মাত্র ১০ টাকায় সহজেই মিলবে স্যানিটারি প্যাড
বেলা ৬টা। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমের আকাশে। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। আবির রঙের আলোর মাখামাখি টিএসসির পায়রা চত্ত্বরে। কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও এসিআই ফ্রিডমের যৌথ উদ্যোগে স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠান। এ কার্যক্রমের প্রধান দুই উদ্যোক্তা হলেন ডাকসুর সদস্য তিলোত্তমা সিকদার ও ফরিদা পারভীন।
অপেক্ষা করছিলাম এ দুই উদ্যমী ও সাহসী নারীর সঙ্গে কথা বলার জন্য। গাঢ় গোলাপি আর নীল কমলা পাড়ের শাড়ি পরা হাসিমাখা মিষ্টি দুই মুখ নেমে এলেন মঞ্চ থেকে। দেখালেন ভেন্ডিং মেশিনের ব্যবহার। বেগুনি মেশিনে দিলেন ১০ টাকা। সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে এলো একটি স্যানিটারি প্যাড। এটিএম মেশিনে যেমন সহজে টাকা বের হয়, ঠিক সে রকম!
‘ট্যাবু ভেঙে যাক’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১০টি জায়গায় বসানো হয়েছে ভেন্ডিং মেশিন। মাত্র ১০ টাকায় যেকোনো সময়ে সেখান থেকে স্যানিটারি প্যাড সংগ্রহ করতে পারবে মেয়েরা।
উদ্যোগটির উদ্দেশ্য কী, জানতে চাইলে তিলোত্তমা বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও ‘ফ্রিডম’-এর যৌথ উদ্যোগে কিছুক্ষণ আগে আজ ( বুধবার) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হলো ‘ফ্রিডম হাইজিন কর্নার’। এখানে আমরা ১০ টাকা দিলে একটি মেশিন থেকে একটি প্যাড পাব, যার বাজারমূল্য রয়েছে ১৪ টাকা। আমরা দেখেছি, আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এই বিষয়টিকে ট্যাবু হিসেবে ধরা হয়। আমি চাই, ডাকসুর পক্ষ থেকে এই আহ্বান জানতে যে সমাজের এই ট্যাবুকে ভেঙে জনসচেতনতা তৈরি করা হোক। প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর খুব প্রয়োজন রয়েছে। আমরা চাই সমাজের সব স্তরে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।”
এই কার্যক্রমের আরেক উদ্যোক্তা ফরিদা পারভীন। তিনিও ডাকসুর সদস্য। তিনি বলেন, ‘আমরা স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিনের কার্যক্রমটি নিয়েছি। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ থেকে ১৮ হাজার শিক্ষার্থী নারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের যেন স্বাস্থ্যের হানি না ঘটে, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আমরা এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি। এখন ১০টি ভেন্ডিং মেশিন আনা হয়েছে। পরে আমরা আরো ১০টি ভেন্ডিং মেশিন নিয়ে আসার চেষ্টা করব।’
‘শুধু ঢাবি না, এটা সবার জন্য’
ফরিদা জানালেন, এটি হচ্ছে ফ্রিডম হাইজিন কর্নারের স্যানিটারি ন্যাপকিনের একটি ভেন্ডিং মেশিন। এর মাধ্যমে মেয়েরা ১০ টাকা দিয়ে একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন পাবে। এখানে যেই মেশিনটি রয়েছে সেটি দেশের বাইরে থেকে নিয়ে আসা হয়েছে।’
এ সেবা কি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, নাকি বাইরের মেয়েরাও ব্যবহার করতে পারবে জানতে চাইলে তিলোত্তমা বলেন, ‘১০ টাকার নোট মেশিনে দিলে আপনি একটি প্যাড পাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব শুভ উদ্যোগের সূচনা গ্রহণ করে। এখন নতুন একটি বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হচ্ছে, সেটি হলো ফ্রিডম হাইজিন কর্নার। এটি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই সেবাটি ছড়িয়ে যাক দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি জায়গায় এটি রয়েছে। আমরা চাই, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে সেই দাবিটি জানাচ্ছি।’
যেসব জায়গায় ভেন্ডিং মেশিন
ঢাবির যেসব জায়গায় ভেন্ডিং মেশিন বসানো হয়েছে, সেগুলো হলো—টিএসসি, কলাভবনের ছাত্রী কমনরুম, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, বিজ্ঞান গ্রন্থাগার, চারুকলা অনুষদ, রোকেয়া হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হল, বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হল, শামসুন নাহার হল ও সুফিয়া কামাল হল।
তিলোত্তমা বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই উদ্যোগটি প্রথম গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এই ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য খুবই আগ্রহী।’
উদ্যোগটি বেঁচে থাকবে তো?
তিলোত্তমা বলেন, ‘সব জিনিসেরই একটি ক্ষয় রয়েছে। এই মেশিনটিরও অবশ্যই একটি ক্ষয় রয়েছে। তবে আমাদের এই মেশিনটি ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। কারণ, এটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ। আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থী এটি সচেতনভাবে ব্যবহার করবে।’
মেশিনটির দেখাশোনা কীভাবে করা হবে, জানতে চাইলে তিলোত্তমা বলেন, ‘এসিআই ফ্রিডম- এর সহায়তায় আমরা এই উদ্যোগটি গ্রহণ করেছি। আমাদের যে ব্যবস্থাপনা রয়েছে প্রত্যেকটিতে প্রথম এক মাসে একজন মেয়ে থাকবে ফ্রিডমের পক্ষ থেকে। তিনি এটি সার্বিকভাবে দেখাশোনা করবেন। বলবেন, কতগুলো স্যানিটারি প্যাড লাগতে পারে। সেটি অনুযায়ী প্রত্যেক সপ্তাহে এসিআইর পক্ষ থেকে এটি রিফিল করা হবে। তারাও তত্ত্বাবধায়নে থাকবে। ডাকসুও তত্ত্বাবধায়নে থাকবে। প্রতিটি মেশিনের পাশে একটি হেল্পলাইন নম্বর দেওয়া থাকবে। এই নম্বরে ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে মেশিন সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য ও সমস্যার সমাধান করা হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর রক্ষাণাবেক্ষণকে দায়িত্ব মনে করি জানিয়ে ফরিদা পারভীন বলেন, ‘আশা করি, এটি সুরক্ষার মধ্যে থাকবে।’
‘কম টাকায় প্যাড পাব, সাধুবাদ জানাই’
উদ্যোগটি সম্পর্কে ঢাবির ছাত্রী রেশমী সাফিহা রিমি বলেন, ‘মেয়েদের সুবিধার্থেই যেহেতু এটি ভেন্ডিং মেশিন বসানো হয়েছে, তাই একে ইতিবাচকভাবে দেখছি। এই ব্যবস্থার ফলে আমাদের অনেক উপকার হবে।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মোছা. সালমা আকতার বলেন, ‘১০টি জায়গায় মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকে আমরা স্যানিটারি প্যাড নিতে পারব। দামও কম। কম টাকায় আমরা এটি পাব। বিষয়টিকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই।’
একই বিভাগের ছাত্র এনামুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বন্ধু-বান্ধবীরা, বোনেরা এই সেবাটি পাবে। অবশ্যই এটি খুব ভালো উদ্যোগ। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সেবাটি ছড়িয়ে যাক, এই আশা করি।’