আবুল মনসুর আহমদ বাঙালি মুসলিম সাংবাদিকতার দ্রোণাচার্য : ড. কাজল রশীদ শাহীন

Looks like you've blocked notifications!
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা শীর্ষক আলোচনা সভায় আজ বুধবার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক ও গবেষক ড. কাজল রশীদ শাহীন। ছবি : এনটিভি

সাংবাদিক ও গবেষক ড. কাজল রশীদ শাহীন বলেছেন, “আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন একজন পেশাদার সাংবাদিক ও সম্পাদক। কর্মগুণে ও সৃজননৈপুণ্যে তৎকালেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রায় একমেবাদ্বিতীয়ম। প্রকৃতার্থেই তিনি ছিলেন একজন কীংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক-সম্পাদক। আবুল মনসুর আহমদকে তাই বাঙালি মুসলিম সাংবাদিকতার দ্রোণাচার্য বলাই শ্রেয় ও যুক্তিযুক্ত।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা শীর্ষক আলোচনা সভার মূল প্রবন্ধে প্রবন্ধকার ড. কাজল রশীদ শাহীন একথা বলেন। আজ বুধবার (২৪ জানুয়ারি) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে৷

অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড. সনৎ কুমার সাহা এবং দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম৷ এছাড়া বর্তমানের সঙ্গে তার সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করেন দৈনিক সমকাল-এর প্ল্যানিং এডিটর ফারুক ওয়াসিফ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক তানভীর আহমেদ এবং আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক ইমরান মাহফুজ।

আবুল মনসুর আহমদকে নিয়ে ড. কাজল রশীদ শাহীন বলেন, “বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সংবাদপত্র শিল্পের ধারণার বীজ উপ্ত হয়। আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিক-সম্পাদকীয়তার সময়েই শুরু হয় সংবাদপত্রের ‘ইন্ডাস্ট্রি’হওয়ার সংস্কৃতি। সংবাদপত্রকে টেকসই প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল রূপ-রূপান্তর ও বাস্তবায়নে যারা অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তিঁনি ছিলেন সেসকল মেধাবী সাংবাদিক-সম্পাদকদের অন্যতম। সদর্থক অর্থেই সংবাদপত্রকে বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব ও কর্মপ্রতিভা দিয়ে ‘ইন্ডাস্ট্রি’তে পরিগণিত করেন। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের প্রযত্নে ও নেতৃত্বে তিনি পালন করেছেন একজন যোগ্য ও দায়িত্বশীল অভিভাবকের ভূমিকা। তাঁর নেতৃত্বে বৃহদায়তন জায়গায় সংবাদপত্র সমৃদ্ধ হয়েছে বহুধাভাবে। যেমন ইংরেজি পত্রিকা ‘দি মুসলমান’, পাশাপাশি বাংলা সংবাদপত্রের বিকাশে যুক্ত করেছেন নতুন মাত্রা, ‘কৃষক’ ও ‘নবযুগ’। বাঙালি মুসলমানের সংবাদপত্র সৃজন ও সংলগ্নতা পেয়েছে ইতিহাস নির্মাণের সুযোগ, যেমন ‘ইত্তেহাদ’।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা শীর্ষক আলোচনা সভায় আজ বুধবার বক্তব্য দিচ্ছেন দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। ছবি : এনটিভি

প্রবন্ধে কাজল রশীদ শাহীন আরও বলেন, “একবিংশ শতাব্দির এই তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় তাঁর রচিত পথ থেকে আজকের সাংবাদিকদেরও নেওয়ার মতো রয়েছে অনন্য সব দিক নির্দেশনা। একনিষ্ঠতা, কর্মোদ্যোগ, প্রেম ও সাধনায় তিঁনি সাংবাদিকতা-সম্পাদকতা, সংবাদপত্র শিল্পকে ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিকভাবে দাঁড় করিয়েছেন এক অনন্য উচ্চতায়। যা থেকে একজন সংবাদপত্র মালিকের, একজন সাংবাদিক-সম্পাদকের, একজন অধ্যাপকের, একজন তাত্ত্বিক-গবেষক ‘বই লিখিয়ে’র, একজন লেখক-দার্শনিক-যুক্তিবাদীর নেওয়ার রয়েছে অমূল্য সব উপাদান। প্রকৃতার্থেই তিনি ছিলেন একজন কীংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক-সম্পাদক। তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের শতবর্ষ একারণেই বিশেষ স্মরণের দাবি রাখে।”

ড. কাজল রশীদ শাহিন আরও বলেন, “বাংলাদেশের নবজাগরণের দার্শনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন আবুল মনসুর আহমদ। সাংবাদিক-সম্পাদক হিসেবে ও বহুমাত্রিক লেখালেখির মধ্য দিয়ে এবং পরবর্তী সময়ে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে রেখে গেছেন সক্রিয় ও দিকনির্দেশক ভূমিকা। সাংবাদিকদের মৌলিক বিষয় হচ্ছে প্রশ্ন করার ক্ষমতা। আমরা তার শৈশবে দেখতে পাই সমাজ সংস্কারের নানাবিধ প্রশ্ন করার মাধ্যমে তিনি ধীরে ধীরে খ্যাতিমান একজন সংবাদিকে পরিণত হয়েছিলেন।”

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা বলেন, “আবুল মনসুর আহমদের ব্যাপারে আমার কৌতূহল আছে। তার লেখাপড়ার মাধ্যমে আমি সাংবাদিকতার অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আবুল মনসুর আহমদ তার লেখায় নিজের সত্ত্বাকে বজায় রেখেছেন। আবুল মনসুর আহমদকে পড়ার মাধ্যমে আমরা বিস্তর বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি। আমরা চাই সাংবাদিকরা যেন নীতিনৈতিকতার মাধ্যমে তাদের কাজ করে যান।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা শীর্ষক আলোচনা সভায় আজ বুধবার বক্তব্য দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড. সনৎ কুমার সাহা। ছবি : এনটিভি

অনুষ্ঠানে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, “সাংবাদিকতা হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার একটি দৈনন্দিন উপকরণ। এর মাধ্যমে দৈনিক চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা উপভোগ করা যায়। অন্য কোনো পেশায় সেই সুযোগ কম৷ তবে এটির নাম করে দায়িত্বহীন মতামত, অসত্য তুলে ধরা এবং অন্যকে হেয় করে কথা বলাও এক ধরনের স্বাধীনতা, সেটি বিকৃত স্বাধীনতা।”

ডেইলি স্টার সম্পাদক আরও বলেন, “মত প্রকাশের স্বাধীনতা সেই সমাজেই প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে একটা নৈতিক পরিবেশে মত প্রকাশ করা যায়। যেখানে কেউ মিথ্যা কথা বলবে না, অসত্য তথ্যকে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরবে না, কাউকে হেয় পতিপন্ন করে কথা বলবে না। অর্থাৎ মতটা যেন খুব সুচিন্তিত, গবেষণাধর্মী ও তথ্যভিত্তিক হয়৷ তাহলেই মত প্রকাশটা সমাজকে উন্নত স্তরে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমি প্রতিবেদন, মন্তব্য বা যা খুশি লিখব কিন্তু সেটা যেন দায়িত্বশীল মতামত, গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক হয়।”

অনুষ্ঠানে আবুল মনসুর আহমদের জীবনী নিয়ে ডেইলি স্টার সম্পাদক আরও বলেন, “আবুল মনসুর আহমদ বাঙালি মুসলমানদের জন্য সবসময় চিন্তা করতেন। তিনি আদর্শিক জীবনযাপন করে গেছেন। শৈশবকাল থেকে আত্মসম্মানবোধের অধিকারী ছিলেন। আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ব্রিটিশ আমলে তিনি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ে তার অবদান অনস্বীকার্য। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ে তিনি রাজনীতির নানা বিষয় তুলে ধরেছেন।”

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মুসতাক আহমেদ। একই বিভাগের অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেন বকুলের সঞ্চালনায় বিভিন্ন বিভাগের শতাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন৷