প্রবাসের ঈদ
কাশ্মীরে ঈদ উদযাপন

কাশ্মীরে দ্বিতীয়বারের মতো কাটালাম ঈদুল ফিতর। ঈদের আনন্দে দেশে প্রিয়জনদের পাশে থাকতে চায় সবাই, কিন্তু জীবন-জীবিকার তাগিদে সবার পক্ষে সেটি সম্ভব হয় না। জ্ঞানান্বেষণে দূর অভিযাত্রাও বহুকালের পুরোনো অভ্যাস মানুষের। ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাংয়েরা পৃথিবীর সব সভ্যতার উম্মোচন করেছে দেশ-বিদেশে ঘুরেই। আদি রূপকথার সিন্দাবাদ সওদা পণ্য নিয়ে ছুটত দেশ হতে দেশান্তরে। এখনো তার ব্যতিক্রম নেই। বরং বিদেশযাত্রার সংখ্যা এখন আরো বেশি। তাই শত টান থাকলেও ঈদের ছুটিতে সবার পক্ষে বাড়ি ফেরার সুযোগ মেলে না। পৃথিবীর বহু দেশে তো ঈদের দিনে ছুটিও মেলে না। কর্মব্যস্ত আর কটা দিনের মতো সেখানে ঈদ কেটে যায়। কারো কাছে প্রবাসের ঈদ যেন ঈদ নয়, কিন্তু ঈদ তো আসে রোজার শেষে। রোজা যদি পালিত হয়, ঈদ কেন নয়? দেশছাড়া বলে উৎসব-আনন্দের কিছুটা কমতি হলেও নতুন অভিজ্ঞতার মূল্য কম কি? তা ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া তো এখন সারা পৃথিবীকেই গ্রাম বানিয়ে দিয়েছে। যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছে গ্রাম থেকে দূর দেশে। মধ্যপ্রাচ্যসহ যেসব জায়গায় অনেক বাঙালির উপস্থিতি, সেখানে ঈদের একটা দেশীয় আমেজ মেলে।
কাশ্মীরে সেই দেশীয় আমেজের ঘাটতি ছিল বটেই। ঈদের নামাজ শেষে দেশের মানুষ একে অপরের সঙ্গে করে কোলাকুলি, কিন্তু বিদেশে অপরিচিতের সঙ্গে কোলাকুলিতে স্বাচ্ছন্দ্য হয় না। সেখানে নিজেকে কেমন যেন এলিয়েন এলিয়েন মনে হয়। অবশ্য ঈদের সকালে ঈদগাহে নামাজ, খুতবাহ (ধর্মীয় বক্তৃতা) ও তাসবিহর দৃশ্য সারা পৃথিবীর ঈদ উৎসবকে দিয়েছে ঐক্যবদ্ধ রূপ। এখানেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ঈদের নামাজের পর খাবারের আয়োজন আর বেড়ানোর তালিকাটা ছোটখাটো এক বহুজাতিক ঈদ আয়োজনের অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে। নামাজের পরপরই, নিজের হাতে রান্না করা দেশীয় ঢংয়ের সেমাই খেয়ে বসেছিলাম। সাজিয়ে রেখেছিলাম বন্ধুদের জন্য। এরই মধ্যে পাশের রুমের নেপালি বন্ধু বিষ্ণু পোখরেল ঘুম থেকে উঠে সহাস্য বদনে আমাকে জানাল ‘ঈদ মুবারক’। আমাদের শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। কাশ্মীরি এক বন্ধু এলো গাড়ি নিয়ে। আমি ও বিষ্ণু চলে গেলাম তাদের বাড়ি। কাশ্মীরের মানুষের মূল খাবার ভাত।
সঙ্গে গোসতের নানা পদ। গরুর মাংস পাথরে পিষে মাখন মিশিয়ে গোল্লা বানিয়ে ঝাল-টমেটোর মসলা দিয়ে রান্না করা এক কাবাবের নাম রিস্তা। এ ছাড়া ছিল ঝাল-পনিরের ঝোল, মুরগি, খাসি ও ভেড়ার মাংস। শেষে ছিল আইসক্রিম ও দই। নানা পদের এই খাবারকে এক সঙ্গেবলে ‘বাজওয়ান’। বিয়ের অনুষ্ঠানে এই বাজওয়ানের আইটেম হয় ১৫ থেকে ২০টি। ভরপেট খাওয়ার পর চলল নানা আলাপ।
কাশ্মীরি ভাষায় বয়োবৃদ্ধা দাদি দোয়া করলেন আমাদের জন্য। জানতে চাইলেন অনেক কিছু। ওই সব প্রশ্নের ইংরেজি তরজমা করে আমাদের বুঝিয়ে দিল বন্ধু। আমরা জবাব দিলাম। জানালাম, কেমন হয় বাংলাদেশের ঈদ, কেমন হয় রোজা-ইফতার, কেমন আমাদের খাবার। এরপর এলো কয়েক রকমের শুকনো বেকারি খাবার (কুলচা ও বিস্কুট)। সঙ্গে লবণাক্ত চা (নুন চায়)। বিকেল বেলায় কাশ্মীরিদের খাদ্যতালিকায় নুন চায় এক আবশ্যকীয় আইটেম। সেখান থেকে ফিরলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এরই মধ্যে ছাত্রী হোস্টেলের বিদেশি শিক্ষার্থীরা রান্না করে এনেছে নানা দেশের নানা খাবার। বাঙালি মেয়েদের রান্না করা খিচুড়ি, সেমাই আর লুচি; আফগানি কাবাব (কুকু); নেপালি আচার নিয়ে আমরা বসে গেলাম ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসের ওপর। চারদিনের ঈদের ছুটিতে সবাই গেছে নিজ নিজ বাড়িতে। নির্জীব ক্যাম্পাসের সবুজের বাঁকে আমরা নয়জনই যেন ছিলাম একমাত্র প্রাণসঞ্চারি। ঈদের দ্বিতীয় দিন আমরা গেলাম বাডগাম জেলার চডোরায়। আরেক কাশ্মীরি বন্ধুর বাড়িতে ছিল দাওয়াত। আবারও খেলাম রিস্তা, কাবাব, গুসতবা। ঘুরে এলাম, সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে সাজানো ধানক্ষেত। টেবিলের মতো উঁচু সমতল পাহাড়ের উর্বর জমিতে (ক্যারেবা) প্রায় পোক্ত হয়ে আসা আপেলের ভারে ঝুলে থাকা সবুজ গাছের বাগান। ওয়ালনাট, আলমন্ড, এপ্রিকট, পাম, পিয়ারসহ শীতল আবহওয়ার নানা ফলের গাছ।