যে কারণে ৫৭ ধারা সমালোচিত
তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ২০১৩-এর ৫৭ ধারা নিয়ে সারা দেশে বিতর্ক চলছেই। এরই মধ্যে এ আইন বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট মামলা বিচারাধীন। সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে আটকের পর থেকেই মূলত এ আইন নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে। কী আছে এ আইনে? এবং কীভাবে অপব্যবহার হতে পারে এ আইনের? এবং কেন এ আইন বাতিলের দাবি উঠেছে, সে বিষয়টি নিচে তুলে ধরা হলো :
তথ্যপ্রযুক্তি আইন তৈরির ইতিহাস
বাংলাদেশে মূলত তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ২০০৬ সালে প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি আইন তৈরি করা হয়। ওই আইনে নয়টি অধ্যায়ে মোট ৯০টি ধারা যুক্ত করা হয়। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ল্যাপটপ, স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যায়। এ আইনের অপব্যবহার ও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিষয়টি অনুধাবণ করে সরকার ২০১১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে সংশোধন আনার চিন্তা শুরু করে। এবং এ আইনের শাস্তি ও আইন প্রয়োগে পরিবর্তন আনার চিন্তা করে। অবশেষে ২০১৩ সালে তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধন করে এ আইন প্রণয়ন করা হয়। একই বছরের ৮ অক্টোবর সংসদে আইনটি সংশোধিত আকারে পাস করা হয়।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় যা রয়েছে
৫৭-এর ১ উপধারায় বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
অপরাধের শাস্তি
৫৭ ধারার ২ নম্বর উপধারায় বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১)-এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং ন্যূনতম সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
আইনের ৫৭ ধারার সমালোচনা
তথ্যপ্রযুক্তি আইনটি সংশোধন করে ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর থেকে সমোলাচনা শুরু হয়। কেননা, এ আইনে পুলিশকে সরাসরি মামলা করার ও পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকারকর্মী ও সংবাদকর্মী ছাড়াও অনলাইন ব্যবহারকারীদের অনেকেই মনে করছেন, এ আইনের অপব্যবহার হতে পারে। তাদের শঙ্কার কথা অবশ্য এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।
আইনজীবীর চোখে ৫৭ ধারার বিশ্লেষণ
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আইনটির বিশ্লেষণ করে এর অপব্যবহার সম্পর্কে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বিশ্লেষণ করলে সাতটি বড় ধরনের অস্পষ্টতা দেখা যায়। তা হলো, মিথ্যা ও অশ্লীল, নীতিভ্রষ্টতা, মানহানি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি।’
ব্যারিস্টার বড়ুয়া আরো বলেন, ‘ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচারের কথা বলা হচ্ছে, যা হবে মিথ্যা বা অশ্লীল। কিন্তু সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নীতি বা নৈতিকতার কথা বলা থাকলেও কোন কোন বিষয়বস্তুকে অশ্লীল বা মিথ্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে, তা এই ধারায় সুস্পষ্ট করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে এ আইনটি সুনির্দিষ্টতার অভাবের কারণে দুষ্ট। এ কারণেই এ আইনের অপ্রয়োগের অনেক বেশি সুযোগ রয়েছে।’
ব্যারিস্টার বড়ুয়া সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের আটকের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘নিরাপত্তা না পেয়ে যিনি ফেসবুকে অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন, তাঁকে নিরাপত্তা না দিয়ে উল্টো অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দেওয়া মামলায় আটক করা অস্বাভাবিক। এখানেও আইনের অপপ্রয়োগ স্পষ্ট।’
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, ‘সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা সাংঘর্ষিক। এই ধারাটি সংবাদপত্র ও নাগরিকের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে, যা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। ৩৯ অনুচ্ছেদে দেশের সব নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।’
বড়ুয়া আরো বলেন, ‘৫৭ ধারা যদি প্রচলিত থাকে, তাহলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহার করে অপছন্দের যে কাউকে দমন-পীড়ন চালানো যাবে। এমনিতেই মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। আর এই আতঙ্ক থাকলে আর যাই হোক, চিন্তার স্বাধীনতা থাকে না।’
এ আইন বাতিল প্রসঙ্গে সরকারের মনোভাব
আইনটি নিয়ে সরকারের মধ্যেও মতবিরোধ রয়েছে। সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আইনটি বাতিলের দাবি বিবেচনা করে দেখা হবে। এ ছাড়া তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, এ আইন বাতিল বা সংশোধনে জাতীয়ভাবে আলোচনা হতে পারে।