হাতপাখার নির্বাচন বর্জন, জাতীয় পার্টিরও একই ইঙ্গিত
সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা এবং ইভিএম কারসাজির অভিযোগ এনে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র পদে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা মুরশিদ আলম ফারুকী। আজ মঙ্গলবার (১৩ জুন) দুপুরে নগরীর গণকপাড়া এলাকায় গণসংযোগ চালানোর সময় জাতীয় পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপনও বলেছেন, ‘বিষয়টি কেন্দ্রে জানানো হয়েছে। আমরাও নির্বাচন বর্জন করতে পারি।’
জাতীয় পার্টির মেয়র পদপ্রার্থীর দাবি, ‘বরিশাল ও খুলনা সিটি নির্বাচনে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে রাজশাহীর ভোটাররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ভোটাররা বলছেন—ভোটের ফলাফল যা হওয়ার তা তো হবেই, আপনারা নির্বাচন করে আর কী করবেন?’
নির্বাচনে বিএনপি অনুপস্থিত থাকায় আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের সহজ জয়ের পথ তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, নির্বাচনের ফলাফল হয়েই গেছে। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। এর পরও লিটন সকাল, বিকেল, রাতে রুটিন করে নগরীতে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন করে নৌকা প্রতীকের পোস্টার, ফেস্টুনে ঢেকে ফেলা হচ্ছে নগরীর অলিগলি।
লিটন ও তাঁর অনুসারীদের এখনও দুটি আশঙ্কা তাড়া করছে দাবি করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও তাদের কর্মী সমর্থকরা কাউন্সিলরের ভোট দিতে গিয়ে যদি মেয়র পদে কাউকে ভোট না দেয় কিংবা অন্য প্রতীকে ভোট দিয়ে যায়, তা হবে লিটনের জন্য বিব্রতকর। আবার নিজ দলের মহানগর কমিটির বর্তমানে নিষ্ক্রিয় করে রাখা সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার ও তার অনুসারীদের নিয়েও চিন্তায় আছেন লিটন। মেয়র পদে ডাবলু দলীয় মনোনয়ন চাওয়ায় লিটনের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বেড়ে যায়। নগর আওয়ামী লীগে ডাবলু সরকারের বেশ কর্মী সমর্থক রয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একটি বড় মহল তার পৃষ্টপোষক। ফলে ডাবলু সরকারের অনুসারীদের ভোট কোন প্রতীকে যায়, তা নিয়ে চিন্তিত রয়েছেন দলের মেয়র পদপ্রার্থী লিটন। লিটনের পক্ষে প্রচার চালানো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গ্রুপ ও নেতাদের প্রোফাইলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে একটি ‘স্বার্থান্বেষী মহল’ নিজেদের প্রার্থীকে ‘পরাজিত করতে মরিয়া’ হয়ে আছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানায়, মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে ডাবলু সরকারের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর থেকেই এই অস্থিরতার শুরু। গত সপ্তাহে উত্তেজনা চরমে ওঠে যখন নগরীর কুমারপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতাকর্মী ধারালো অস্ত্র নিয়ে মিছিল বের করে। ক্ষোভে ভরা তাদের স্লোগান ছিল সরাসরি মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারকে লক্ষ্য করে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দলের বর্তমানে প্রেসিডিয়াম সদস্য লিটনের সঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনের পর পরই। সে সময় তাদের দ্বন্দ্ব কেন্দ্র পর্যন্ত গড়িয়েছিল। গত বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে লিটন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মীর ইকবালের বিরোধিতা করায় তাদের মধ্যকার ঠাণ্ডা লড়াই বেড়ে যায়। মীর ইকবাল ডাবলু সরকারের ভগ্নিপতি। লিটনের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হন। তবে চলতি বছরের শুরুতে ডাবলু সরকারের একটি স্ক্যান্ডাল ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার প্রভাব কমে যায়।
দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগে দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন খায়রুজ্জামান লিটন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যের মতো মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠানের পর থেকে স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান এখন অনেক শক্ত। দলের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ড. আবদুল খালেক ও অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান খান, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য বেগম আখতার জাহান, রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য এনামুল হক এবং রাজশাহী-৫ আসনের সংসদ সদস্য ডা. মনসুর রহমানসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী রয়েছেন লিটনের সঙ্গে।
দলীয় সূত্রগুলো এ তথ্য দিয়ে দাবি করছে, ডাবলু সরকারকে নেপথ্যে থেকে শক্তি গোগাচ্ছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম, লিটনের ফুফাতো ভাই ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী, রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন এবং রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদ্য কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারা।
দলীয় সূত্রগুলোর দাবি, দলে লিটনের বিপক্ষে যাদের অবস্থান, তারা চায় মেয়র পদে লিটনের ভরাডুবি হোক। তারা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীকে জেতানোর জন্য ভেতরে ভেতরে পাঁয়তারা করছিলেন। এখন যেহেতু হাতপাখার প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন, তখন তাদের চেষ্টা থাকবে লাঙ্গল জিতুক।
লিটনের পক্ষের জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ দলের লিটন বিরোধ একটি অংশের এমন তৎপরতা অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘লিটনের অগ্রগতি তাদের নিজেদের অবস্থান ক্ষুণ্ণ করতে পারে এই আশঙ্কায় দলের কিছু সদস্য লিটনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়াচ্ছে।’
তবে এ ধরনের তৎপরতা কাল্পনিক দাবি করে সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন জানান, লিটন তাঁর রাজনৈতিক অভিভাবক। তাঁর বিরোধিতার প্রশ্নই ওঠে না।
লিটনের জয় নিশ্চিত করতে নগরীতে বসবাসকারী পবা ও মোহনপুর উপজেলার মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নৌকার পক্ষে প্রতিনিয়ত ভোট চাচ্ছেন, এমন দাবি করে আয়েন জানান, তিনি তাঁর সব অনুসারীকে নৌকাকে জেতানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, মুষ্টিমেয় কিছু লোক মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে লিটনের পক্ষে থাকার চেষ্টা করছে। লিটনের জয় নিশ্চিত উল্লেখ করে তিনি জানান, নির্বাচনি বিধি মেনে তিনি লিটনের পক্ষে সরাসরি প্রচার কাজে অংশ নেওয়া থেকে বিরত আছেন, কারণ সংসদ সদস্যদের সক্রিয়ভাবে প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নৌকাকে জেতাতে তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।