গল্প

এক বীরকন্যার কথা

Looks like you've blocked notifications!

‘ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাঁকাতে হাঁকাতে ছুটে আসছে একজন বীর যোদ্ধা। চোখে-মুখে তার শত্রুকে ধ্বংস করার দৃঢ় প্রত্যয়। ইংরেজ সৈন্যদের ধ্বংস করতে বীর বিক্রমে এগিয়ে আসছে সে। না, কোনো পুরুষ নয়, একজন নারী। ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈ।’ কল্পনা দির গল্পটা মুখ হা করে শুনছিল রানি। বীর নারীদের গল্প তার খুব ভালো লাগে। খুব অবাক লাগে তার যে, কীভাবে একটি মেয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পারে জীবনের ভয় না করে! মাঝে মাঝে তার মনে হয় আমি যদি ঝাঁসির রানি হতে পারতাম, দেশের জন্য যুদ্ধে যেতে পারতাম,তাহলে পাজি ইংরেজগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতাম!

রানিরা অনেক ভাইবোন। মধুসূদন, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা আর সন্তোষ। রানির নাম হলো প্রীতিলতা। মা আদর করে নাম দিয়েছিলেন রানি। রানি খুব চুপচাপ আর লাজুক প্রকৃতির হলেও লেখাপড়ায় তার মনোযোগ খুব বেশি। তাই স্কুলে ভালো ফলাফল করে সে পড়তে গেল ঢাকার ইডেন কলেজে। সেখান থেকে আবার বিএ পড়ার জন্য গেল বেথুন কলেজে। শুধু পড়াশোনাই নয় রানির অপূর্ব বাঁশির সুর তার হোস্টেলের সব মেয়েদের মুগ্ধ করে রাখল। দেশের প্রতি ভালোবাসা যেন তার বাঁশির সুরে গলে পড়ল। রানি শান্ত প্রকৃতির হলেও মনে তার ভীষণ সাহস! দেশের জন্য কাজ করার কথা সে তখনো ভোলেনি। দেশে তখন ভয়ানক পরিস্থিতি। ইংরেজরা জোর করে এ দেশে রাজত্ব করছে। তাদের কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করতে চাইছে অনেক যুবক। যারা দেশ রক্ষার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তাদের সরকার নাম দিয়েছে ‘বিপ্লবী’। এই বিপ্লবীদের কথা শুনতে খুব পছন্দ করত রানি। সে চাইত বিপ্লবী হতে কিন্তু তখন মেয়েরা সরাসরি কোনো বিপ্লবে অংশ নিত না তাই রানিও বিপ্লবী হতে পারল না। তবে সে সবসময় দেশের জন্য কাজ করার চেষ্টা করত। আর বলত, আমি বিপ্লবী হবো। স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতেও পারব, প্রাণ নিতেও মায়া হবে না।

এর মাঝেই একদিন বিখ্যাত বিপ্লবী নেতা সূর্যসেন ও তার দল সরকারি টাকা লুট করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। সরকার বুঝতে পারল দেশের বিপ্লবী নেতারা তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। তাই তারা কোনো কারণ ছাড়াই বেঙ্গল অর্ডিনেন্স’ জারি করে যুবকদের আটক করা শুরু করল। রানির এক দাদা ছিল। তার নাম পূর্ণেন্দু দস্তিদার। তিনি রানিকে খুব বিশ্বাস করতেন। যখন দেশে বিপ্লবীদের ধরা হচ্ছিল তিনিও খুব ভয়ে ছিলেন। দেশ ও বিপ্লবের ওপর লেখা অনেক বই তিনি রানির কাছে গোপনে রাখতে দিলেন। এই বইগুলো সরকার নিষিদ্ধ করেছিল যাতে আর কেউ এগুলো পড়ে বিপ্লবী হতে না চায়। কিন্তু রানি সব বই পড়ে ফেলল। দেশের কথা ‘ক্ষুদিরাম’, ‘বাঘা যতীন’, ‘কানাইলাল’ ইত্যাদি বই সে মন দিয়ে পড়ল আর বিপ্লবী হওয়ার ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে উঠে-পড়ে লাগল। পূর্ণেন্দু দাদাকে গিয়ে বলল, ‘আমি দেশের জন্য কাজ করব। নাও না আমাকে সঙ্গে।’ কিন্তু তখনো বিপ্লবীদের দলে কোনো মহিলা নেওয়া হতো না বলে তখনকার মতো রানিকেও সক্রিয়ভাবে দলে নেওয়া গেল না তবে তাকে কাজ দেওয়া হলো। রানি ইডেন কলেজে থাকতে ‘শ্রীসংঘ’ নামে নারী বিপ্লবী সংগঠনের সাথে কাজ করেছিল। তার সেই অভিজ্ঞতা সে কাজে লাগাল। যোগ দিল লতিকা বোসের নারী সম্মেলনে।এভাবেই চলছিল।

একদিন রানি শুনল মাস্টারদা সূর্যসেনের দল চট্টগ্রামে ইংরেজদের অস্ত্রাগার লুট করেছে। এতে সারা দেশে নতুন করে বিপ্লব ছড়িয়ে গেল। তবে বিপ্লবী যুবকদের দলকে খুব সাবধান হতে হলো। এবার সময় এলো রানির। মহিলাদের তখন কেউ বিপ্লবী বলে সন্দেহ করত না বলে রানি সুযোগ পেল। সে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় সূর্যসেনের চিঠি, নির্দেশ, গোলাবারুদ বহন করতে লাগল। এই সাহসিকতার জন্য বিপ্লবীদের দলে তার নাম লেখা হলো। সাধারণ মেয়ে রানি থেকে সে হয়ে উঠল বিপ্লবী প্রীতিলতা।

এদিকে ইংরেজ সরকারের লোককে খুন করায় নেতা রামকৃষ্ণের ফাঁসির আদেশ হলো। ছদ্মবেশে তাঁর সাথে দেখা করতে গেল প্রীতি। মৃত্যুর আদেশ পেয়েও দেশের প্রতি অবিচল আস্থা ও ভালোবাসা ছিল রামকৃষ্ণের। তাঁর দৃঢ়তা দেখে অনুপ্রাণিত হলো প্রীতিলতা। তারপর বহু প্রতীক্ষা শেষে সে দেখা করতে পারল মাস্টারদা সূর্যসেনের সাথে। তখন তার চোখে মুখে বিপ্লব, দেশের জন্য শহীদ হওয়ার দৃঢ়তা। এরপর থেকেই শুরু হলো তার বিপ্লবী অভিযান। কখনো ‘কুটির’, কখনো ‘আশ্রম’, কখনো বা ‘কুন্তলা’ নামের গোপন আস্তানায় দলের সাথে কাজ করতে লাগল সে। অভাবের সংসার চালাতে রানি শিক্ষকতা করত। একসময় সে তার বেতনের পুরো টাকা দেশের জন্য দিয়ে দিল। তার কাজ আর দেশপ্রেমে মুগ্ধ হলেন সূর্যসেন।

প্রীতিলতাকে তিনি ইংরেজদের গুরুত্বপূর্ণ আড্ডাখানা ‘পাড়াতলী ইউরোপিয়ান ক্লাব’ আক্রমণের দায়িত্ব দিলেন। বলা হলো যদি কেউ আহত হয় তবে ইংরেজদের কাছে ধরা না দিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে তারা। ঝাঁসির রানির মতোই বাংলার বীরকন্যা প্রীতিলতা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে সাথীদের সাথে চলল দেশরক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করতে। তারা রাইফেল আর বোমা দিয়ে আক্রমণ করল ইংরেজদের ওপর। সফলও হলো কিন্তু গুলির আঘাতে আহত হলো প্রীতিলতা। বীর যোদ্ধার মতো দেশের জন্য সায়ানাইড খেয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করল সে। বাংলার বুকে প্রথম বীর নারী শহীদ হিসেবে নজির স্থাপন করল বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তার শোকে বাবা প্রায় পাগল হয়ে গেলেন আর মা বললেন- ‘আমার মেয়ে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। সে আমার গর্ব। একেই বলে বীরকন্যা।’