আলফ্রেড নোবেল দ্য গ্রেট

Looks like you've blocked notifications!
আলফ্রেড নোবেল। ছবি : সংগৃহীত

ছোটবেলায় নোবেল পুরস্কারের কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু বেশি কিছু বুঝতাম না তখন, তবে জেনেছি বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে বিশ্বসেরাদের দেওয়া হয় এই পুরস্কার। এই পুরস্কারের অর্থমূল্যও যেমন বেশি, তেমনি সম্মানের বেলায়ও। তখন প্রশ্ন জাগত কে, কেন এত টাকা পুরস্কার দেন? তখন বড়রা বলতেন নোবেল নামক এক বিজ্ঞানীর গল্প, যিনি কিনা বানিয়েছিলেন এক অদ্ভুত জিনিস ‘ডিনামাইট’, যা তার আগে বানাতে পারেনি আর কেউ। তখন জিজ্ঞেস করতাম ডিনামাইট কী? বড়রা বলতেন বোমা।

আমি বলতাম বাবারে! মানুষ মারার জিনিস বানিয়েছেন, তাঁর নামে আবার পুরস্কার! তাঁরা বলতেন, আরে বোকা তা না, তিনি মানুষ মারার জন্য বোমা বানাননি। তখন সেগুলো দিয়ে ভালো কাজই হতো, যেমন ধরো পাহাড় উড়িয়ে দিয়ে রাস্তা বানানো। পাহাড় কেটে রাস্তা বানাতে তো অনেক পরিশ্রমের ব্যাপার। এসব কারণে তাঁর বানানো ডিনামাইটের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। ডিনামাইট বিক্রি করেই তিনি আয় করেন প্রচুর অর্থ, সেগুলো দিয়েই দেওয়া হয় আজকের নোবেল প্রাইজ। আমি বিস্ময়ে মাথা নেড়ে বলতাম ও!

এ বছরের নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়েছে আজ থেকে। তোমাদের মনেও নিশ্চয় জাগছে এ রকম আরো নানা প্রশ্ন, ইচ্ছে হচ্ছে নোবেল সম্পর্কে আরো জানতে? তো দাঁড়াও সব জানাচ্ছি এবার।

বিজ্ঞানী নোবেলের পুরো নাম হচ্ছে আলফ্রেড বের্নহার্ড নোবেল। ১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর ইউরোপের দেশ সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ছিল ইমানুয়েল নোবেল। তিনি একজন ব্যবসায়ী। নোবেলের ছেলেবেলা মোটেও ভালো কাটেনি। কারণ নোবেলের জন্মের বছরই তাঁর বাবা ব্যবসায় দেউলিয়া হয়ে যান। তিনি পরিবার রেখে ভাগ্যের সন্ধানে দেশ-বিদেশে ঘুরতে থাকেন।

অবশেষে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। অবস্থা মোটামুটি ভালো হলে তিনি ১৮৪২ সালে পরিবারকে তাঁর কাছে নিয়ে যান। তখন থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গই হয়ে ওঠে নোবেলের শহর। বেশ ভালো সময় কাটতে থাকে সেখানে। সেন্ট পিটার্সবার্গে বসে থাকেননি নোবেল। ১৮৫০ সালের দিকে তিনি পাড়ি জমান ফ্রান্সে। সেখানে প্যারিসে অবস্থিত টি জুলস পিলৌজ নামক একটি গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন নোবেল কোম্পানি নামক একটি অস্ত্রের কারখানা।

১৯৫৩ সালের দিকে ক্রিমিয়া যুদ্ধ শুরু হলে বেশ লাভ করে তাঁর কোম্পানি। কিন্তু যুদ্ধের শেষদিকে অর্ডার উঠে যাওয়ায় তাঁকেও তাঁর বাবার মতো দেউলিয়া হতে হয়। এভাবে উত্থানের পর হঠাৎ পতনে বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েন তিনি। তবে এতেই দমে যাওয়ার মতো ছেলে ছিলেন না আলফ্রেড নোবেল। তিনি জানতেন, তিনি পারবেন। এই পতনের পর তিনি মনোযোগ দেন নতুন পণ্য উৎপাদনের দিকে। তাঁর এই ঝোঁকই তাঁকে ডিনামাইট আবিষ্কারের পথে নিয়ে যায়।

১৮৬২ সালের দিকে নাইট্রোগ্লিসারিন জাতীয় পণ্য উৎপাদনের কথা চিন্তা করেন এবং গবেষণা শুরু করেন। প্রথম উৎপাদন করেন ব্লাস্টিং অয়েল নামক এক প্রকারের বিস্ফোরক। এরপর ‘ব্লাস্টিং ক্যাপ’ নামক নাইট্রোগ্লিসারিন বিস্ফোরণের ট্রিগার উৎপাদন করেন।

১৮৬৪ সালে স্টকহোমে এ কাজে গবেষণার সময় বিস্ফোরণে নোবেলের ছোট ভাই এমিল মৃত্যুবরণ করেন। তবুও দমে যাননি নোবেল। তিনি ‘ব্লাস্টিং ক্যাপ’ নকশার উন্নয়ন করতে থাকেন এবং ১৯৬৫ সালে স্টকহোমে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইট্রোগ্লিসারিন এবি’। তারপর সুইডেনে থাকা হয়নি আর বেশি দিন, চলে আসেন জার্মানিতে।

হামবুর্গে চালু করেন ‘আলফ্রেড নোবেল অ্যান্ড কোম্পানি’। গবেষণার সময় হামবুর্গের কারখানাতেও বিস্ফোরণ ঘটে। তখন নোবেল চিন্তা করলেন একে আরো নিরাপদ করা দরকার। এর জন্য অনেক পাগলামিও করেন তিনি। যেমন বিস্ফোরণ হলেও মানুষের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তার জন্য তিনি একটি নৌকা নিয়ে চলে যান এলবে নদীতে। সেখানে তাঁর আবিষ্কৃত বিস্ফোরক নিরাপদে বানানোর চেষ্টা চালিয়ে যান।

কাইসেলগুর মিশিয়ে তার নতুন নাম দেন ডিনামাইট এবং ১৮৬৭ সালে এর জন্য পেটেন্ট লাভ করেন। নাইট্রোগ্লিসারিন এবং টিএনটি দিয়ে তৈরি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাসায়নিক বিস্ফোরকটি প্রথমদিকে ‘নোবেল বাস্টিং পাউডার’ হিসেবে বিক্রি হতে থাকে।

ডিনামাইটকে মূলত তার দ্বারা দূর থেকে বৈদ্যুতিক সিগনালের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যা প্রচুর শক্তি নির্গত করে। কম খরচে এবং সহজে পাহাড় ভাঙা, টানেল তৈরি ও খনিতে এবং যুদ্ধে সেতু, শত্রুপক্ষের ভবন, রেললাইন ইত্যাদি উড়িয়ে দিতে ডিনামাইট ব্যবহৃত হতে থাকে, ফলে ক্রমশ ডিনামাইট জনপ্রিয়তা পেতে থাকে এবং নোবেলকে সৌভাগ্য এনে দেয়।

ডিনামাইট বিক্রি করে তিনি প্রচুর অর্থ-বৈভবের মালিক হন। একের পর এক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। এতে তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে যেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেন, তেমনি বিজ্ঞানী হিসেবেও। তাঁর ঝুলিতে ছিল প্রায় ৩৫০টি পণ্যের পেটেন্ট! তিনি অনুধাবন করেন যে ডিনামাইট শান্তির উদ্দেশে ব্যবহার করা যাবে।

বিজ্ঞানের আবিষ্কারও যাতে হয় মানবিক কল্যাণে, তাই বিজ্ঞানীদের উদ্বুদ্ধ করা এবং পুরস্কৃত করার চিন্তা করেন তিনি। তিনি তাঁর উপার্জিত অর্থ দ্বারা নোবেল ইনস্টিটিউট গঠন করেন, যা থেকেই মানবকল্যাণে শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার এবং শান্তির জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়। দক্ষ এই সুইডিশ রসায়নবিদ, প্রকৌশলী এবং উদ্ভাবক ১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন।