অডিওটি আংশিক, ফোন দিয়েছিলাম সতর্ক করতে : রাবির প্রোভিসি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আইন বিভাগে প্রভাষক নিয়োগের নির্বাচনী বোর্ডে একজন আবেদনকারীকে অর্থের বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে উপ-উপাচার্য (প্রোভিসি) চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়ার কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়েছে। আবেদনকারীর স্ত্রীর সঙ্গে উপ-উপাচার্যের দরকষাকষির ওই অডিওতে তাঁকে টাকার বিষয়ে কথা বলতে শোনা গেছে।
তবে রাবি উপ-উপাচার্যের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি শিক্ষক নিয়োগে দরকষাকষির বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘আমার পুরো ফোনালাপকে এডিট করে আংশিক প্রকাশ করা হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটি করা হয়েছে। (আবেদনকারী) আমার এলাকার ছেলে হওয়ায় তাঁকে সতর্ক করতে ফোন দিয়েছিলাম।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে তিনটি প্রভাষক পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। এতে নুরুল হুদা নামের একজন আবেদন করেন। অডিও রেকর্ডে উপ-উপাচার্য জাকারিয়াকে নুরুল হুদার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে শোনা যায়। নুরুল হুদার স্ত্রীও আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।
আইন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আবেদনকারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নুরুল হুদা স্নাতকে সিজিপিএ ৩.৬৫ ও স্নাতকোত্তরে ৩.৬০ পান। এই ফল আইন অনুষদে সেরা হওয়ায় ২০১৭ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক এবং ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পান। তাঁর বাড়ি উপ-উপাচার্য জাকারিয়ার এলাকা লালমনিরহাটে।
জানা যায়, আইন বিভাগের তিনটি প্রভাষক পদের বিপরীতে আবেদন করেন মোট ৪১ জন। তাঁদের মধ্যে নয়জনের স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে সিজিপিএ ৩.৫০ বা এর ঊর্ধ্বে ফল রয়েছে। অন্যদিকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৩৩ জন আবেদনকারীর ফল ৩.৫০ বা এর ঊর্ধ্বে।
২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ নভেম্বর সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগ অনুমোদিত হয় এবং এর পরদিন ১৮ নভেম্বর নিয়োগপ্রাপ্তরা বিভাগে যোগদান করেন। নুরুল হুদা ভালো ফল অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক পেলেও আইন বিভাগে প্রভাষক পদে তাঁর নিয়োগ হয়নি।
নিয়োগে নির্বাচনী বোর্ডে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়াও ছিলেন বলেন জানিয়েছেন আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল হান্নান। তিনি বলেন, ‘নিয়োগ বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য রুস্তম আলী ও বিভাগের সভাপতি হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মণ্ডল ছিলেন।’
ফাঁস হওয়া ফোনালাপ
উপ-উপাচার্য : হ্যাঁ, তুজ সাদিয়া। আমি প্রফেসর জাকারিয়া (চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়ার), প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর।
চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রী : আসসালামু আলাইকুম, স্যার।
উপ-উপাচার্য : ওয়ালাইকুমুস সালাম। আচ্ছা মা, একটা কথা বলো তো, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা, তোমরা কয় টাকা দেওয়ার জন্য রেডি।
চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রী : স্যার, সত্যি কথা বলতে...
উপ-উপাচার্য : না না, সত্যি কথাই তো বলবা। উপরে আল্লাহতায়ালা, নিচে আমি।
চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রী : অবশ্যই, অবশ্যই। স্যার, আপনি যেহেতু তার অবস্থা জানেন, আরেকটা বিষয় এখানে স্যার, সেটা হচ্ছে, আপনি হুদার... মানে, এমনিতে সে কতটা স্ট্রিক প্রিন্সিপালের..., আপনি বোধ হয় এটাও জানেন স্যার, একটু রগচটা ছেলে।
উপ-উপাচার্য : আচ্ছা রাখো রাখো, এখান থেকে কথা বলা যাবে না।
উপাচার্য যা বললেন
শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দরকষাকষির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে আমি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি, নুরুল হুদা কিছু অসাধু ব্যক্তির কবলে পড়ে আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছে। ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের একটি ডকুমেন্ট আমার হাতে আসে। হুদা আমার এলাকার ছেলে হওয়ায় তাঁকে অসাধু কর্ম থেকে রোধকল্পে তাঁর স্ত্রীকে ফোন করেছিলাম।’
উপ-উপাচার্য আরো বলেন, ‘আমার পুরো ফোনালাপকে এডিট করে আংশিক প্রকাশ করা হয়েছে। যেকোনো এডিটিং সফটওয়্যারে পরীক্ষা করলেই জানা যাবে, এটি এডিট করা হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটি করা হয়েছে।’
এদিকে এ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও ‘সাজানো নাটক’ বলছেন খোদ নিয়োগ বোর্ডের সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যরা।
নিয়োগ-বাণিজ্য আগেই আঁচ করা গিয়েছিল
নিয়োগের নির্বাচনী বোর্ডে বিশেষজ্ঞ সদস্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মণ্ডল বলেন, ‘আমি যখন নির্বাচনী বোর্ডে অংশ নিতে সেখানে যাই, তখন ওই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক আমাকে সতর্ক করেছিলেন। এই নিয়োগে আর্থিক লেনদেন হতে পারে বলে তাঁরা আমাকে জানিয়েছিলেন।’
আবেদনকারী নুরুল হুদার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত। এ নিয়ে আমি কোনো কথা বলব না।’ তবে নুরুল হুদার স্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিন্ডিকেট সদস্য বলেন, ‘আইন বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদিত হওয়ার সময় আমি ছিলাম। এ নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ ও অস্বচ্ছ। আমার কাছে সবই সাজানো নাটক মনে হয়েছে। আগে থেকে সবই নির্ধারিত ছিল কাকে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বলেন, ‘প্রভাষক নিয়োগে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা লেনদেনের একটি তথ্য তখন আমার কাছে এসেছিল। যেদিন নিয়োগ বোর্ড বসে, সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যপন্থী এক শিক্ষক এক আবেদনকারীকে নির্বাচনী বোর্ডে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু একাডেমিক ফল খারাপ থাকায় সেই প্রার্থীর নিয়োগ হয়নি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে এ নিয়োগ বাতিলের সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, ‘সিন্ডিকেটে নিয়োগ বাতিল করার প্রক্রিয়া জটিল। কারো নিয়োগ বাতিল করতে হলে কিছু অযোগ্যতা বিবেচনায় আনা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ধরনের পরিস্থিতি আগে কখনো সৃষ্টি হয়নি। তাই এখন নিয়োগ বাতিলের প্রক্রিয়ার দিকে যেতে চাইলে করণীয় কী হবে, তা নিশ্চিত নই।’