চলমান সুন্দর কাজী নজরুল ইসলাম

Looks like you've blocked notifications!

একজন  লেখকের কাজ কী? কেবল কবিতা গল্প উপন্যাস বা গান লেখা? না, তাঁর অনেক কাজ থাকে, থাকে দায়িত্ব দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি।কিন্তু সবাই সেই দায়িত্ব পালন করেন না। কেউ কেউ করেন। সেই কেউয়ের অন্যতম  কাজী নজরুল ইসলাম।তিনি জন্মেছিলেন পরাধীন ভারতে কিন্তু চেতনায় ধারণ করতেন বিদ্রোহী সত্ত্বা। তাঁর গল্প কবিতা উপন্যাসে এই বিদ্রোহের ঘটনা সব সময়ে প্রবহমান থাকত। ফলে, সাত সাগর আর তের নদীর ওপার থেকে আসা ইংরেজ বেনিয়ারা কাজী নজরুলের লেখা ভয় করত।তিনিই ব্রিটিশ ভারতে প্রথম কবি  যাকে তাঁর লেখার জন্য জেলে যেতে হয়েছে।

কাজী নজরুল ইসলাম, বাংলা সাহিত্যের এই মহান পুরুষ জন্মেছেন ১৮৯৯ সালের ২৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। জন্মেই তিনি দেখেছেন স্বদেশ ভূমি বিক্ষুব্ধ। তার ওপর ছিল পরিবারের কঠোর দারিদ্র্যপূর্ণ অবস্থা।

কিন্তু নজরুলের মধ্যে একটা অদম্য স্বভাব ছিল, সব প্রতিকূল পরিবেশকে হাসি মুখে বরণ করে নেওয়ার চমৎকার ক্ষমতা। কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্ম বহুমুখি আর বৈচিত্র্যে ভরা। তিনি শৈশবে লেটো দলে গান গাইতেন।নিজের মুখে মুখে গান বাঁধতে পারতেন। রাগ করে চলে এলেন কলতাকায়। সেখানে চাকরি নিলেন এক রুটির দোকানে। দোকানে কাজের ফাঁকে ফাঁকে গাইতেন গান। তাঁর গানে মুগ্ধ হলেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের কাজিরশিমলা গ্রামের দারোগা রফিজ উদ্দিন ভুইয়া। রফিজ উদ্দিন ভুইয়া কিশোর নজরুলের সহজাত প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে নিয়ে এলেন কাজিরশিমলা গ্রামে।ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে। সময়টা গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক। সেই সময় চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ডাক পেলেন সৈন্যদলে যোগ দেওয়ার। তিনি লেখাপড়া ছেড়ে চলে গেলেন সৈন্যদলে।

বছর খানেক পর যুদ্ধের ময়দার থেকে ফিরে এসে লেখালেখির জগতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। লিখতে থাকলেন একের পর এক গান, গল্প  আর আগুনে ঝলসানো কবিতা।

তাঁর কবিতা ও গানে মূর্ত হয়ে ওঠে মানুষ ও সভ্যতার গান। তিনি জগতে সব কিছুর উপরে মানুষ ও মানবতাকে সবার উপরে জায়গা দিলেন। সেই সময়ে চলছিল ব্রিটিশবিরোধী তীব্র আন্দোলন। কবি নজরুল তাঁর লেখায় একের পর এক ফুটিয়ে তুলতে লাগলেন। লিখতে লাগলেন ব্রিটিশদেন বিরুদ্ধে জাগরণী গান ও কবিতা। ব্রিটিশরা দেখল  এই নজরুল তো তাদের জন্য এক বিপজ্জনক। তাঁকে বাইরে রাখলে আরো অগ্নি ছড়াবে। সেই কবিতা গানের অগ্নিতে আগুন লাগবে শাসনে ও শোষণে। সুতরাং তাঁকে জেলে পুরে  রাখ।

যেই কথা সেই কাজ নজরুলের কবিতা ও গানের আগুন থামাতে জেলে পোরা হলো। মনে রাখতে হবে, তিনিই একমাত্র কবি, লেখক যাকে ব্রিটিশরা লেখার জন্য কারাগারে নিয়ে যায়। কিন্ত তিনি তো বিদ্রোহী। যার চলনে, বলনে, কথায় ও কবিতায় কেবল বিদ্রোহীর বান ডেকে যায়, তিনি কি কারাগারেও চুপ করে থাকবেন? নিশ্চয়ই না। সেখানে, কারাগারের গভীর অন্ধকারের ভেতরও তিনি তাঁর বিদ্রোহী মশাল তুলে ধরলেন। তাঁকে দণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদে অনশন করতে শুরু করলেন। প্রায় মাস খানেক তিনি না খেয়ে থাকলেন। কবি ও বিদ্রোহী নজরুলের জন্য সমগ্র উপমহাদেশ বেদনায় ও আগ্রহে ব্যাকুল।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জেলে অনশন ভঙ্গের আবেদন জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠালেন। তিনি টেলিগ্রামে লিখলেন  ‘তোমাকে দেশ ও জাতির প্রয়োজন আছে।’ কী অসাধারণ সন্মান জানিয়েছিলেন বিশ্বকবি এক বিদ্রোহী কবিকে। এভাবেই বাংলা সাহিত্য যুগে যুগে সমৃদ্ধ হয়েছে। একে অপরের সঙ্গে নিবিড় যোগসূত্র তৈরি করেছে। তাইতো আমাদের বাংলা সাহিত্য আজ এত সুন্দর ও সমৃদ্ধ।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে অনেক নামে ডাকা হয়। যেমন  মানুষের কবি, চারণ কবি, মানবতার কবি, সুন্দরের কবি। আর সবার আগে বিদ্রোহী কবি।বিদ্রোহী কবি বললে আমাদের সামনে বাবরী দোলানো ঝাকড়া চুলের শ্যামলা রঙের বলিষ্ঠ গড়নের দিব্যকান্তিময় নজরুল সামনে এসে দাঁড়ান। তাঁর এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশি, অন্য হাতে বিদ্রোহী রণতূর্য।

কাজী নজরুল ইসলাম কেবল বড়দের জন্য লেখেননি।তিনি ছোটদের জন্যও প্রচুর লিখেছেন। আমরা আমাদের পাঠ্য পুস্তকে তাঁর লেখা অনেক সুন্দর আর মিষ্টি কবিতা পড়ে পড়ে বড় হচ্ছি। যেমন একটা কবিতা- ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে...।’ আর  লিচুচোর কবিতা তো আমাদের প্রতিদিনের মধুর স্মৃতি। আরো অনেক কবিতা-গান তিনি ছোটদের জন্য রচনা করছেন। কয়েকটি বইয়ের নাম : ঝিঙেফুল, পিলে পটকা, ঘুমজাগানো পাখি, ঘুমপাড়ানী মাসিপিসি। নাটক লিখেছেন : পুতুলের বিয়ে। 

কাজী নজরুল দারিদ্র্যের মধ্যে জন্ম নিলেও সব সময়ে হাসিখুশি আর উদ্দাম থাকতেন। তাঁর ঝিঙেফুল কবিতার কয়েকটি লাইন-

ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল

সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে- ফুল

ঝিঙে ফুল।

গুল্মে পর্ণে

লতিকার  কর্ণে

ঢলঢল স্বর্গে

ঝলমল দোলো দুল

ঝিঙে ফুল।।

পাতার দেশের পাখি বাঁধা হিয়া বোঁটাতে

গান তব শুনি সাঁঝে তব ফুটে ওঠাতে ।

আরো সুন্দর ও বর্ণাঢ্য কবিতা লিখেছেন তিনি। এই মহান মানুষ জীবনের শেষ দিকে অনেক বছর মৌন ছিলেন। কথা বলতে পারতেন না। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। কবি ধানমণ্ডির  একটি বাড়িতে থাকতেন। সেই ভবনটাকে এখন ‘কবি ভবন’ বলা হয়ে থাকে।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি ঢাকায় পরলোকগমন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। তিনি আমাদের মাঝে শারীরিকভাবে বেঁচে নেই ঠিকই কিন্তু তিনি আমাদের মাঝে সুন্দরের পতাকা, হাসির ফোয়ারা হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।