আমি মালালা বলছি

ব্যক্তিগত তালেবানীকরণ

Looks like you've blocked notifications!

‘চলো, আমরা মনে করি যে এটা টোয়াইলাইট ছবি এবং আমরা জঙ্গলের ভ্যাম্পায়ার,’ আমি মনিবাকে বললাম। আমরা স্কুল থেকে মর্গাবাজারে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে গেছি, সেটা ঠান্ডা বাতাসসমৃদ্ধ একটা সুন্দর সবুজ উপত্যকা, সেখানে একটা উঁচু পর্বত এবং স্বচ্ছ পানির নদী আছে। কাছেই হোয়াইট প্যালেস হোটেল। ওয়ালির গ্রীষ্মকালীন বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো এই হোটেল।

২০১২ সালের এপ্রিলে, আমাদের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের মাস তাই সবাই বেশ খোশমেজাজেই ছিল। আমরা প্রায় সত্তরজন মেয়ের একটা দল ছিলাম। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং আমার মা-বাবাও সঙ্গে ছিলেন। বাবা তিনটা ফ্লাইং কোচ ভাড়া করলেও আমাদের সবার জায়গা হচ্ছিল না। তাই আমরা পাঁচজন আমি, মনিবা এবং অন্য তিনজন মেয়ে স্কুলভ্যান বা ‘ডায়না’তে করে গেলাম। সেটা খুব আরামদায়ক ছিল না। কারণ গাড়ির মেঝেতে রাখা ছিল বনভোজনের জন্য বিশাল হাঁড়ি, সেখানে পোলাও, মুরগির মাংস রাখা ছিল। আধঘণ্টার পথ। আমরা গান গেয়ে, আনন্দ করতে করতে পৌঁছে গেলাম। মনিবাকে অনেক সুন্দর লাগছিল। ওর গায়ের রং অনেক উজ্জ্বল লাগছিল। ‘কী ক্রিম ব্যবহার করছো তুমি?’ আমি জিজ্ঞেস করি।

‘তুমি যেটা ব্যবহার করো, সেটাই,’ উত্তর দিল সে।

হোয়াইট প্যালেসে গিয়ে আমরা রানির ঘুমানোর জায়গা দেখলাম এবং সুন্দর ফুলসমৃদ্ধ বাগান দেখলাম, দুঃখজনকভাবে বন্যায় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা ওয়ালির কক্ষ দেখতে পেলাম না।

আমরা কিছুক্ষণ সবুজ বনে দৌড়াদৌড়ি করলাম, এরপর কিছু ছবি তুললাম, কাদাপানির ভেতর দিয়ে নদীতে হাঁটলাম এবং একজন আরেকজনের দিকে পানি ছিটালাম। সূর্যের আলোয় পানির ফোঁটা ঝিকমিক করতে থাকল। খাড়া পাহাড় বেয়ে একটা জলপ্রপাত নেমে গেছিল, আমরা কিছুক্ষণ পাথরের ওপর বসে সেটার শব্দ শুনলাম। এরপর মনিবা আবার আমার গায়ে পানি ছিটাতে শুরু করল।

‘এটা কোরো না। আমি জামা ভেজাতে চাই না।’ আমি অনুনয় করলাম। তার অপছন্দের দুটো মেয়ের সঙ্গে আমি হেঁটে চলে গেলাম। অন্য মেয়েগুলো যাকে বলে ‘আগুনে ঘি দেয়া’ তা-ই করল। আমার আর মনিবার আরেকটা ঝগড়ার প্রস্তুত প্রণালি ছিল সেটা। তাতে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু দুপুরের খাবার রান্না যেখানে হচ্ছিল সেই খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আমি আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। আমাদের ড্রাইভার উসমান ভাইজান বরাবরের মতোই আমাদের হাসালেন। ম্যাডাম মারিয়াম তাঁর বাচ্চা ছেলে এবং দুই বছর বয়সী মেয়ে হান্নাহকে এনেছিলেন, যে দেখতে ছিল ছোট্ট একটা পুতুলের মতো কিন্তু মাথা ছিল দুষ্টুমিতে ভরপুর।

খাওয়াটা পুরো একটা বিপর্যয়ের মতো ছিল। মুরগির তরকারি গরম করতে স্কুলের দপ্তরিরা প্যানগুলো আগুনে দিতেই তাদের ভয় লাগল যে এত মেয়ের জন্য খাবার হবে না, তাই তারা নদী থেকে পানি এনে সেখানে ঢালল। আমরা একটাকে ‘নিকৃষ্টতম মধ্যাহ্নভোজ’ আখ্যা দিলাম। খাবার এতই পানসে ছিল যে এক মেয়ে বলে বসল, ‘তরকারির ঝোলে আকাশটা দেখা যাচ্ছে।’

অন্য সব স্কুল ট্রিপের মতোই বাবা আমাদের সবাইকে পাথরের ওপর দাঁড়া করিয়ে দিনের অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। এবার সবাই কেবল খাবারটা কত খারাপ ছিল সেটা নিয়েই বলল। বাবা বিব্রত হলেন এবং কিছুক্ষণের জন্য, বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।

পরদিন সকালে স্কুলের এক কর্মী আমাদের সকালের নাশতার জন্য দুধ, রুটি ও ডিম নিয়ে আমাদের বাসায় এলেন। মহিলাদের অন্তঃপুরে থাকার নিয়ম, তাই বাবাই সব সময় দরজা খুলতে যেতেন। লোকটি বলল যে দোকানি তাকে ফটোকপি করা একটি চিঠি দিয়েছে।

সেটা পড়ে বাবার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ‘আল্লাহর কসম, এটা তো আমাদের স্কুলে বিরুদ্ধে ভয়াবহ রটনা।’ তিনি মাকে বললেন। তিনি পড়ে শোনালেন।

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা

কুশাল স্কুল নামের এনজিও পরিচালিত একটি স্কুল আছে। আমাদের দেশের ধর্মভীরু লোকজন এনজিও সম্পর্কে খুব খারাপ মনোভাব পোষণ করে, তাই মানুষকে ক্রোধান্বিত করার ভালো উপায় এটা বলা। এবং এই স্কুল হলো কুরুচি এবং অশ্লীলতার চর্চাকেন্দ্র। পবিত্র নবীর হাদিসে আছে, কোনো খারাপ কিছু দেখলে সেটা তোমরা নিজ হাতে থামাবে। তুমি অক্ষম হলে অন্যদেরকে বলবে, তাও সম্ভব না হলে এটা কত খারাপ তা সম্পর্কে মনে মনে ভাববে। সেখানকার অধ্যক্ষের সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ নেই কিন্তু ইসলাম যা বলে আমিও আপনাদের তাই বলছি। কুরুচি আর অশ্লীলতার এই স্কুল বিভিন্ন রিজোর্টে মেয়েদেরকে বনভোজনে নিয়ে যায়। এটা না থামালে আপনারা কেয়ামতের দিন আল্লাহর মুখোমুখি হবেন। হোয়াইট প্যালেস হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করুন, সে বলবে এই মেয়েরা কী করেছে...।’

তিনি কাগজটা নামিয়ে রাখলেন। ‘কারো সই নেই। অজ্ঞতনামা।’

আমরা স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। ‘তারা জানে কেউ গিয়ে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করবে না,’ বাবা বললেন, ‘মানুষ শুধু অনুমান করবে ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে।’

‘আমরা জানি সেখানে কী হয়েছে। মেয়েরা তো খারাপ কিছু করেনি।’ মা তাঁকে আশ্বস্ত করলেন।

চিঠিগুলো কতখানি ছড়িয়েছে, তা জানতে বাবা আমার জ্ঞাতিভাই খানজীকে ফোন দিলেন। সে দুঃসংবাদ নিয়ে ফিরতি কল করল। চিঠি সবখানেই দেওয়া হয়েছে, যদিও বেশির ভাগ দোকানিই সেগুলো অগ্রাহ্য করে কাগজ ফেলে দিয়েছে। মসজিদের সামনে এই একই কথা লিখে দানবাকৃতির পোস্টার সাঁটা আছে।

স্কুলে আমার সতীর্থরা আতঙ্কিত ছিল। ‘স্যার, তারা আমাদের স্কুল নিয়ে অনেক বাজে কথা বলছে’, তারা আমার বাবাকে বলল। ‘আমাদের বাবা-মায়েরা কী বলবেন?’

বাবা উঠানে সব মেয়েকে জড়ো করলেন। ‘কেন তোমরা ভয় পাচ্ছো?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ‘তোমরা কি ইসলামবিরোধী কিছু করেছ? তোমরা অনৈতিক কিছু করছে? না। তোমরা শুধু পানি ছিটিয়েছ আর ছবি তুলেছ, তাই ভয় পেও না। এই বিবৃতি মোল্লা ফজলুল্লাহর অনুসারীদের। ওরা নিপাত যাক। ছেলেদের মতো তোমাদেরও অধিকার আছে প্রকৃতির শ্যামলতা ও জলপ্রপাত উপভোগ করার।’

বাবা সিংহের মতো করে কথা বলেছিলেন, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম ভেতরে ভেতরে তিনি চিন্তিত ও ভীত। শুধু একজন ব্যক্তি এসে তার বোনকে স্কুল থেকে সরিয়ে নিল, কিন্তু আমরা জানতাম এটাই শেষ না। অল্প কদিন পরই আমরা শুনলাম যে ডেরা ইসমাইল খান থেকে এক শান্তিপূর্ণ পদযাত্রী মিঙ্গোরা আসছেন এবং আমরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে চাইলাম। মা-বাবার সঙ্গে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করার পথে ছিলাম তখনই দেখলাম এক খাটো লোক উত্তেজিত হয়ে দুটি ফোনে কথা বলছে। ‘ওদিক দিয়ে যাবেন না,’ তিনি তাড়া দিয়ে বললেন। ‘ওখানে একজন আত্মঘাতী বোমারু আছে।’ আমরা শান্তিপূর্ণ পদযাত্রাকারী ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করব বলে কথা দিয়েছিলাম, তাই অন্য রাস্তায় গিয়ে তাঁর গলায় একটি মালা পরিয়েই দ্রুত বাড়ির পথ ধরলাম।

সেবার পুরো গ্রীষ্ম এবং বসন্তে আজেবাজে ঘটনা ঘটাতে থাকল। অপরিচিত লোকেরা আমাদের বাসায় এসে আমার পরিবার সম্পর্কে প্রশ্ন করত। বাবা বলতেন, তাঁরা ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস থেকে এসেছেন। বাবা এবং সোয়াত কওমি জিরগা যখন মিঙ্গোরার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে এবং আমাদের সমাজ রক্ষা কমিটিকে রাতের টহলের নিয়ন্ত্রণ নিতে আমাদের স্কুলে সভা করা হলো। এরপর এসব লোকজনের আসা-যাওয়া বেড়ে গেল। ‘সেনাবাহিনী বলে যে শান্তি আছে,’ বাবা বললেন, ‘তাহলে কেন আমাদের পতাকা মিছিল আর রাত্রিকালীন টহল অভিযান প্রয়োজন?’

এরপর মিঙ্গোরার বাচ্চাদের জন্য আমাদের স্কুল একটি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, যার স্পন্সর ছিল নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি এনজিওর মালিক, আমার বাবার এক বন্ধু। ছবির বিষয়বস্তু হতে হবে লিঙ্গসমতা অথবা নারীর প্রতি বৈষম্য। সেদিন সকালে ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস থেকে দুজন লোক আমাদের স্কুলে বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ‘আপনার স্কুলে কী চলছে এসব?’ তারা জেরা শুরু করল।

‘এটা একটা স্কুল,’ তিনি জবাব দিলেন। ‘বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রান্না প্রতিযোগিতা এবং রচনা প্রতিযোগিতার মতোই এটা একটা চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।’ লোকগুলো খুব রেগে গেল, সেই সঙ্গে বাবাও। ‘সবাই জানে আমি কে এবং কী করি।’ তিনি বললেন। ‘আপনারা নিজের কাজ করেন না কেন? ফজলুল্লাহ এবং যাদের হাত সোয়াতের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করেন না কেন?’

সেই রমজানে করাচিতে বসবাসকারী বাবার বন্ধু ওয়াকিল খান গরিবদের জন্য কাপড় পাঠালেন। চাইছিলেন সেগুলো আমরা বিতরণ করি। আমরা তা করতে বড় একটি হলে এলাম। কাজ শুরুও করিনি, তখনই ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের প্রতিনিধিরা এসে বলল, ‘এসব কী করছেন আপনারা? কে এনেছে এসব কাপড়?

জুলাইয়ের ১২ তারিখ আমার বয়স হলো চৌদ্দ, যার অর্থ ইসলামের দৃষ্টিতে আমি প্রাপ্তবয়স্ক। আমার জন্মদিনের সঙ্গেই একটি শান্তি কমিটির সদস্য সোয়াত কন্টিনেন্টাল হোটেলের মালিককে তালেবানরা হত্যা করেছে। তিনি মিঙ্গোরা বাজারে তাঁর হোটেলে যাওয়ার পথে একটি মাঠে তারা তাঁকে অ্যামবুশ করে।

আরেকবার মানুষের দুশ্চিন্তা শুরু হলো, তালেবানরা হয়তো ফিরে আসছে। কিন্তু যেখানে ২০০৮-০৯-এর দিকে সব ধরনের লোককে নানা ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল, এবারের হুমকিগুলো দেওয়া হচ্ছে বিশেষভাবে যারা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বা সেনাবাহিনীর স্বেচ্ছাচারী আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলছে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে।

‘আমরা যতটা ভাবি,তালেবানরা আসলে ততটা সংগঠিত শক্তি নয়,’ এ ব্যাপারে আলোচনা হতেই বাবার বন্ধু হিদায়াতুল্লাহ বললেন। ‘এটা আসলে একধরনের মানসিকতা, আর এই মানসিকতা আছে পুরো পাকিস্তানেই। যে আমেরিকার বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে, ইংরেজ আইনের বিরুদ্ধে, সে-ই তালেবানদের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে।’

আগস্টের ৩ তারিখ সন্ধ্যার শেষদিকে বাবা জিও টিভির এক সংবাদদাতা মেহবুবের কাছ থেকে উদ্বেগ করার মতো ফোন পেলেন। মেহবুব বাবার বন্ধু হোটেল মালিক জাহিদ খানের ভাতিজা। জাহিদ খান ২০০৯ সালে আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। মানুষ বলত, আমার বাবা আর জাহিদ খান দুজনই তালেবানদের নজরে আছে এবং দুজনই নিহত হবে, কেবল তারা জানত না, কাকে আগে হত্যা করা হবে। মেহবুব আমাদের বলল, তার চাচা এশার নামাজ আদায় করতে তাঁর বাসার কাছের মসজিদে যাওয়ার পথে মুখমণ্ডলে গুলিবিদ্ধ হন।

বাবার ভাষায় খবরটা শোনার পর তাঁর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল। ‘মনে হচ্ছিল যেন আমিই গুলি খেয়েছি,’ তিনি বলেছিলেন। ‘আমি নিশ্চিত হলাম যে এবারই আমার পালা।’

অনেক রাত হওয়ায় আমরা বাবাকে হাসপাতালে না যেতে অনুরোধ করলাম, তা ছাড়া জাহিদ খানের আক্রমণকারীরা আমার বাবার জন্যও অপেক্ষা করে থাকতে পারে। কিন্তু বাবা কাপুরুষতা করতে রাজি হলেন না। কয়েকজন রাজনৈতিককর্মী তাঁকে সঙ্গ দিতে চাইলেও তিনি ভাবলেন, ওদের জন্য অপেক্ষা করলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই তিনি তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য আমার জ্ঞাতিভাইকে ডাকলেন। মা দোয়া করতে শুরু করলেন।

তিনি হাসপাতালে গিয়ে দেখলেন, জিরগার কেবল একজন সদস্য উপস্থিত। জাহিদ খানের এত রক্তক্ষরণ হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল তাঁর সাদা দাড়িকে লালরঙে চুবানো হয়েছে। তাঁর ভাগ্য ভালো ছিল। লোকটা পিস্তল দিয়ে খুব কাছ থেকে তাঁকে গুলি করে, কিন্তু জাহিদ খান তার হাত আঁকড়ে ধরতে সক্ষম হওয়ায় শুধু প্রথম গুলিটাই লাগে। আশ্চর্যজনকভাবে সেটা তাঁর গাল দিয়ে প্রবেশ করে নাক দিয়ে বের হয়ে যায়। পরে তিনি জানালেন, একেবারে মুখোশবিহীন ক্লিনশেভড ছোটখাটো একটা লোক, মুখে মুচকি হাসি, তাঁকে গুলি করেছিল। এর পরই যেন অন্ধকার তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, যেন তিনি এক কালো গর্তে পড়ে গেছেন। শ্লেষের ব্যাপারে এই যে, কদিন আগেই জাহিদ খান সবকিছু নিরাপদ ভেবে হেঁটে মসজিদে যাওয়া শুরু করেছিলেন।

বন্ধুর জন্য প্রার্থনা শেষ করার পর বাবা মিডিয়ার সঙ্গে কথা বললেন। ‘শান্তি আছে দাবি করার পরও তার ওপর হামলা করা হলো কেন সেটা আমরা বুঝতে পারছি না।’ তিনি বললেন, ‘সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের জন্য বড় একটা প্রশ্ন এটি।’

মানুষ বাবাকে হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল। ‘জিয়াউদ্দিন, এখন মধ্যরাত আর তুমি এখনো এখানে। বোকামি করো না। তারা বলল ‘তুমি তার মতোই বিপদগ্রস্ত এবং তার মতোই লক্ষ্যবস্তু। আর ঝুঁকি নিও না।’

অবশেষে জাহিদ খানকে পেশোয়ারে অস্ত্রোপচারের জন্য পাঠানো হলো এবং বাবা বাড়ি ফিরলেন। আমি দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে যেতে পারিনি। এর পর থেকে প্রতি রাতে আমি বাড়ির প্রতিটা তালা দুবার করে পরীক্ষা করতাম।

বাসায় বাবাকে লোকজন ফোন করে বারবার সাবধান করে দিত যে তিনিই পরবর্তী ব্যক্তি, তাঁদের ফোনকলের কারণে আমাদের ফোনের বেজে ওঠার শব্দ থামতই না। এদের প্রথম কয়েকজনের মধ্যে ছিলেন হিদায়াতুল্লাহ। ‘আল্লাহর ওয়াস্তে সাবধানে থেকো,’ তিনি সতর্ক করে দিলেন। ‘এটা তো তোমার বেলায়ও ঘটতে পারত। তারা একেক করে জিরগার সদস্যদের গুলি করছে। তুমি হলে মুখপাত্র, কীভাবে আশা করো তারা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে?’

বাবা নিশ্চিত হয়েই গেলেন তালেবানরা তাঁকে খুঁজে বের করে মেরে ফেলবে, কিন্তু তিনি আবারও পুলিশি নিরাপত্তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। ‘অনেক নিরাপত্তা নিয়ে বাইরে গেলে তালেবানরা কালাশনিকভ বা আত্মঘাতী বোমারু ব্যবহার করবে এবং অনেক মানুষ মারা যাবে,’ তিনি বললেন। ‘অন্তত আমাকে একাই মৃত্যুবরণ করতে দাও।’ আবার তিনি সোয়াতও ছেড়ে যাবেন না। ‘কোথায় যাব?’ তিনি আমার মাকে জিজ্ঞেস করলেন। ‘আমি এ জায়গা ছাড়তে পারব না। আমি গ্লোবাল পিস কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট, কাউন্সিল অব এল্ডার্সের মুখপাত্র, সোয়াত অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট স্কুলসের প্রেসিডেন্ট, আমার নিজের স্কুলের পরিচালক এবং আমার পরিবারের প্রধান।’

ঝুঁকি সত্ত্বেও আমার বাবা এবং তাঁর বন্ধুরা প্রতিবাদ সমাবেশ এবং সংবাদ সম্মেলনের দ্বারা প্রতিবাদ চালিয়ে গেলেন। ‘শান্তি যদি থেকেই থাকে তবে জাহিদ খানের ওপর আক্রমণ হলো কেন? কে তার ওপর হামলা চালিয়েছে? তাঁরা প্রশ্ন করলেন। ছিন্নমূল অবস্থা থেকে ফেরার পর থেকে আমরা সেনাবাহিনী বা পুলিশের ওপর কোনো আক্রমণ হতে দেখিনি। একমাত্র টার্গেট হলো শান্তিকামী এবং সাধারণ নাগরিক।

স্থানীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার খুশি হলেন না। আমি আপনাদের নিশ্চিত করছি, মিঙ্গোরায় কোনো সন্ত্রাসী নেই, তিনি জোর দিয়ে বললেন। আমাদের রিপোর্ট তাই বলে। তিনি দাবি করলেন যে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের জের ধরে জাহিদ খানকে গুলি করা হয়েছে।

জাহিদ খান ১২ দিন হাসপাতালে ছিলেন এবং নাক মেরামত করার জন্য প্লাস্টিক সার্জারি করার পর এক মাস বাসায় আরোগ্য লাভের জন্য ছিলেন। কিন্তু তিনি চুপ করে থাকতে অস্বীকৃতি জানালেন। কিছু যদি হয়ে থাকে তিনি আরো স্পষ্টবাদী হয়ে উঠলেন, বিশেষত ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, তারাই তালেবানের মূল হোতা। পত্রিকায় তিনি লিখলেন ‘সোয়াতের দ্বন্দ্ব’। ‘আমি জানি কারা আমাকে টার্গেট করেছে। যে জিনিসটা জানা প্রয়োজন তা হলো কে এসব জঙ্গিদের আমাদের ওপর লেলিয়ে দিয়েছে,’ তিনি লিখলেন। কারা তালেবানদের আমাদের উপত্যকায় এনেছে, সে ব্যাপারে তদন্ত করতে একটি বিচার কমিশন তৈরি করতে প্রধান বিচারপতির প্রতি দাবি জানালেন।

জাহিদ খান তাঁর আক্রমণকারীর একটি স্কেচ আঁকলেন এবং বললেন, সে আর কাউকে গুলি করার আগেই তাকে থামানো উচিত। কিন্তু তাকে খুঁজে পেতে পুলিশ কোনো পদক্ষেপই নিল না।

এসব হুমকির পর মা আমাকে যে কোনো জায়গায় হেঁটে যেতে দিতে পছন্দ করতেন না এবং বারবার বললেন আমি যাতে স্কুলে যাওয়ার জন্য রিকশা নিই এবং ফেরার সময় বাসে আসি, যদিও সেটা ছিল মাত্র পাঁচ মিনিটের পায়ে হাঁটা রাস্তা। বাস আমাদের বাসার সামনের রাস্তায় নামিয়ে দিত। আশপাশের বাসার একদল ছেলে সেখানে ঘোরাঘুরি করত। মাঝে মাঝে আমার চেয়ে এক বছরের বড় এক ছেলে তাদের সঙ্গে থাকত। তার নাম ছিল হারুন এবং সে আগে আমাদের সঙ্গে একই সড়কে থাকত। ছোটবেলায় আমরা একসঙ্গে খেলতাম এবং পরে সে আমাকে বলে যে সে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু একদিন আমাদের প্রতিবেশী সাফিনার বাসায় তার এক সুন্দরী জ্ঞাতিবোন আসে এবং সে ওই মেয়েটার প্রেমে পড়ে। সে যখন জানাল যে সে আগ্রহী নয় তখন ছেলেটি আবার আমার দিকে মনোযোগ দিল। এরপর তারা অন্য এলাকায় চলে গেল এবং আমরা তাদের বাসায় উঠলাম। এরপর হারুন আর্মি ক্যাডেট কলেজে চলে গেল।

কিন্তু ছুটিতে সে বাড়ি ফিরল এবং আমি একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, সে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে। সে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত অনুসরণ করল এবং আমাদের গেটে আমি দেখতে পাই এমন জায়গায় একটা চিরকুট রেখে গেল। ছোট একটা মেয়েকে আমি সেটা আনতে পাঠালাম। হারুন লিখেছিল, ‘এখন তুমি অনেক বিখ্যাত হয়ে গেছ, আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি এবং জানি তুমিও আমাকে ভালোবাস। এটা আমার নম্বর, কল দিও।’

আমি চিরকুটটা বাবাকে দিলে তিনি খুব রেগে গেলেন। তিনি হারুনকে ডেকে বললেন যে তিনি এটা তার বাবাকে বলে দেবেন। হারুনের সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। এরপর ওই ছেলেরা রাস্তায় ঘোরা বন্ধ করে দিল কিন্তু অতলের খেলার সাথী এক ছোট ছেলে আমি আশপাশ দিয়ে চললেই ইঙ্গিতপূর্ণভাবে জিজ্ঞেস করত, ‘হারুন কেমন আছে?’ আমি এত বিরক্ত হয়ে গেলাম যে একদিন অতলকে বললাম ছেলেটাকে ভেতরে আনতে। তাকে আমি এত রাগান্বিত স্বরে বকলাম যে সে ও রকম আর করত না।

আমি মনিবাকে এসব ঘটনা জানালাম। একসময় আমাদের বন্ধুত্ব আবার আগের মতো হয়ে গেল। মনিবা ছেলেদের সঙ্গে কথা বলার সময় সাবধান থাকত, কারণ তার ভাইয়েরা সবকিছুতে নজর রাখত। ‘মাঝেমধ্যে মনে হয় সোয়াতের মেয়ে হওয়ার চেয়ে টোয়াইলাইটের ভ্যাম্পায়ার হওয়া অনেক ভালো,’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম। কিন্তু আমরা জানতাম, এখানে কোনো ছেলের সঙ্গে ঝামেলা মানে অনেক বড় সমস্যায় পড়ে যাওয়া।

 

(চলবে)