হজ-উমরা
হজের দিনগুলোতে কী করবেন

সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ পালন অবশ্যকর্তব্য। আমরা সব সময় চর্চা করি না বলে হজ পালন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা থাকে না। হজের শুদ্ধ পদ্ধতি, হজের প্রস্তুতি এসব বিষয়ে জানা আমাদের কর্তব্য। এ লক্ষ্যেই এনটিভির বিশেষ অনুষ্ঠান ‘হজ ও উমরা’। এ অনুষ্ঠানে হজ ও উমরার প্রস্তুতি নিয়ে তথ্যচিত্রে আলোচনা করেছেন কুরআন শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের হজ প্রশিক্ষক মুহাম্মদ তানভীর হোসেন
‘হজ ও উমরা’র প্রস্তুতি প্রশিক্ষণের তৃতীয় পর্বের অনুলিখনে ছিলেন জহুরা সুলতানা।
গত পর্বে আমরা দেখিয়েছিলাম কীভাবে উমরা পালন করবেন। আজ আমরা হজের দিনগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
হজের ফরজ তিনটি
১. ইহরাম করা।
২. উকুফে আরাফা, ৯ জিলহজ সূর্য হেলে যাওয়া থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। এবং
৩. তাওয়াফে ইফাদা, কাবা তাওয়াফ করা।
হজের ওয়াজিব ছয়টি
এই ছয়টি ওয়াজিব ধারাবাহিকভাবে আসবে। আমরা চেষ্টা করব এই ছয়টি ওয়াজিব ধারাবাহিকভাবে পালন করার জন্য।
১. ৯ জিলহজ দিবাগত রাতে মুজদালিফায় অবস্থান।
২. ১০ জিলহজ রোমি জামারায় আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপ।
৩. ১০ জিলহজ হাদি অর্থাৎ পশু কোরবানি।
৪. হলক অথবা কসর করা : মাথা মুণ্ডন করব বা চুল ছোট করে কাটব।
৫. সাফা মারওয়া সাঈ করব। এবং
৬. মক্কা ত্যাগের পূর্বে সর্বশেষ ওয়াজিব কাজ, বিদায়ী তাওয়াফ করব।
হজের সুন্নত
১. ইহরাম বাধার আগে গোসল করা।
২. সেলাইবিহীন দুটি সাদা ইহরামের কাপড় পরিধান করা।
৩. উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করা (পুরুষের জন্য)।
৪. ৮ জিলহজ জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজর পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করা।
৫. উকুফে আরাফা, ৯ জিলহজ আরাফাতে অবস্থানের জন্য গোসল করা।
৬. সূর্যোদয়ের আগেই মুজদালিফা থেকে মিনার উদ্দেশে রওনা করা, তার পূর্বে দোয়া করা।
৭. জামারা সুগরা (ছোট জামারা) ও জামারা উসতায় (মধ্যম জামারা) কঙ্কর নিক্ষেপের পর দোয়া করা।
এগুলো হজের সুন্নত। আমরা চেষ্টা করব কাজগুলো করার।
হজের ধারাবাহিক কাজ
৮ জিলহজ ইহরাম করবেন। এরপর মিনায় গমন করবেন, মিনায় থকবেন, জোহর, আসর, মাগরিব, এশা এবং পরদিন ৯ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে সকালেই আরাফায় চলে যাবেন। সূর্য হেলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করবেন। সূর্য অস্ত গেলে মুজদালিফায় চলে আসবেন। রাতের বেলায় মুজদালিফায় অবস্থান করবেন। ১০ জিলহজ সকালবেলায় ফজরের নামাজ পড়ে সূর্যোদয়ের আগেই আপনারা মুজদালিফা ত্যাগ করে জামারায়ে আকাবার উদ্দেশে মিনায় রওনা হবেন। ওই দিন জামারায় আকাবায় এসে রোমি করবেন, জামারা আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন, হাদি বা পশু কুরবানি করবেন, হলক অথবা কসর করবেন অর্থাৎ মাথা মুণ্ডন করবেন অথবা চুল ছোট করে কেটে নেবেন, আবার মক্কায় চলে আসবেন, তাওয়াফে ইফাদা, ফরজ তাওয়াফটুকু করবেন, সাফা-মারওয়া সাঈ করবেন এবং আবার মিনাতে ফিরে যাবেন। ১১, ১২, ১৩ অথবা ১১, ১২ মিনায় থেকে জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করে ওইখানে নামাজ আদায় করবেন। শেষদিন যখন মক্কা ত্যাগ করবেন তার আগে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন।
৮ জিলহজ ইহরাম বাধা
এর আগে আপনারা ইহরাম করেছিলেন মিকাতে এসে অথবা মিকাতে পৌঁছার আগে ইহরামটা সম্পন্ন করেছিলেন। আজ আপনি যেখানে যে হোটেলে অবস্থান করছেন বা যে বাসায় অবস্থান করছেন এটাই আপনার মিকাত। এখান থেকেই আপনি ইহরাম করবেন।
ইহরামের প্রস্তুতি
ইহরামের প্রস্তুতিগুলো আমরা গত পর্বে দেখিয়েছিলাম। শারীরিক পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করবেন, ইহরামের আগে গোসল করবেন, গোসলের পরে নিয়ত করবেন এবং তালবিয়ার আগে পুরুষরা সুগন্ধি ব্যবহার করবেন এবং দুটি সাদা কাপড়, একটি নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত, যাতে সতর ঢাকা থাকে আরেকটি কাপড় দিয়ে দুই কাঁধ এবং পিঠ ঢেকে রাখবেন। এরপর দুই রাকাত নামাজ পড়বেন এবং ইহরামের প্রস্তুতি সম্পন্ন করবেন।
একইভাবে মহিলাদের ক্ষেত্রেও শারীরিক প্রস্তুতি অবলম্বন করা। গোসল করা এবং যেকোনো ধরনের পবিত্র যথোপযুক্ত পোশাকে ইহরাম করা। কিন্তু ইহরামকালীন সময়ে অবশ্যই যে সকল মা-বোন পর্দার জন্য হাতমোজা পরেন, তাঁদের হাতের কব্জি থেকে হাতটুকু খালি থাকতে হবে এবং মুখমণ্ডল খালি থাকবে। তারপর দুই রাকাত নামাজ পড়বেন। ইনশাআল্লাহ এভাবে ইহরামের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবেন।
হজের নিয়ত
হজের এই নিয়তটা মুখে বলতে হবে।
‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা হাজ্জান’ (হে আল্লাহ! আমি হাজির, হজ করার জন্য’)।
এভাবেও আপনি বলতে পারেন, ‘হে আল্লাহ ! আমি হজ করার নিয়ত করছি। আমার জন্য তা সহজ করে দিন। আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।’
এটা মুখে উচ্চারণ করে বলবেন। তারপরে আপনাদের একটাই কাজ, সেটি হলো, বেশি বেশি করে তালবিয়া পড়া। এই তালবিয়া পড়ার নির্দিষ্ট সময় আছে। ১০ জিলহজ জামারায় আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপের আগপর্যন্ত এই তালবিয়াটা আপনারা পড়তে থাকবেন। যখনই মনে আসবে তখনই তালবিয়া পড়বেন। প্রথম পর্বেও আমরা বলেছিলাম, যখন আপনি ওপরে উঠছেন তালবিয়া পড়বেন, নিচে নামছেন তালবিয়া পড়বেন, বসে আছেন তালবিয়া পড়বেন, হাঁটছেন তালবিয়া পড়বেন, ঘুমাতে যাচ্ছেন তালবিয়া পড়বেন, ঘুম থেকে উঠে তালবিয়া পড়বেন। অর্থাৎ ইহরামকালীন অবস্থায় আপনার মুখের ভাসা একটাই সেটা হলো, তালবিয়া। এভাবে তালবিয়া পড়তে পড়তে আপনারা মিনায় চলে যাবেন।
ইহরামের নিষিদ্ধ বিষয়
উমরাহ নিয়ে আলোচনার সময় আমরা দেখিয়েছিলাম, যে সকল নিষিদ্ধ বিষয় উমরার জন্য ছিল, প্রত্যেকটি বিষয়ই হজের ক্ষেত্রেও বলবৎ থাকবে, যতদিন পর্যন্ত আপনি ইহরাম থেকে মুক্ত না হবেন।
হজের এলাকা
হজের কার্যক্রম নিম্নোক্ত চিত্রের মতো পর্যায়ক্রমে পালন করতে হবে।
মক্কা থেকে মিনায় গমন
যখন আপনারা মক্কা থেকে আরাফাহ পর্যন্ত যাবেন, যাওয়ার রাস্তাটুকু অবশ্যই আপনার হজ এজেন্সি অথবা গাইডের সঙ্গে যাবেন এবং গাড়ি ব্যবহার করবেন। আপনার সুযোগ সুবিধা হলে আপনি আরাফাহ থেকে যখন ফিরবেন, তখন এককভাবে কিংবা দলগতভাবে হেঁটে হেঁটে চলে আসতে পারেন, যেটা আপনার জন্য সহজ হবে। হেঁটে এলে আপনি টানেলগুলো (সুড়ঙ্গপথ) ব্যবহার করতে পারবেন। এখানে ভয়ের কোনো কিছুই নেই। প্রতিটা টানেলই একমুখী।
মিনায় অবস্থান
ইনশাআল্লাহ ৮ তারিখ সকালে আপনারা তালবিয়া পাঠ করতে করতে মিনায় উপস্থিত হবেন। মিনার তাঁবুগুলো নিয়ে একটু বলে দিই, যাতে মিনাতে গিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা না হয়। দুটি তাঁবুর মাঝে কিছুটা জায়গা রয়েছে। এখানে পানির কনটেইনার আছে, এই কনটেইনার থেকে শুধুমাত্র খাওয়ার জন্য পানি ব্যবহার করবেন। তাঁবুর ভেতরে যখন খাওয়া-দাওয়া করবেন, আপনার খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ অথবা প্লেট ধোয়া পানি রাস্তায় ফেলবেন না। নির্দিষ্ট জায়গাতে ফেলবেন। আরেকটা জিনিস অবশ্যই মনে রাখবেন, আপনারা যাঁরা পুরুষ হাজি, তাঁরা কোনোভাবেই মহিলাদের তাঁবুতে প্রবেশ করবেন না, যদিও সেখানে আপনার মা, স্ত্রী, বোন বা আপনার সঙ্গের অন্য কোনো নারী হাজি অবস্থান করেন। এদিকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।
মিনায় তাঁবুর ভেতরে আপনাকে বালিশ নিয়ে যেতে হবে না। সেখানে প্রতি জনের জন্য একটি বালিশ, একটি কম্বল এবং একটি তোষক অথবা ম্যাট্রেস থাকবে। কোনোভাবেই মিনার তাঁবুতে বড় লাগেজ নিয়ে যাবেন না। তাতে আপনারও অসুবিধা হবে এবং অন্য হাজিদেরও অসুবিধা হবে।
মিনার তাঁবুর ভেতরে পাঁচ হাজার হাজির জায়গা। সেখানে টয়লেট আছে ৪০টা। সুতরাং টয়লেটের ব্যাপারে আপনারা একটু সচেতন থাকবেন। টয়লেট করার ব্যাপারে অবশ্যই আপনাকে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। যদি আপনারা মিনায় থাকাকালীন অবস্থায় টয়লেটের সময়টুকুকে পরিবর্তন করতে পারেন, তাহলে আপনাদের জন্য খুবই সুবিধাজনক হবে। মিনাতে থাকাকালে আপনার সঙ্গে যতগুলো রিস্ট ব্যান্ড এবং পরিচয়পত্র দেওয়া হবে সেগুলো সব সময় আপনার সঙ্গে রাখবেন। মিনার তাঁবুতে রাতের বেলা হেলাফেলায় সময় কাটাবেন না। আপনার সঙ্গে যিনি জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন, তাঁর কাছাকাছি চলে যাবেন, আলেমের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবেন। পরের দিনটি আপনার জন্য সর্বোত্তম দিন, দোয়া কবুলের দিন এবং দোয়া করার দিন। কী দোয়া করবেন, কীভাবে করবেন, কীভাবে ওখানে নামাজ পড়বেন এগুলো আপনার সঙ্গে যে আলেম থাকবেন, ওনার কাছ থেকে শিখে নেবেন।
৯ জিলহজ ইয়াওমাল আরাফা, আপনি আরাফাতে উপস্থিত হবেন। এরপর যখন সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে যাবে তখন হজের জন্য খুতবা হবে, খুতবা শেষ হয়ে গেলে আজান হবে, আজান হওয়ার পরে ইকামত হবে, জোহরের দুই রাকাত কসর নামাজ আদায় হবে, আবার ইকামত হবে, আসরের দুই রাকাত নামাজ আদায় করা হবে। রাসুল (সা.) এভাবেই আরাফাতের মাঠে নামাজ পড়েছিলেন। এই নামাজের আগে এবং পরে আরাফাতে আর কোনো নামাজ নেই। একটাই কাজ, যখন নামাজ শেষ হয়ে যাবে তখন দুই হাত তুলে আল্লাহ সুবানাহু তায়ালার কাছে দোয়া করব। এটি দোয়া কবুলের অন্যতম স্থান এবং দোয়া কবুলের অন্যতম দিন। এই দিনের জন্য রাসুল (সা.) যে দোয়াটি দেখিয়ে দিয়েছেন, সর্বোত্তম দোয়া, অন্যান্য নবী-রাসুলও যে দোয়াটি পড়েছিলেন, সেটি হলো— ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন কাদির’। আরাফার মাঠের জন্য এটিই সর্বোত্তম দোয়া। এই দোয়াটা আপনারা বেশি বেশি পড়বেন। আমাদের পরামর্শ থাকবে আপনি কোনোভাবেই এককভাবে আপনার তাঁবু ছেড়ে দিয়ে আরাফাতের মাঠে চলে আসবেন না, অন্য জায়গায় ঘুরতে যাবেন না, আপনার তাঁবুতে ফিরে যেতে পারবেন না।
আরাফাহর কাজ
আরাফাহর কাজ একটাই, যখন সূর্য হেলে যাবে তখন দুই হাত তুলে দোয়া করবেন। দয়া করে তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে বেশি বেশি করে দোয়া করবেন। বসে থেকে, গল্প-গুজব করে বা ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করবেন না, আপনি দোয়া করবেন। এখানে প্রতিটা সেকেন্ড অমূল্য, এই এক একটি সেকেন্ডের জন্য, এখানে আসার জন্য আপনি আপনার সারা জীবন ব্যয় করেছেন। দয়া করে এই সময়টুকু নষ্ট না করে আপনারা বেশি বেশি দোয়া করবেন।
মিনাতে টয়লেটের লাইনটা আরো বড় হয়ে যাবে। টয়লেটের জন্য অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে। আমাদের পরামর্শ, এখানে আপনারা পরিমিত খাদ্য খাবেন, কমও না বেশিও না। কম খাবেন না, কারণ পরের দিন আপনাকে প্রচুর শারীরিক শ্রম দিতে হবে। সুতরাং পরিমিত খাদ্য খাবেন যাতে আপনার শরীরে শক্তি থাকে এবং টয়লেটের চাপও কম থাকে। আপনি খেজুর খেতে পারেন, এতে আপনার টয়লেট কম হবে, আপনি শক্তিও পাবেন। আপনি যখন আরাফাহ ছেড়ে আসবেন অবশ্যই আপনার টয়লেটের কাজ সেরে আসবেন এবং আপনার সঙ্গে সব সময় ৫০০ মিলিলিটারের দুটি পানির বোতল রাখবেন, যাতে আপনার পানি পানের সুবিধা হয়।
৯ জিলহজ আরাফাহর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬.১৮ মিনিটের আগে আপনি আরাফাহ ত্যাগ করবেন না এবং পরের দিন মুজদালিফায় সূর্যোদয় হবে ৬.১০ মিনিটে। এই ৬.১০-এর পূর্বে আপনি মুজদালিফা ত্যাগ করে জামারায় আকাবার উদ্দেশ্য রওনা হবেন।
আগামী পর্বে আরাফাহ ছেড়ে হীভাবে আপনারা মুজদালিফায় যাবেন, জামারায় যাবেন এবং হজের বাকি কার্যক্রম কীভাবে শেষ করবেন সে বিষয়ে আলোচনা করব।