জাবি ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী উৎসব
পড়াশুনা শেষ। ছেড়ে দিতে হবে প্রাণের ক্যাম্পাস। নতুন জীবনের পথে পা বাড়াতে হবে এবার। নতুন স্বপ্নের পথে পা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পূর্ণ নয়নাভিরাম ক্যাম্পাস আর সহপাঠীদের ছেড়ে যাওয়ার বিচ্ছেদ–বেদনাও রয়েছে। তবে তারুণ্যের স্বভাব অনুযায়ী উচ্ছ্বাসই জয়ী হলো শেষ পর্যন্ত। তাই আনন্দ-উল্লাস, উৎসব আর আমেজে আয়োজন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সর্বশেষ অনুষ্ঠান শিক্ষা সমাপনী উৎসব। নাচ, গান, কনসার্ট কিংবা র্যালি- এক জমজমাট আয়োজনে সেই উৎসব পালন করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।
ক্যাম্পাসের সর্বত্র যেন এক উৎসবের আমেজ। সবার মধ্যেই বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা। পুরো ক্যাম্পাস সেজেছে নতুন সাজে। ‘এক সুরে শত গান, এক সত্তায় শত প্রাণ’ স্লোগানে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী শিক্ষা সমাপনী উৎসবের। পুরো উৎসবের মধ্যমণি নির্বাচিত দুজন রাজা-রানী। তাদেরকে কেন্দ্র করেই শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কনসার্ট আর ক্যাম্প-ফায়ারের মতো বেশ কিছু ইভেন্টে মেতে উঠবেন ব্যাচের সব শিক্ষার্থী। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রাজা-রানীর এই প্রথা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
উৎসবের প্রথম দিন (বৃহস্পতিবার) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। এই ম্যাচে শুধু ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীরাই অংশগ্রহণ করেছে। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মুক্তমঞ্চে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন (শুক্রবার) সকালে অমর একুশে পাদদেশ থেকে ঢাক-ঢোল, বাঁশি বাজিয়ে শিক্ষা সমাপনীর রাজা-রাণীকে নিয়ে আনন্দ র্যালির মাধ্যমে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ, রং মাখামাখি ও সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে কন্সার্টের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া শেষ দিন আজ শনিবার (১৬ নভেম্বর) ব্যাচের সকল শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে রোপণ করা হবে ৪৪টি গাছ, রাতে গ্র্যান্ড ডিনার ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
ক্যাম্পাসে কাটানো দীর্ঘদিনের বন্ধুদের মন্তব্য লেখার সাদা রঙের টি-শার্ট পরে শিক্ষার্থীরা উল্লাসে মেতে উঠেছিল আনন্দ র্যালিতে। ‘তোর সাথে কাটানো দিনগুলো ভোলা যাবে না’, ‘ভোলা সম্ভব নয়’, ‘তোরা ছিলি তোরা আছিস, জানি তোরাই থাকবি’, ‘কম করে পড়িস, না হলে পাগল হয়ে যাবি’- এভাবেই মনের অজানা কথাগুলো প্রিয় বন্ধুদের উদ্দেশে সাদা টি-শার্টে লিখে দেন সহপাঠীরা। এর সঙ্গে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে রং মাখিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পুরো ক্যাম্পাস যেন বিদায়ী উৎসবে মেতে উঠেছে।
সবার সঙ্গে আনন্দ করছিলেন বিদায়ী শিক্ষার্থী নিশাত। এর মাঝে কথা হয় তার সাথে। সমাপনী অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমার ক্যাম্পাস জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানের এই দিনগুলো। এটা শুধু সমাপনী অনুষ্ঠান নয়, আমাদের মিলনমেলা। অনেক আনন্দ করেছি সবার সঙ্গে। আর মাত্র কয়েকটা দিন। এরপরে পরিচিত মুখগুলোকে আর দেখব না। কথাটা মনে পড়লে খারাপ লাগে। যেখানেই যাই সবসময় খারাপ লাগবে প্রাণের এই ক্যাম্পাসের জন্য। মনে পড়বে প্রিয় সহপাঠী-শিক্ষকদের।’
উৎসবের অনুভূতি জানাতে গিয়ে ৪৪তম ব্যাচের রাজা নিক্সন খান বলেন, ‘শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান প্রোগ্রাম জাবির একটা ঐতিহ্য। সেই পরিক্রমায় ৪৪তম আবর্তন র্যাগ প্রোগ্রাম আয়োজন করে। এই উৎসব হলো শিক্ষাজীবনের সুখের স্মৃতি যা ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের অনুপ্রেরণা দেয়। রাজা হিসেবে আমার নির্বাচিত হওয়ার পেছনে বন্ধুদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’
দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাটানো বন্ধুদের থেকে এবার বিদায় নেওয়ার সময় হয়ে গেছে। কারো চোখে অশ্রু, আবার কেউ কান্নায় মুখ লুকাচ্ছে। সবার মনে বাজছে বিদায়ের সুর। ২০১৪ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে জাবিতে ক্লাস শুরু করে ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পুরোটা সময় ছিল প্রাণবন্ত।
‘রাত্রি যবে হবে অন্ধকার, বাতায়নে বসিয়ো তোমার/ সব ছেড়ে যাব প্রিয়ে, সমুখের পথ দিয়ে ফিরে দেখা হবে না তো আর’ রবি ঠাকুরের কবিতার মতো সব ছেড়ে যাওয়ার সময় এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিসমাপ্তি। নিতে হবে চূড়ান্ত বিদায়।
শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় হলো চরম আকাঙ্ক্ষার জায়গা। এই আঙিনায় পা দেওয়ার প্রথম দিন থেকেই পড়াশোনা ছাড়াও ক্যাম্পাস জুড়ে ঘুরে বেড়ানো, বন্ধুদের সঙ্গে হইচই আড্ডা, গান-বাজনা, মিছিল-মিটিং করেই বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে নিজ গৃহের মতো আপন। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থাকা জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। নিজেদের ক্যাম্পাসকে তারা ডাকেন ‘দ্বিতীয় জন্মের আঁতুড়ঘর’ বলে। কিন্তু এই আঁতুড়ঘরকেরও একদিন ছেড়ে আসতে হয়। আর এই ছেড়ে আসাটা হয় শিক্ষা সমাপনী উৎসবের মধ্য দিয়ে।