বুয়েটে মতের অমিল হলেই শিক্ষার্থীদের নির্যাতন
নিজের দেশকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বী। এজন্য ‘শিবির’ অভিযোগ এনে নির্যাতন করা হয় তাঁকে। ছাত্রলীগের এই নির্যাতনের ফলেই মারা যান তিনি। এই হত্যার পর বেরিয়ে আসে সাধারণ ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতনের নানা চিত্র।
২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক নির্যাতনের ঘটনার বিষয়ে বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থী এনটিভি অনলাইনকে নিশ্চিত করেন। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এসব ঘটনায় মুখ খুলতে ভয় পেতেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা জানান, মতের অমিল হলেই তারা নির্যাতন করতেন। মারধর করতেন। কিন্তু তাদের নানা ধরনের হুমকিতে মুখ খুলতে সাহস পেতেন না কেউ। এসব ঘটনা হল প্রশাসনকে জানালে তারা বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ দেখাতেন না।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতে রশিদ হলে নির্যাতন করা হয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের সাদ আল রাজিকে। ফেসবুকে পোস্ট করার কারণে তাঁকে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করা হয়। এতে তাঁর হাত ভেঙে যায়। এ ঘটনায় জড়িত নেভাল আর্কিটেক্ট বিভাগের ১৫ ব্যাচের মেহেদি হাসান ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৪ ব্যাচের রাউফান রাউঝান ঝলক নামের দুই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে হল প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করা হয়। যদিও পরে এ ঘটনার কোনো সুরহা হয়নি।
এর কিছুদিন আগে রশিদ হলের এক ফেস্টে ৫০০ টাকা চাঁদা না দেওয়ায় সিএসই বিভাগের ১৫তম ব্যাচের এক ছাত্রকে মারধর করায় তাঁর পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। এ ঘটনায় জড়িত বুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৪ ব্যাচের সাজিদ মাহমুদ অয়ন, একই বিভাগের বাঁধন ও নাবিদুল হাসান সৌরভ (সহসভাপতি, বুয়েট ছাত্রলীগ) এবং নেভাল আর্কিটেক্ট বিভাগের ১৫তম ব্যাচের সিস্মাম সন্তু।
গত বছরের ১৪ জানুয়ারি ক্যাম্পাস থেকে একজন ছাত্রকে ধরে জিমনেশিয়ামের কাছে নিয়ে মেরে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলা রাখা হয়। এ ঘটনার অনেক প্রত্যক্ষদর্শী থাকলেও পরবর্তীতে কোনো প্রকার বিচার করা হয়নি। বরং এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা ছাত্রলীগের কমিটিতে বড় পদ পেয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন। এ ঘটনার মূল হোতা মিনহাজুল ইসলাম (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৪তম ব্যাচ) বর্তমান বুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি। এ ছাড়া মিনহাজ আহমেদ শোভন (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১২তম ব্যাচ), নীলাদ্রি নিলয় দাস, মেহেদি হাসান (নেভাল আর্কিটেক্ট বিভাগের ১৫তম ব্যাচ) জড়িত বলে জানা যায়।
এ ছাড়া ভিন্ন মতাবলম্বী সন্দেহে ২০১৭ সালে রশিদ হলে একাধিকবার নির্যাতন করা হয় ইউআরপি বিভাগের ১৩তম বিভাগের ছাত্র তাওহিদুল ইসলাম সেতুকে। ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হ্য় সেতুর। এ ঘটনায় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন অনুপ বিশ্বাস অন্তু (ইউআরপি বিভাগের ১১তম ব্যাচ) এবং আকরাম সম্রাট (পানিসম্পদ বিভাগের ১৩তম ব্যাচ)। এ ঘটনায় হল প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং ভুক্তভোগী তাওহিদুল ইসলাম সেতুকে পরবর্তীতে হলছাড়া করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘প্রত্যেক হলেই ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কক্ষ ছিল। যেগুলো তারা বিভিন্ন সময় টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন। যেখানে তারা নিয়মিত মদপানও করতেন।
রশিদ হলের এক সিনিয়র কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই হলে বিভিন্ন সময় সাধারণ ছাত্র নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। আমার সামনেও র্যাগিং করা হয়েছে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা যারা হলে উঠতেন তাদের র্যাগিং করা হতো।’
মাহদী হাসান নামের স্নাতোকোত্তর শেষ পর্যায়ের এক বুয়েট শিক্ষার্থী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নির্যাতনের মতো অনেক ঘটনার বিষয়ে প্রশাসনকে জানানো হলেও নির্যাতিত ছাত্রকে বাঁচাতে কোনো প্রকার ভূমিকা নেয়নি প্রশাসন। উল্টো কখনো কখনো নির্যাতিত ছাত্রকে হল থেকে বহিষ্কার বা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
অপরদিকে নির্যাতনকারী ছাত্ররা দাপটের সঙ্গে হল এবং ক্যাম্পাসে তাদের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে যাচ্ছে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় বলেন, ‘ছাত্রলীগে অপরাধীদের কোনো স্থান নেই। এ ধরনের রাজনীতি ছাত্রলীগ সমর্থন করে না। ছাত্রলীগের কোনো নেতা বা কর্মী যদি অপকর্ম করে তবে তাদের সংগঠন থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’