আবরার হত্যায় জড়িতদের বহিষ্কার করবে ছাত্রলীগ : নাহিয়ান
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হলের কক্ষে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ছাত্রলীগ। হত্যার ঘটনায় যারা জড়িত তাদেরকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়।
আজ সোমবার দুপুরে এনটিভি অনলাইনকে এ কথা বলেন নাহিয়ান। পরে ছাত্রলীগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে বুয়েটের ঘটনা তদন্তে দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসিফ তালুকদার। তদন্ত কমিটির সদস্যদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় দপ্তর সেলে জমা দিতে বলা হয়েছে।
ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ছাত্রলীগ কখনো কোনো হত্যাকাণ্ডের রাজনীতিতে বিশ্বাস ও সমর্থন করে না। যারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের অবশ্যই বহিষ্কার করা হবে। এবং প্রশাসন যাতে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করতে পারে সে সহযোগিতা করা হবে।
নাহিয়ান নিহত আবরার ফাহাদের পরিবার ও সহপাঠীদের প্রতি সমবেদনা জানান।
এদিকে, তদন্ত কমিটির সদস্য আসিফ তালুকদার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আমরা ঘটনার তদন্ত করছি। ছাত্রলীগের অনেকের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে পেরেছি। যথা সময়ের মধ্যেই আমরা আমাদের প্রতিবেদন জমা দেব।
এদিকে শক্ত লাঠি দিয়ে আঘাতের ফলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিন মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ। আজ সোমবার বিকেলে ৪টার দিকে এনটিভি অনলাইনকে এ কথা জানান তিনি।
ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি আবরারের মাথা, পায়ে ও হাতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শক্ত লাঠি দ্বারা আঘাতের ফলে তাঁর মৃত্যু হয়। এক কথায় তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।’
গতকাল রোববার রাতে বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র আবরার ফাহাদকে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে এনে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। এ ঘটনায় আজ সোমবার সকালে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহসভাপতি মুত্তাকিম ফুয়াদকে আটক করে পুলিশ। বিকেল ৩টার দিকে বুয়েটের শেরে বাংলা হল থেকে শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনিক সরকার এবং ক্রীড়া সম্পাদক ও নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একই বর্ষের শিক্ষার্থী মেফতাহুল ইসলাম জিয়নকে আটক করে চকবাজার থানা পুলিশ। এরপর মেকানিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জেমি ও তৃতীয় বর্ষের ইথানকে আটক করা হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহরাব হোসেন বলেন, ‘হল থেকে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, গতকাল রোববার রাতে শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র আবরার ফাহাদকে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে এনে জেরা করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। তাঁরা শিবির সন্দেহে আবরার ফাহাদকে বেধড়ক পেটান। ওই সময় বুয়েট ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা, উপদপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুজতবা রাফিদ, সমাজসেবাবিষয়ক উপসম্পাদক ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফতি মোশারফ ওরফে সকালসহ তৃতীয় বর্ষের আরো কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিলেন।
পরে ওই কক্ষে দ্বিতীয় দফা আবরারকে পেটানো হয়। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক ও নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একই বর্ষের মেফতাহুল ইসলাম জিয়নসহ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। রাত ৩টার দিকে আবরারকে মৃত ঘোষণা করেন বুয়েটের চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মো. মাশুক এলাহী।
মারধরের সময় ওই কক্ষে উপস্থিত ছিলেন বুয়েট ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আবরারকে শিবির সন্দেহে রাত ৮টার দিকে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে আনা হয়। সেখানে আমরা তাঁর মোবাইল ফোনে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার চেক করি। ফেসবুকে বিতর্কিত কিছু পেজে তাঁর লাইক দেওয়ার প্রমাণ পাই। সে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে। শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাই। আবরারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন বুয়েট ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুজতবা রাফিদ, উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল ও উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা। প্রমাণ পাওয়ার পর চতুর্থ বর্ষের ভাইদের খবর দেওয়া হয়। খবর পেয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার সেখানে আসেন। একপর্যায়ে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি। এরপর হয়তো ওরা মারধর করে থাকতে পারে। পরে রাত ৩টার দিকে শুনি আবরার মারা গেছে।’
বুয়েটের শেরেবাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমরা সিসিটিভির ফুটেজ দেখছি। ঘটনায় কারা জড়িত, তা শনাক্ত করা হচ্ছে।’
হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫ ব্যাচের হাসিবুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সে খুবই ভদ্র ছেলে। পড়ালেখা ছাড়া কিছুই বুঝত না।’
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছি। এরই মধ্যে দুজনকে আটক করা হয়েছে। আমরা যতগুলো সিসিটিভির ফুটেজ আছে, সব সংগ্রহ করেছি। ফুটেজগুলো অত্যন্ত স্বচ্ছ।’
কৃষ্ণপদ রায় আরো বলেন, ‘এ হত্যায় যারা জড়িত, তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কে কোন দলের, এসব বিবেচনায় আসবে না।’
আবরার ফাহাদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের রায়ডাঙ্গায়। তবে কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই রোডে তাঁর বাবা-মা ও ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ থাকেন। আবরারের বাবার নাম বরকত উল্লাহ। আবরার ফাহাদের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েছে স্বজনরা। মা ছালেহা খাতুন মানতেই পারছেন না তাঁর ছেলে আর নেই। ছেলের কথা মনে করে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি।
আবরার ফাহাদের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ শোকে পাথর হয়েছিলেন। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তাঁর ভাই আর নেই। গতকাল রোববার রাতে ছেলে আবরার ফাহাদকে ফোন দিয়েছিলেন তাঁর মা ছালেহা। আবরার ধরেননি। এর কিছুক্ষণ পরই শোনেন ছেলে অসুস্থ, তাঁর কিছুক্ষণ পরে শোনেন ছেলে আর নেই।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, স্কুলজীবন থেকেই আবরার মেধাবী। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
আবরারের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বলেন, ‘কাল রাতে ভাইয়ার মোবাইল ফোনে কয়েকবার ফোন দেওয়া হয়। ফোন না ধরায় টেনশন হচ্ছিল। সকালে ভাইয়ার রুমমেট হয়তো ফোন করে বলে যে ফাহাদ অসুস্থ, ঢাকায় কেউ থাকলে আসতে বলেন। একটু পরে ফোন করে বলে যে ফাহাদ আর নেই। তারপর ঢাকায় আমার আত্মীয়রা গিয়ে ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছে।’
‘ভাইয়া সব সময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সেভাবে কারো সঙ্গেই মিশতেন না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। রাজনৈতিক কোনো কিছুর মধ্যে ছিলেন না। জামায়াত বা শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ইসলামী উগ্রবাদী কারো সঙ্গেও তিনি ছিলেন না।’
‘অনেক ছেলেই তো ছিল, তাঁকে রুম থেকে নিয়ে গেল, পেটানো হলো সেটা কেউ দেখতে পেল না?’ বলছিলেন আবরার ফাইয়াজ।
এদিকে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীরা। আজ সোমবার দুপুরে ঢাবির ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রথমে মানববন্ধন করা হয়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ শিক্ষার্থী। মিছিলটি বুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়ে শেষ হয়।
মিছিল থেকে আবরার ফাহাদ হত্যায় কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। হত্যার জন্য বুয়েট ছাত্রলীগকে দায়ী করে শিক্ষার্থীরা বলেন, ভিন্নমত পোষণ করায় কাউকে হত্যা করা কোনোভাবে মানা যায় না।