেন, ‘কেন ছাত্রদের বিসিএসেই যেতে হবে? কেন তাদের মনে হয় না, তারা জমিতে কৃষিকাজ করবে? কেবল রেজাল্ট দিয়েই ক্যারিয়ার তৈরি হয় না। আমাদের যারা ক্রিকেট খেলোয়াড়, তাদের কয়জনের ভালো রেজাল্ট রয়েছে? ক্যারিয়ার গঠনে তরুণ প্রজন্মকে মানুষের সঙ্গে মিশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে হবে।’

দুঃখ-দুর্দশাকে জীবনের অংশ ভেবে প্রস্তুতি নিতে হবে উল্লেখ করে মলয় ভৌমিক বলেন, ‘জীবনের সুখ-দুঃখের উপস্থিতি দরকার হয়। অনেক সময় হয়তো দুঃখ পেতেও ভালো লাগে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে হয়ত এমনটা হয়। অর্থাৎ, মানুষের মধ্যে একটি দ্বন্দ্বমূলক অবস্থান আছে। মানুষের এক মন যদি বলে হ্যাঁ, তাহলে অন্য মন বলবে না। এই সত্যটাকে যদি মেনে নেয়, তাহলে মানুষের জীবনে দুঃখ আসবে, বেদনা আসবে, আবার সুখও আসবে। এভাবে চিন্তা করে প্রস্তুতি নিলে দুঃখ-বেদনার প্রভাব হালকা হয়ে যায়।’