মেলার গল্প

Looks like you've blocked notifications!

রাফসানরা ঢাকায় থাকে। মা-বাবা দুজনই ভীষণ ব্যস্ত থাকেন কাজে। রাফসানকে তাঁরা খুব কম সময়ই দিতে পারেন। তাই বাইরে খুব একটা ওর যাওয়া হয় না। একদিন রাফসানের বাসায় গ্রাম থেকে ওর মামাতো ভাই বেড়াতে এলো। তার নাম রফিক। ওরা একই ক্লাসে পড়ে। রফিক খুব খেলাধুলা করে বলে ওর শক্তিও খুব। রাফসান তাই ওকে খুব পছন্দ করে। একদিন রাফসান রফিককে শহর দেখাতে নিয়ে গেল। ঢাকা শহরের এত বড় বড় দালান দেখে রফিক তো থ! বলল, এত বড় বাড়ি কীভাবে বানায়, আরো অনেক কিছু দেখেই সে অবাক হলো।

রাতে বাসায় ফিরে রাফসান বলল, রফিক দেখেছো তো ঢাকা শহর কত্ত সুন্দর! রফিক বলল- হ্যাঁ, তবে আমাদের গ্রাম আরো সুন্দর। ওখানে নদী আছে, মাঠ আছে, ছোট ছোট ঘর আছে, বাগান আছে, আরো কত কি! এখানে ওসব কিছুই নেই। সব কেমন যেন বানানো বলে মনে হয়। জানো রাফসান, আমাদের গ্রামে বছরে একবার বড় মেলা হয়। বৈশাখী মেলা।’ রাফসান কখনো মেলায় যাওয়ার সুযোগ পায়নি। শব্দটা অদ্ভুত মনে হলো ওর কাছে। ও বলল মেলা? মেলা কী? কী থাকে ওখানে? রফিক বোঝাল,  মেলায় অনেক কিছু থাকে। নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস দল, জাদু খেলা আরো কত কি! মেলায় অনেক মানুষ আসে। কেউ বিভিন্ন জিনিস কেনাকাটা করে, কেউ আসে কেবল ঘুরতে। এই মেলা এত বড় হয় যে ঘুরতে ঘুরতে পা ব্যথা হয়ে যায় তাও ঘোরা শেষ হয় না। রাফসানের চোখ চকচক করে উঠল। বলল- রফিক প্লিজ, আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের মেলায়। রফিক বলল, নিশ্চই। ফুপুকে বলে তুমি আমার সঙ্গে গ্রামে চলো। আমি তোমাকে মেলা দেখাব। রাফসান খুব খুশি হলো। রাতে মাকে গিয়ে বলল, আমি গ্রামে যেতে চাই। মেলা দেখব। রফিক বলেছে নিয়ে যাবে।’ মা বললেন, ‘মেলায় যাবে মানে? সামনে তোমার পরীক্ষা। এখন তো কোথাও যাওয়া যাবে না বাবা। আর এখন যা গরম পড়েছে, তুমি গ্রামে গিয়ে থাকতে পারবে না। পরীক্ষা শেষ হোক, আমরা সবাই মিলে গ্রামে যাব।’

রাফসান সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘কিন্তু ততদিনে যে মেলা শেষ হয়ে যাবে মা। প্লিজ প্লিজ আমাকে যেতে দাও। বাবাকে বল না মা প্লিজ।’ মা শেষে ধমক দিয়ে বললেন, যাও পড়তে বসো। বলেছি না পরে যাবে, আর পরীক্ষার কথা শুনলে বাবাও রাজি হবেন না। যাও পড়তে যাও।’ মায়ের কথায় মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল রাফসানের। রফিকও মন খারাপ করে রইল। ঘুমানোর সময় রাফসান কেঁদে ফেলল। বলল- রফিক, আমার মেলায় যাওয়া হবে না। তুমিই বরং আমাকে মেলার গল্প শোনাও।’ মেলার গল্প শুনতে শুনতে রাফসান ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে উঠে ও দেখল ও রফিকের বাসায় চলে এসেছে। বিকেল হয়ে এসেছে। পাখি ডাকছে। মামি বলছেন যাও যাও জলদি বের হও, সন্ধ্যার আগে ফিরে এসো। রফিকের হাত ধরে ও মেলা দেখতে গেল। নদীর পাশে বড় একটা গাছ, নাম বটগাছ। তাকে ঘিরে বসেছে অনেক ছোট ছোট দোকান, কোথাও কাপড়ে ঘেরা বড় দোকান, কোথাও লেখা পুতুল নাচ আবার কোথাও জমজমাট সার্কাস পার্টি। ছেলেমেয়ে, যুবক যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ সব বয়সের মানুষের বিচিত্র সমাবেশ এখানে। সবার মুখে হাসি। ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে বেলুন। একদিকে একটা বড় চারকোনা নাগরদোলা ওপরে উঠছে আর নামছে। ওরাও নাগরদোলায় চড়ল। ছেলেমেয়েগুলো এখানে বসে কী যে চিৎকার করছে বলে বোঝানো যাবে না।

কেউ খুব হাসছে, একটা মেয়ে তো ভয়ে কেঁদেই ফেলল। এসব দেখে রাফসান খুব মজা পেল। ওরও একটু ভয় করছিল কিন্তু মজা লাগছিল তার চেয়েও বেশি। রফিক ওকে টেনে নিয়ে গেল জিলাপির দোকানে। ওরা অনেক জিলাপি খেল। এমন খাবার রাফসান ঢাকায় কখনো খায়নি। হঠাৎ রাফসান দেখল রফিক নেই। মেলায় লোকের ভিড়ে হাত যে কখন ছেড়ে দিয়েছে টেরই পায়নি। রাফসান ভয় পেয়ে রফিককে খুঁজতে লাগল। এর ফাঁকে সে আরো অনেক দোকান দেখল। মাটির পুতুল, হাঁড়ি, বাসন, কলসি, ফুলদানি, মাটির তৈরি বাঘ, হরিণ, মাছ, বেড়াল আরো অনেক কিছু দেখে রাফসান অবাক হলো। হঠাৎ ও দেখল রফিক ভিড়ের মধ্যে অন্য এক লোকের হাত ধরে উল্টা দিকে চলে যাচ্ছে। নিশ্চয় ও মনে করছে ওটা রাফসানের হাত! রাফসানের হাসি পেল আবার ভয়ও লাগল। যদি সে হারিয়ে যায় তবে আর বাড়ি পৌঁছাতে পারবে না। তাই সে জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকতে লাগল- রফিক রফিক রফিক...

মায়ের জোর ধাক্কায় ওর হুঁশ হলো। দেখল ও বিছানায় বসে আছে। মা বললেন, কী? এত জোরে জোরে রফিককে ডাকছিলে কেন? রাফসান বুঝল মেলায় যাওয়ার ঘটনা সত্যি নয়। শুধুই স্বপ্ন। আবার ওর মন খারাপ হয়ে গেল। সারা দিন ও আর কোনো কথাই বলল না। স্কুল ছুটি ছিল, তবু কোথাও বেড়াতে গেল না। মায়ের কাছেও কিছু আবদার করল না। শুধু মন খারাপ করে বসে রইল। আজ রফিক চলে যাবে গ্রামে, তাই সবাই তাকে বিদায় জানাতে গেল। রাফসানও গেল। ওর চোখে পানি। রফিকেরও মন খারাপ। হঠাৎ মা বললেন, তিনদিন থেকেই কিন্তু চলে এসো, কেমন? রাফসান বুঝল না। মা আবার বললেন, এই যে তোমার ব্যাগ। বাবা তোমাকে মামার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে বলেছেন। যাও, বেশি দুষ্টুমি করবে না কিন্তু।’ খুশিতে রাফসান কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করল, তারপর রফিকের হাত ধরে মুখভরা হাসি নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল।