বার্লিন প্রাচীর ঐক্যের প্রতীক

Looks like you've blocked notifications!

১৩ আগস্ট, ১৯৬১। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মাঝে সীমারেখা নির্মাণের উদ্দেশ্যে এই প্রাচীরের নির্মাণকাজ শুরু হয়। যদিও বলা হয়েছিল সীমান্তপ্রাচীর নির্মাণ কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব জার্মানি থেকে আসা শরণার্থীদের স্রোতে বাধা সহ আরো কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সোভিয়েত ইউনিয়নের দাবি অনুযায়ী এ প্রাচীরের মাধ্যমে পূর্ব জার্মানি এবং ওয়ারশ ভোট ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোতে পশ্চিমা গুপ্তচরদের অনুপ্রবেশ রোধ করা হয়। পশ্চিম বার্লিনের চারপাশে ১৫৬ কিমি দীর্ঘ এ দেয়ালের ৪৩ কিমি সরাসরি দুই অংশকে পৃথক করে ফেলে। পূর্ব এবং পশ্চিম বার্লিনের মাঝে যাতায়াতের জন্য আটটি আনুষ্ঠানিক পথ ছিল। পশ্চিম বার্লিনবাসী, পশ্চিম জার্মানির নাগরিক, পশ্চিমা বিশ্বের নাগরিক, অন্যান্য দেশের নাগরিক, অনুমতিপ্রাপ্ত পূর্ব বার্লিনবাসী এ পথগুলো ব্যবহার করত।

পশ্চিম বার্লিন এবং একে ঘিরে থাকা পূর্ব জার্মানির অন্য অংশগুলোর মাঝেও কয়েকটি যাতায়াতের পথ ছিল। পশ্চিম বার্লিনবাসীরা পূর্ব জার্মানি, পশ্চিম জার্মানি এবং অন্যান্য দেশ যেমন ডেনমার্ক, চেকোস্লাভাকিয়াতে (বর্তমান নাম চেক রিপাবলিক), সেখানে যাওয়ার জন্য এবং পূর্ব জার্মানদের পশ্চিম বার্লিনে প্রবেশের জন্য এগুলো ব্যবহৃত হতো। 

 লেখক আবদুল্লাহ আল রায়হান

পূর্ব জার্মানি কর্তৃপক্ষ প্রাচীর অতিক্রমের চেষ্টাকারী যে কাউকে দেখামাত্র গুলি করার জন্য সীমান্ত প্রহরীদের নির্দেশ দিয়েছিল, নারী আর শিশুদের ক্ষেত্রেও এই আদেশ ছিল সমান কার্যকর। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর কনটেম্পরারি হিস্টরিকাল রিসার্চের মতে, মৃতের সংখ্যা ১৩৩ যদিও শেষ পর্যন্ত এ সংখ্যা দুই শতাধিক ছাড়িয়েছিল। 

এভাবে ২৮ বছর পার হওয়ার পর পূর্ব জার্মানির অধিবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। ২৩ আগস্ট, ১৯৮৯ হাঙ্গেরি সরকার অস্ট্রিয়ার সঙ্গে সীমান্তে কড়াকড়ি প্রত্যাহার করে। সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ১৩ হাজার পূর্ব জার্মান পর্যটক পশ্চিম জার্মানি যাওয়ার জন্য হাঙ্গেরি হয়ে অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করে। এদিকে অক্টোবর মাসে পূর্ব জার্মানিতে শুরু হয় সরাসরি বিক্ষোভ। ১৮ অক্টোবর, ১৯৮৯ দীর্ঘ সময়কাল পূর্ব জার্মানির শাসক এরিক হোনেকার পদত্যাগ করেন আর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এগোন ক্রেনজ। প্রথমদিকে বিক্ষোভের স্লোগান ছিল, ‘আমরা বাইরে যেতে চাই’। 
৪ নভেম্বর, ১৯৮৯। পূর্ব বার্লিনের আলেকজান্দারপ্লাতজে ১০ লাখ বিক্ষোভকারী সমবেত হয়। এটির বদলে নতুন স্লোগান শুরু হয়- ‘আমরা এখানেই থাকব’, যেটা জার্মান ঐক্যের পক্ষে আন্দোলনের ইঙ্গিত দেয়। ক্রেনজ সরকারের সহনশীল নীতি এবং কমিউনিস্ট চেকোস্লাভ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী পূর্ব জার্মান শরণার্থীরা চেকোস্লাভাকিয়া হয়ে পশ্চিম জার্মানি যাওয়ার সুযোগ পায়। ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর চাপ ঠেকাতে ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ ক্রেনজের নেতৃত্বে পার্টি পলিটব্যুরো সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানির মধ্যে সীমান্ত চৌকি দিয়ে সরাসরি শরণার্থীদের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।

দুই জার্মানির মানুষ যেন এই ঘোষণারই অপেক্ষায় ছিল। মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার পূর্ব বার্লিনবাসী প্রাচীরের কাছে সমবেত হয়ে পশ্চিম বার্লিনে যেতে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকে। এ অবস্থায় গণদাবির মুখে সীমান্তরক্ষীরা দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। অপর পাশে হাজার হাজার পশ্চিম বার্লিনবাসী উৎসবমুখর পরিবেশে তাদের স্বাগত জানায়।

এভাবেই ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ অনানুষ্ঠানিকভাবে বার্লিন প্রাচীরের পতন হয়। পূর্ব জার্মান সরকার ঘোষণা করে প্রাচীরে আরো নতুন ১০টি চলাচলের পথ খুলে দেওয়া হবে। ১৯৯০ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত পুরোনো বার্লিনের এসব পথ খুলে দেওয়া হতে থাকে। সে বছর ২৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় দুই বার্লিনের মধ্যে ভিসামুক্ত চলাচল। ভেঙে ফেলা হয় বার্লিন প্রাচীর। আবার এক হয়ে যায় দুই জার্মানি। ঐক্যের সৌন্দর্য ও শক্তি দেখতে পায় গোটা বিশ্ব। এখনো এ প্রাচীরের কিছু অংশ অবশিষ্ট রাখা হয়েছে দর্শনার্থী ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিদর্শন হিসেবে। প্রতিদিন বিশ্বের হাজারো মানুষ এ প্রাচীর দেখতে আসে। বার্লিন শহরের মাঝেও প্রাচীরের জায়গাগুলোতে মোটা দাগ দেওয়া আছে। যদিও সেখানে এখন অনেক স্থাপনা হয়ে গেছে।