সাক্ষাৎকারে শফিউল আলম ভূইয়া

‘শিক্ষার পরিবেশ সমুন্নত রাখতে উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক অদ্বিতীয়’

Looks like you've blocked notifications!

অধ্যাপক ড. এ জে এম শফিউল আলম ভূইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য শফিউল আলম ভূইয়া ঢাবি শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো :

এনটিভি অনলাইন : অনেকেই বলছেন, দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে গৌরব হারাতে বসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

ড. শফিউল আলম ভূইয়া : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি অনিয়ম হয়, তবে এর দায় সিন্ডিকেট সদস্যরা এড়াতে পারেন না। কারণ তাঁরাই এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন যাঁরা তুলছেন, সেই সিন্ডিকেট সদস্যদেরই সবার আগে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। যেমন, বর্তমান উপার্চায়ের আগে আগে এস এম এ ফায়েজ স্যার যখন উপাচার্য ছিলেন, তখন কিছু নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সে কারণে তখনকার সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. রহমতুল্লাহ পদত্যাগ করেছিলেন। আপনি অন রেকর্ড রহমতুল্লাহ স্যারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। সম্প্রতি তিনি একটি টেলিভিশনে বলেছেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়মের কারণে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে না নেওয়ায় তিনি সিন্ডিকেট থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন।

এনটিভি অনলাইন : আপনি বলতে চাইছেন, আগের সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে বর্তমানের কিছু সিন্ডিকেট সদস্যের নৈতিক দিক থেকে পার্থক্য আছে?

শফিউল আলম ভূইয়া : হ্যাঁ। লক্ষ করে দেখবেন, বর্তমানে অনেক সিন্ডিকেট সদস্য অনিয়মের অভিযোগ তুলছেন, কিন্তু তাঁরা পদত্যাগ করেননি। অভিযোগকারীদের মধ্যে দুজন সিন্ডিকেট সদস্য আছেন, যাঁরা গত সাড়ে আট বছরে নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন, ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, বিভাগের চেয়ারম্যানও ছিলেন, নতুবা নিয়োগ বোর্ডে এক্সপার্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা ঢালাওভাবে অনিয়মের অভিযোগ করছেন। আপনি জিজ্ঞেস করুন, তাঁরা কয়বার আপত্তি তুলেছেন কিংবা আদৌ আপত্তি করেছিলেন কি না? তাহলে আজকে পত্রপত্রিকায় তাঁরা যেসব কথা বলছেন, এটা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে বলছেন, নাকি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য—এ প্রশ্নটা তাঁদের করতে হবে।

এনটিভি অনলাইন : গত সাড়ে আট বছরে ৯০৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, অনেককে নিয়োগ দিতে ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ করা হয়নি, যোগ্যতা শিথিল করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

শফিউল আলম ভূইয়া : প্রথমে বলি, এই প্রশাসনের সময়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়া কোনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও তিনি একটি নিয়োগও দেননি। বলা হচ্ছে, যোগ্যতা শিথিল করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকতে হবে। আপনি বললেন, গত সাড়ে তিন বছরে সাড়ে ৩০০ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এই হিসাবটা আপনাদের রাখতে হবে, কতজন শিক্ষক গত সাড়ে আট বছরে অবসরে গেছেন। এটা কি পদের বাইরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে? অবশ্যই না। পদ খালি থাকা সাপেক্ষেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদ খালি হলে বিভাগগুলো তাদের চাহিদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানায়। এরপর প্রশাসনের পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। নিয়োগে কী কী শর্ত থাকবে, সেটা ঠিক করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তখন সেই শর্ত এবং সিন্ডিকেটের শর্তগুলো সামগ্রিকভাবে বিচার করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এরপর শর্ত পূরণ সাপেক্ষে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।

নিয়োগের ক্ষেত্রে উপাচার্যের ভূমিকা কিন্তু অতি গৌণ। কেন গৌণ? কারণ আমাদের নিয়োগটা প্রথমে চূড়ান্ত করে সিলেকশন কমিটি। সেই সিলেকশন কমিটির সভাপতিত্ব করেন, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা)। বর্তমানে যিনি উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) আছেন, তিনি এতে সভাপতিত্ব করেন এবং তাঁর আগে যিনি উপ-উপাচার্য ছিলেন, তিনিও সভাপতিত্ব করতেন। এই গত সাড়ে আট বছরে কিন্তু দুজন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন বর্তমান উপ-উপাচার্য, আরেকজন বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। উপ-উপাচার্যের নেতৃত্বাধীন নিয়োগ কমিটিতে থাকেন বিভাগের চেয়ারম্যান, থাকেন ডিন, সিন্ডিকেট সদস্য এবং একজন এক্সপার্ট। এই পাঁচজনের কমিটি প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেন। এই সিলেকশন কমিটি যখন সর্বসম্মতভাবে সুপারিশ করে, তখন সিন্ডিকেট এটাকে পাস করে।

এখন প্রশ্ন সিন্ডিকেটে কারা কারা থাকেন? সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি, প্রভাষক ক্যাটাগরি থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি, ডিনদের নির্বাচিত প্রতিনিধি, প্রাধ্যক্ষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি, সরকারি প্রতিনিধি, শিক্ষা সচিব থেকে শুরু করে সবাই থাকেন এখানে। উপ-উপাচার্য থাকেন এবং উপাচার্য সভাপতিত্ব করেন। সিন্ডিকেট সর্বসম্মতিক্রমেই এই নিয়োগগুলো দিয়েছে। আপনি যদি কাউকে দায়ী করতে চান, তাহলে তো এই সিলেকশন কমিটি, সিন্ডিকেটসহ সবাইকে দায়ী করতে হবে। এককভাবে কাউকেই দায়ী করা যাবে না।

এবারে আসি, নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে কি না? কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, কোথাও কোথাও শর্ত শিথিল করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শর্ত শিথিল কোথায় করা হয়েছে? প্রথম কথা হচ্ছে, শর্ত শিথিলের বিষয়টি বিভাগ থেকেই বলা হয়েছে। এর পেছনেও কারণ আছে। অনেক নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষক হতে গেলে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.২৫ ও ৪.২৫ এবং অনার্স ও মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৫ ও ৩.৫ এবং ব্যবসায় অনুষদে ৩.৭৫ সিজিপিএ লাগবে। এই যে নিয়ম, এটাও কিন্তু বর্তমান উপাচার্যের সময় করা হয়েছে। আগে কিন্তু অনার্স বা মাস্টার্সে একটা প্রথম শ্রেণি থাকলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়া যেত।

এখন, কোথায় শর্ত শিথিল করা হয়েছে? যখন একজনকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় তখন মূল ফোকাসটা কোথায় থাকে? আমরা কি স্কুল-কলেজের ফলাফলকে গুরুত্ব দেবো? নাকি অনার্স বা মাস্টার্সের? কারণ আপনি তো শিক্ষকতা করবেন, যে বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। অনার্স ও মাস্টার্সে কি কোনো শর্ত ভঙ্গ হয়েছে? দু-এক জায়গায় শর্ত শিথিল করা হয়েছে কোথায়? ধরুন, একজন প্রার্থী অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, দুর্ভাগ্যক্রমে এসএইসি ও এইচএসসিতে ৩.৯০ বা ৪.১০ এ রকম। এ রকম দু-এক জায়গায় হয়তো শর্ত শিথিল করা হয়েছে।

এই শর্ত শিথিলের পেছনেও অনেক সময় কারণ থাকে। দেখা গেল, একজন প্রার্থী অনার্স-মাস্টার্সে ভালো ফল করেছেন, তাঁর পাবলিকেশন আছে, অন্যত্র শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আছে এবং ইন্টারভিউ বোর্ডে ভালো করেছেন। এই সমগ্র কিছু বিবেচনা করে হয়তো তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যদি শুধু প্রথম শ্রেণিতে প্রথমকেই প্রাধান্য দিই, তাহলে তো আর সিলেকশন কমিটি থাকার দরকার নেই। বিভিন্ন বিভাগে যাঁরা প্রথম হবেন, পদ ফাঁকা থাকার সাপেক্ষে তাঁরা শিক্ষক হবেন—তাহলেই তো সমস্যা মিটে গেল। বাস্তবে তো এমনটি হয় না। শিক্ষকতার জন্য ফল যেমন জরুরি, তেমনি তাঁর প্রেজেন্টেশন, শ্রেণিকক্ষে শির্থীদের বোঝানোর দক্ষতাও জরুরি। অনেকে কিন্তু ভালো গবেষক, কিন্তু ক্লাসে ভালো পড়াতে পারেন না। আপনি যদি ভালো পড়াতে না পারেন, তাহলে আপনাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বা ছাত্রছাত্রীদের কী উপকার হবে?

নতুন কিছু কিছু বিভাগে শিক্ষকের সংকট খুবই তীব্র। সেখানে বিভাগের, ছাত্রছাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে এসএসসি-এইচএসসির যোগ্যতা হয়তো দু-এক জায়গায় শিথিল করা হয়ে থাকতে পারে। যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ার কারণে এমনটা হতে পারে।

অন্যদিকে প্রপাগান্ডা কীভাবে ছড়ানো হচ্ছে দেখুন। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে বিএসসি পাস তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের মাস্টার ডিগ্রি নেই। তাঁদের নিয়োগের পেছনে বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগটা ছিল দুর্বল। এটাকে এক্সপাঞ্জ করার জন্য ওই বিভাগই সুপারিশ করেছে, ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তিন বছর ধরে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, কিন্তু কোনো এমএসসি পাস ইঞ্জিনিয়ার আবেদন করেননি। প্রার্থী না পাওয়ায় শর্ত সাপেক্ষে বুয়েট থেকে বিএসিস পাস করা তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আপনি কি জানেন, বুয়েটে বিএসসি ডিগ্রিধারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। বুয়েটে প্রভাষকরা যোগ দেন বিএসসি পাস করে। মেডিকেলে চিকিৎসকরা যোগ দেন এমবিএস পাস করে। এগুলো সবই স্নাতক ডিগ্রি, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নয়। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে তিনজনকে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং শর্ত দেওয়া হয়েছে তাঁরা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলে স্থায়ী করা হবে। বুয়েটে যেখানে ইঞ্জিনিয়াররা বিএসসি পাস করে যোগ দিতে পারেন, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়াররা বিএসসি করে যোগ দিতে পারবেন না কেন? প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে বলা হচ্ছে, সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটির (সিএমবি) অনুমতি না নিয়ে এটা করা হয়েছে। আমার কাছে তথ্য-প্রমাণ আছে, আপনারা চাইলে পড়ে দেখতে পারেন। সিএমবিতে স্পষ্ট বলা আছে, এমএসসি না পাওয়া গেলে শর্তসাপেক্ষে বিএসসি নেওয়া যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় তো সেটাই করেছে।

এনটিভি অনলাইন : সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেছেন উচ্চ আদালত। তাহলে কি অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল?

শফিউল আলম ভূইয়া : ওই শিক্ষকের নাম খন্দকার তোফায়েল আহমেদ। তাঁর ব্যাপারে পুরো তথ্য গণমাধ্যমে আসেনি। আমরা দেখেছি, শুধু বলা হয়েছে তিনি উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ৪.২৫-এর চেয়ে কম পেয়েছেন। কিন্তু তোফায়েল আহমেদ স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফল প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয়। এই তথ্য কি কেউ উল্লেখ করেছে? এখন আদালত একটা রায় দিয়েছেন, আদালতের রায় নিয়ে আমি কোনো প্রশ্ন তুলতে চাই না। মহামান্য আদালত যেটা ভালো মনে করেছেন, সেটা করেছেন। কিন্তু মূল তথ্যটা তো আমরা জানতে পারিনি। সে ক্ষেত্রে স্নাতক, স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় ফলাফলধারীকে নিয়োগ দেওয়া কি অনিয়ম? তাঁর নিয়োগ হয়েছিল শর্ত মেনেই। তিনি তো আর উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াতে যাবেন না। তিনি দর্শন পড়াবেন শিক্ষার্থীদের। দর্শনে তো তিনি অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড। সে ক্ষেত্রে তাঁর এসএসসি ও এইচএসসির ফল মুখ্য হতে পারে না।

এনটিভি অনলাইন : এই তথ্য তো গণমাধ্যমে সেভাবে আসেনি...

শফিউল আলম ভূইয়া : তার মানে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রতিবেদনগুলো করা হচ্ছে।

এনটিভি অনলাইন : এবার ডাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গে আসা যাক। দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু নির্বাচন বন্ধ থাকায়, সিনেটে যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব, সেটার অনুপস্থিতি থেকে যাচ্ছে।

শফিউল আলম ভূইয়া : ১৯৯০ সালের পর থেকে ডাকসু নির্বাচন হয়নি। কেন হয়নি? নিশ্চয় বিভিন্ন উপাচার্য চেষ্টা করেছিলেন। বর্তমান উপাচার্যও চেষ্টা করেছেন। যখনই ডাকসু নির্বাচনের প্রশ্ন আসে, তখন তো রাজনৈতিক দলগুলোর সহাবস্থানের প্রশ্নটা আসবে। এখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বা আমাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে কি সহাবস্থানের সংস্কৃতি ক্যাম্পাসে আছে? নাই। এদিকে অনেক বছর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় যে একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি, সেশনজট যে দূর করা হয়েছে; এখন এই ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাস পরিস্থিতি যদি অস্থিতিশীল হয়, তাহলে তো শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হবে। যদি শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হয়, তাহলে এটা কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মঙ্গলজনক হবে? এটা একটা দিক।

দ্বিতীয় দিক হলো, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠনগুলো যদি ঐকমত্যে আসতে পারে, তারা পরস্পরের সঙ্গে সুন্দর সহাবস্থানে থাকবে, তাহলে কিন্তু ডাকসু নির্বাচন হতে বাধা নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, ডাকসু নির্বাচন হোক। সেটার জন্য পরিবেশ তৈরি করা দরকার। এবং সেটা আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু অবশ্যই আমার একাডেমিক, শিক্ষার পরিবেশটাকে অক্ষুণ্ণ রেখে ডাকসু নির্বাচন করতে হবে।

যাঁরা অভিযোগ করছেন, আমার প্রশ্ন তাঁদের কাছে, অভিযোগ করার মতো নৈতিক ভিত্তি কি তাঁদের আছে? যেমন অভিযোগকারীদের একজন সম্পর্কে আমি গণমাধ্যমে দেখেছি, উনি তাঁর ইনস্টিটিউটের নারী সদস্যকে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন এবং তাঁর সেই নারী সহকর্মী উপ-উপাচার্যের (শিক্ষা) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সেই অভিযোগের এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। এ রকম আমি যদি অভিযোগকারীদের ধরি তাহলে দেখতে পাব, একজন বছরের পর বছর একাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়-সাতটা পদে আছেন। আরেকজন বছরের পর বছর বর্তমান উপাচার্যের আনুকূল্যে পদে আছেন, পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। কিন্তু তিনি অভিযোগ করে যাচ্ছেন। তাঁদের নৈতিকতা সম্পর্কে আমার প্রশ্ন আছে। তাঁরা যদি এই উপাচার্য, প্রশাসনকে একেবারে অন্যায়কারী হিসেবে চিহ্নিত করেন, তাহলে তাঁদের সবার আগে উচিত ছিল এই প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা।

এনটিভি অনলাইন : বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে বর্তমান প্রশাসনের কিছু সদস্য অনিয়মের অভিযোগ তুলছেন এবং একাধিক গণমাধ্যমে একই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু গত সাড়ে আট বছরে তাঁরা এগুলো তুলনেন না কেন?

শফিউল আলম ভূইয়া : এখন নিশ্চয় কেউ না কেউ উপাচার্য হতে চান। যাঁরা উপাচার্য হতে চান, তাঁদের লোকজনই হঠাৎ করে গণমাধ্যমে এই সংবাদগুলো নিয়ে আসছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই যে সিনেট নির্বাচন নিয়ে তাঁরা রিট করেছেন, সিনেটের যখন বাজেট অধিবেশন হলো তখন কিন্তু তাঁরা কেউ রিট করেননি। তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ২৫ জন সদস্য হলেই সিনেট বসতে পারে। কোরাম হলে বসতে পারে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেভাবে বাজেট অধিবেশন হলো এবং বাজেট অধিবেশন নিয়ে কেউ আপত্তি তুলল না। বাজেটের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ডাকসু প্রতিনিধি নেই, তখন কেউ প্রশ্ন তুলল না। কিন্তু যখন উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হলো, তখনই প্রশ্নটা তোলা হলো।

তার মানে হচ্ছে, উপাচার্য পদটাকে কেউ না কেউ দখল করতে চাইছেন। সেই উৎসাহীদের পরামর্শেই এ ধরনের ফরমায়েশি সাংবাদিকতা হচ্ছে। আমি প্রতিবেদন ধরে ধরে বলে দিতে পারব, কোন প্রতিবেদনের কোন তথ্যটা ভুল। আর এই প্রতিবেদনগুলো কিন্তু একপেশে। আমরা কী আশা করি, সাংবাদিকতার ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে গণমাধ্যমগুলো বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন করুক। বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন কী? বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন হলো, কেউ যদি অপরাধও করে থাকে, তাঁরও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রাখা। এই প্রতিবেদনগুলো পড়লে মনে হয়, বাইরে থেকে প্রতিবেদনগুলো কেউ না কেউ করে দিয়েছে। প্রতিবেদক শুধু তার জবানিতে সেগুলো বলে গেছেন। প্রতিবেদকরা যাচাই-বাছাই করেননি। যেমন, একটা তথ্য পাওয়ার পরে তা যাচাই-বাছাই করতে হয়, সেই কাজটা তাঁরা করছেন না। আমি চাই, বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিবেদন করা হোক। কিন্তু একপেশে সাংবাদিকতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা জাতীয় সম্পদ, জাতিকে দিকনির্দেশনা দেয়। এভাবে ফরমায়েশি সাংবাদিকতা দিয়ে আমরা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছি, এটা কিন্তু জাতির জন্য মঙ্গলজনক বার্তা বয়ে আনছে না।

এনটিভি অনলাইন : কয়েকজন সিন্ডিকেট সদস্য দাবি করেছেন, সিন্ডিকেট নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত নিয়োগ দিয়েছে। এটা কি সত্য?

শফিউল আলম ভূইয়া : যে সিন্ডিকেট সদস্যরা বলছেন নিয়ম ভেঙেছে, তাঁরাই কিন্তু গত সাড়ে আট বছরে সিন্ডিকেটে ছিলেন। তাঁরা কোন কত জায়গায় নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন? দিয়েছিলেন কি? আচ্ছা, ধরে নিলাম নোট অব ডিসেন্ট উপাচার্য শোনেননি। প্রতিবাদে তাঁরা কি পদত্যাগ করেছেন? করেননি এবং এখনো তাঁরা স্বপদে বহাল আছেন। বর্তমান প্রশাসনের বসানো পদে থেকে, সেটার অংশীদার হয়ে, আবার তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করা হচ্ছে। এর চেয়ে স্ববিরোধিতা আর কী হতে পারে?

এনটিভি অনলাইন : রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে অনেকে শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এটা কতটুকু সত্য?

শফিউল আলম ভূইয়া : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন, ইন্টারভিউ বোর্ডে ভালো করেছেন—এ রকম কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি, এমন কোনো রেকর্ড কি আছে? দ্বিতীয়ত, মাননীয় উপাচার্য তো নির্বাচন করেন না। যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁরা নির্বাচন করেন। ভোট দরকার হয় তাঁদের। উপাচার্যের তো ভোট দরকার নাই। তাঁরা ভোটে দাঁড়ান, ভোটে পাস করেন। অনিয়ম-স্বজনপ্রীতি যদি হয়ে থাকে, তাহলে সিন্ডিকেটে বসে তো তাঁরাই করেছেন। যে এক-দুজন সিন্ডিকেট সদস্য অভিযোগ করছেন, তাঁদের একজন দিনের পর দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টা পদে থেকেছেন, এখনো আছেন। একই পদে বারবার নির্বাচন করছেন। নির্বাচনে ভোট পাচ্ছেন, ভোটের জন্য তাঁরাই তো তাহলে মাননীয় উপাচার্যের কাছে সুপারিশ করেছেন।

এনটিভি অনলাইন : স্বচ্ছতা, জবাবদিহির ক্ষেত্রে বর্তমান উপাচার্যের ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন?

শফিউল আলম ভূইয়া : কোনো মানুষই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। বর্তমান উপাচার্যের সাফল্যের জায়গাটা কোথায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ক্লাস নিয়মিত হতো না। এখন নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষা হচ্ছে। সেশনজট দূর করা তাঁর এক বিরাট সাফল্য। দ্বিতীয়ত, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উনি অনেক নতুন নতুন বিভাগ চালু করেছেন। নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে এগুলো ভূমিকা রাখছেন। কারণ, বাংলাদেশে আর কোথাও এ রকম নতুন নতুন বিভাগ খোলার নজির নেই। এটা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোর উন্নয়ন। ছাত্রছাত্রীদের জন্য হল নির্মাণ, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা, আবার বিভাগ-অনুষদের জন্য নতুন নতুন ভবন করা। অবকাঠামোগত দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত উন্নয়ন আর কখনো হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গত সাড়ে আট বছরে রাজনৈতিক কারণে কোনো মারামারি, সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি, হলও বন্ধ হয়নি। বরং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন যখন কোনো অন্যায় করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু একাডেমিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সামগ্রিকভাবে শিক্ষার পরিবেশকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে বর্তমান উপাচার্য আনপ্যারালাল, অদ্বিতীয়। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, এ মুহূর্তে ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক উপাচার্য রাখা হবে না। তাহলে নতুন কাকে দেবো? আমি কিন্তু নতুন কোনো নাম বলতে পারব না। কারণ, উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক গত সাড়ে আট বছরে যে কর্মদক্ষতা দেখিয়েছেন, তার সঙ্গে তুলনীয় দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি আমি দেখতে পাচ্ছি না। তিনি অনেকের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠিনও করেছেন। তিনি দিনের পুরোটা সময় বলা যায়, দিন নেই, রাত নেই ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী যে কেউ যেকোনো সময়, যেকোনো সমস্যায় উনার কাছে যেতে পারে। তাঁর দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত। ধরেন, একজন হল প্রাধ্যক্ষ হিসেবে, হলে কোন ঝামেলা হলে, রাত ৩টায় ফোন করলে উনি কিন্তু ফোনটা ধরেন। মাঝেমধ্যে আমরা নিজেরাই প্রশ্ন করি, উনি ঘুমান কখন? এই যে ডেডিকেশন, এই একাগ্রতা আমরা আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে, হীন উদ্দেশ্যে কালিমা লিপ্ত করতে চাইছি। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। যাঁরা কালিমা লেপন করছেন, তাঁরাই উপাচার্যের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এখন এইভাবে তারা ফেরত দিচ্ছেন।

এনটিভি অনলাইন : তাহলে কে হবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী উপাচার্য?

শফিউল আলম ভূইয়া : আমরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট তিনজনের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করেছি। সেই প্যানেলের কার্যকারিতা মহামান্য আদালত আপাতত স্থগিত করেছেন। এখন আদালতের বিষয়টি আদালতে সুরাহা হবে। কিন্তু একজন সিনেট সদস্য হিসেবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি চাই, সিনেট যে প্যানেল নির্বাচন করেছে, সেই প্যানেল থেকে একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হোক। উপাচার্য নিয়োগ দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে মহামান্য রাষ্ট্রপতি। এখন তিনজনের প্যানেল, সেখানে উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নাম আছে, আছে কোষাধ্যক্ষ ড. কামালউদ্দিন ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবদুল আজিজের নামও। এই নামগুলো থেকে রাষ্ট্রপতি যাঁকে ইচ্ছা, তাঁকেই নিয়োগ দিতে পারেন। উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে দেবেন নাকি অন্য কাউকে দেবেন, এটা মহামান্য রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। আমরা চাই, সিনেটের যে প্যানেল, সেখান থেকেই একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হোক। আর এটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতি। এই রীতিনীতি যাতে ভঙ্গ না হয়, সেটাই আমরা চাই।

এনটিভি অনলাইন : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

শফিউল আলম ভূইয়া : এনটিভি অনলাইনকেও ধন্যবাদ।