বালকের নাম রবিঠাকুর

Looks like you've blocked notifications!

কলকাতার আকাশে হয়তো সেদিন খুব বেশি রকমের মেঘ জমেছিল, হয়তো সেদিন বাতাসের বেগটাও বড় বেশি ছিল। বাতাসের তোড়ে গাছগুলো পাগলা হাতির মতো এদিক-ওদিক হেলেদুলে পড়ছিল। সেদিন হয়তো কলকাতার কোনো একটা বাড়ির বারান্দায় সাত-আট বছর বয়সী এক বালক অবাক বিস্ময়ে মেঘ-বাতাস-বৃষ্টির উন্মত্ত খেলা দেখে যাচ্ছিল। প্রকৃতির এমন খেলা দেখে বালকের ভেতর সেদিন কবিসত্তা জেগে উঠেছিল। বালক আনমনে বলে ফেলল,

‘জল পড়ে, পাতা নড়ে/পাগলা হাতি মাথা নাড়ে।’

কে জানত, সেদিনের সেই উথাল-পাথাল বৃষ্টিই জন্ম দিয়ে ফেলবে পৃথিবীর এমন অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ কবিকে? হ্যাঁ, আসলেই সেই বৃষ্টি বালকের কবি-মনকে জাগিয়ে তুলেছিল। বালক রচনা করেছিল তার জীবনের প্রথম কবিতা। তার পর বালক জীবনভর লিখে গিয়েছিল। গান-কবিতা-নাটক-উপন্যাস-ছোটগল্প লিখে চমকে দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে। সেদিনের সেই বালকই আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাঙালি শিশু সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করতে যে দু-একজন মানুষ বড় বেশি অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের ভেতর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বাগ্রে। ১৫ বছর বয়সে ‘বনোফুল’ কাব্যগ্রন্থ আর ১৭ বছর বয়সে ‘বালক’ পত্রিকার ভার যিনি নিয়েছিলেন, তারই ছোঁয়ার শিশু সাহিত্য পেয়েছিল অন্য এক মাত্রা। ঠাকুমার ঝুলি থেকে বের হয়ে শিশুরা আস্বাদন করেছিল ভিন্ন এক স্বাদ। শিশু, শিশু ভোলানাথ, সহজ পাঠ, ছড়া ও ছবি, খাপছড়া ইত্যাদি অসংখ্য শিশুতোষ রচনা প্রসব করেছেন কবিগুরু। রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসে আর ‘ইচ্ছেপূরণ’ গল্পটা পড়েনি, এমন মানুষ পাওয়া ভার। এ তো শুধু শিশুদের নয়, একই সঙ্গে বড়দেরও ইচ্ছার কথাই বলে। একটা বয়সে প্রতিটি শিশু বড় হতে চায় আর প্রতিটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকে আরেকবার শৈশবটাকে ফিরে পাওয়ার—এমনই ইচ্ছাকে খুঁটি করে কবি রচনা করেছিলেন ‘ইচ্ছেপূরণ’ গল্পটা।
হয়তো রবিঠাকুর অন্তরের কথা বুঝতেন। তা না হলে কী করে ধরে ফেলতেন মানুষের মনের স্বপ্ন আর পরম আকাঙ্ক্ষাকে। শৈশবে আমাদের সবার ভেতরের কল্পনার রাজ্যটাকেও রবিঠাকুর যে ভীষণভাবে বুঝে ফেলেছিলেন। তিনি জানতেন, শৈশবের সেই কল্পনার রাজ্যে একটা শিশু নিজের কাছেই নিজে ‘বীরপুরুষ’ হয়ে থাকে।

“এমন সময় হারে রে রে রে রে’

ওই-যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে!

তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে

ঠাকুর-দেবতা স্মরণ করছ মনে,

বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে

আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,

আমি আছি, ভয় কেন মা করো!”

রবীন্দ্রনাথ যেন শিশুমনের অস্থির চিন্তাগুলো সবই বুঝতেন। একটা শিশু বিচিত্র সাধ-ইচ্ছে-খেয়াল সবই তিনি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন—

‘মা যদি হও রাজি

বড়ো হলে আমি হব

খেয়াঘাটের মাঝি’( মাঝি, শিশু)

শুধু মাঝি আর বীরপুরুষই নয়, একটা শিশুমনের সমস্ত অলিগলির সবটুকুই কবিগুরু যেন জানতেন। একটা শিশু যেমন করে কখনো মালী, কখনো পাহারাদার, কখনো মাঝি, আবার কখনো শিক্ষক হতে চায়, সেসব ইচ্ছও তাঁর কবিতায় প্রকাশ পেত। কবির ভাষায়—

‘আমি আজ কানাই মাস্টার

পড়ো মোর বিড়াল ছানাটি

আমি ওকে মারি নে বেত

মিছি মিছি বসি নিয়ে কাঠি।’

আবার—

‘আমি যখন পাঠশালাতে যাই

আমাদের এই বাড়ির গলি দিয়ে

দশটা বেলায় রোজ দেখতে পাই

ফেরিওয়ালা যাচ্ছে ফেরি নিয়ে

--------------------------------------
ইচ্ছে করে সেলেট ফেলে দিয়ে

এমনি করে বেড়াই নিয়ে ফেরি’

শিশুর স্বাধীনতা প্রিয় মন যে কবির কবিতায় কত অগণিতবার ফুটে উঠেছে! রবিঠাকুরের ‘ছুটি’ কবিতাটা পড়েনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়াই তো বেশ কষ্টকর। একটা শিশুর পড়ালেখা ফেলে খেলার ভীষণ ইচ্ছে, আবার বাবার মতোই নিজেকে বড় ভাবা সবই রবি কবি জানতেন। কবির লেখায় তাই ফুটে উঠেছে,

‘দেরি হচ্ছে বসে পড়া করো

আমি বলব, খোকা তো আর নেই

হয়েছি সে বাবার মত বড়।’

শিশুর মনোজগতে যেন কবিগুরুর ছিল নিত্য আনাগোনা। একটা শিশুর কাল্পনিক জগৎ, শিশুতোষ চেতনা, শিশুর চাওয়া, দুঃখবোধ সম্পর্কে এত স্পষ্ট চিত্র আর কোনো সাহিত্যিকের লেখায় পাওয়া যাবে, তা আমার সন্দেহ। ‘ছুটি’ গল্পটা তো অনেকেরই পড়া আছে। কী করুণ পরিণতিই না হয়েছিল ফটিক নামের উচ্ছল সেই কিশোরের।

রবিঠাকুরের কবিতাগুলোর ভেতরে তাঁর শৈশব এমন ভাবে এঁটে আছে, যেগুলো পড়লে যে কেউ উপলব্ধি করবে কবিতাগুলো আসলে কবির নিজের অনুভূতি নয়, বরং এ তো পৃথিবীর সব শিশুর ভেতরের গল্প। একটা শিশুর কাছে প্রকৃতির আবেদন কী যে অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছে কবিগুরুর কবিতার মাঝে। যেমন—

‘দিনের আলো নিভে এল

সূর্যি ডোবে ডোবে।

আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে

চাঁদের লোভে লোভে।

------------------------
কোন ছেলেরে ঘুম পাড়াতে

কে গাহিল গান,

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর

নদেয় এল বান।’ (বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর)

আপনারা হয়তো খেয়াল করেছেন, কবির অসংখ্য গান-কবিতার মাঝে শৈশব আর বৃষ্টির একটা অসম্ভব সমন্বয় রয়েছে। ‘আষাঢ়’, কড়ি ও কোমল গ্রন্থে ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ এই কবিতাগুলোর সঙ্গে তো বৃষ্টি-শৈশব একদম গলাগলি করে লেপ্টে আছে।

কবিগুরু যখন শিশু সাহিত্য লিখেছেন, তখন যেন তাঁর ভেতরেই সেই কলকাতার বারান্দায় দাঁড়ানো সাত-আট বছরের শিশুটা আবার খলখল করে উঠত। এ কারণেই হয়তো তাঁর লেখায় শিশুদের মনোজগৎ এতটা স্পষ্ট, জীবন্ত আর প্রাণবন্ত। এ কারণেই এত ভীষণভাবে লিখে গিয়েছিলেন,

‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ

ওরে অবুঝ, আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’

এক বর্ষায় যে বালকের ভেতর কবিসত্তার জন্ম নিয়েছিল, তাঁর তো শিশু সাহিত্যে অবাধ বিচরণ থাকবেই। বর্ষা ভালোবাসা সেই মানুষটিও বিদায় নিয়েছিল ঘন কালো আরেক বর্ষায়। আজ কবিগুরুর প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।