হজ ও উমরা

হজ শেষে কীভাবে মদিনা জিয়ারত করবেন

Looks like you've blocked notifications!

সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ পালন অবশ্যকর্তব্য। আমরা সব সময় চর্চা করি না বলে হজ পালন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা থাকে না। হজের শুদ্ধ পদ্ধতি, হজের প্রস্তুতি এসব বিষয়ে জানা মুসলিমদের কর্তব্য। এ লক্ষ্যেই এনটিভির বিশেষ অনুষ্ঠান ‘হজ ও উমরা’। এ অনুষ্ঠানে হজ ও উমরার প্রস্তুতি নিয়ে তথ্যচিত্রে আলোচনা করেছেন কুরআন শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের হজ প্রশিক্ষক হোসেন ইমাম। 

‘হজ ও উমরা’র প্রস্তুতি প্রশিক্ষণের পঞ্চম পর্বের অনুলিখনে ছিলেন জহুরা সুলতানা।

আমরা গত কয়েকটি পর্বে দেখিয়েছি কি করে উমরা সম্পাদন করা যাবে এবং এর পরবর্তীতে হজ কী করে সম্পাদন হবে। এখন আমরা দেখাব হজ পরবর্তী সময়ে মদিনা জিয়ারত কি করে আপনারা করবেন।
 আপনারা এখানে যে ছবিটি দেখতে পাচ্ছেন এটি একটি কাল্পনিক ছবি। মদিনার পনের শত বছর আগের ছবি। রাসুল (সা.) যখন সর্বপ্রথম মদিনা গিয়েছিলেন, মদিনার মসজিদে নববীর বর্তমান অবস্থা ছিল এই রকম। এর পরবর্তী পর্যায়ে খেজুরগাছগুলো কেটে ফেলা হয় এবং পরবর্তী সময়ে রাসুল (সা.) এখানে একটি মসজিদ তৈরি করেন। এটিই বর্তমানে মসজিদে নববী। আপনারা এটা মনে রাখবেন মদিনা জিয়ারত করা হজের কোনো অংশ নয়। মসজিদে নববীসহ মদিনা হারাম এলাকা। রাসুল (সা.) এটাকে সম্পূর্ণ হারাম এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে গেছেন এবং আপনারা হারাম এলাকার যেসব নিয়ম-কানুন রয়েছে তা অবশ্যই মেনে চলবেন।

এরিয়াল ভিউতে দেখুন-
মসজিদে নববীর বর্তমান অংশটুকু হচ্ছে এই সবুজ ঘেরা অংশটুকু। তার পাশেই যে জায়গাগুলো দেখছেন এগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণী হচ্ছে, আল-বাকি কবরস্থান, কিং ফাহাদ গেইট বা মূল গেইট। এছাড়া এই সবুজ গম্বুজ, এটি কিবলার দক্ষিণ দিকে। সেই সঙ্গে আপনার যেটা মনে রাখবেন মসজিদে নববীতে মহিলাদের জন্য স্থান সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে যে লাল অংশটুকু দেখা যাচ্ছে, এটি হচ্ছে শুধু মহিলাদের জন্য। 

মসজিদে নববীতে যখন আপনারা প্রবেশ করবেন বা পৃথিবীর যে কোনো মসজিদে প্রবেশ করার সময় আপনারা পবিত্র হয়ে প্রবেশ করবেন, ডান পা দিয়ে প্রবেশ করবেন এবং প্রবেশ করার সময় অবশ্যই দোয়া পড়ে প্রবেশ করবেন। যখনই আপনারা মসজিদে নববীসহ পৃথিবীর যেকোনো মসজিদে প্রবেশ করবেন, প্রথমে দুই রাকাত সালাত আদায় করবেন। 

মসজিদে নববীতে মক্কার মতো প্রচুর জমজমের কন্টেইনার আছে। আপনারা এই কন্টেইনার থেকে জমজমের পানি পান করবেন এবং সাবধান থাকবেন যেন কোল্ড লিখিত কন্টেইনার থেকে পানি পান না করেন, অবশ্যই নট কোল্ড লিখিত কন্টেইনার থেকে পানি পান করবেন। 

আপনারা এই ছবিটি ভালোভাবে খেয়াল করুন, এটি মসজিদে নববীর সর্বপ্রথম অবস্থান। এটি কাল্পনিক চিত্র। কিন্তু এটি দিয়ে আপনারা বর্তমান মসজিদে নববী সম্পর্কে বুঝতে পারবেন। এখানে যে স্থাপনা দেখা যাচ্ছে, এটি হচ্ছে বর্তমান মসজিদে নববীর পুরাতন স্থান এবং তার পাশে যে দুটি ঘর দেখা যাচ্ছে, তার একটি হচ্ছে আয়েশা (রা.) ঘর এবং আরেকটি হাফসা (রা.)-এর ঘর। এর আশপাশে অন্য সাহাবিদের ঘর ছিল। 

যখন প্রথম এই মসজিদে নববী তৈরি করা হয়, তার কিবলা ছিল বর্তমানের উল্টো দিকে, উত্তর দিকে আর বর্তমানের কিবলা হচ্ছে দক্ষিণ দিকে। আপনারা এটি অবশ্যই মনে রাখবেন। আপনারা যারা মসজিদে নববী ভ্রমণ করতে যাবেন, তার আগে আপনারা জেনে থাকবেন রওজা সম্পর্কে এবং এ সম্পর্কে আপনাদের মনে অনেক কৌতূহল নিশ্চয় আছে। রওজা সম্পর্কে আমরা যেটা জানি যে, রাসুল (সা.)-এর কবরটিই রওজা, এটি একটি ভুল ধারণা। রওজা শব্দের অর্থ বাগান। রাসুল (সা.) যেটি বলেছেন, উনার যে ঘর, উনার যে হুজরা, হুজরা থেকে উনার যে মিম্বর, মিম্বরের এই মাঝখানের অংশটুকুই রিয়াদিল জান্নাহ বা রওজা।

মসজিদে নববী থেকে রওজা আলাদা করা আছে কার্পেট দিয়ে। একটি কার্পেট লাল এবং আরেকটি কার্পেট সবুজ রঙের। রওজাতে যখনই আপনারা যাবেন, এখানে অনেকেই দুই রাকাত নামাজ আদায়ের জন্য প্রবেশ করেন, সবসময়ই এই জায়গাটুকু জনাকীর্ণ থাকে, সালাত আদায় করা কঠিন হয়। তাই আপনারা আপনাদেরকে অনুরোধ করব, যখনই এখানে সালাত আদায়ের জন্য যাবেন সাবধানে যাবেন এবং অন্য হাজি ভাইবোনদের যেন কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
এটি হচ্ছে রাসুল (সা.)-এর সালাত আদায়ের জায়গা, যেটি বর্তমানে একটি পিলার দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। এরপর আছাফ ই সুফফা, রাসুল (সা.)-এর সাহাবিরা যাঁরা ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে মসজিদে নববীতে অবস্থান করতেন, তাঁরা এই জায়গাটিতে অবস্থান করতেন।

রিয়াদিল জান্নাত বা রওজা তে যাওয়ার জন্য মহিলাদেরকে একটি বিশেষ সময় দেওয়া হয়। মা-বোনরা যারা যাবেন তাঁরা বর্তমান সুফফার যে অংশটুকু আছে, তার সামনে মহিলাদের অংশ ঘেরাও করে রাখা হয় আর ডান পাশে পুরুষদের জায়গা।
 মসজিদে নববীর এই অংশটুকু খেয়াল করুন, এটির চারটি দরজা। এটা বাব-ই-বাকী বা বাকী গোরস্থানে বের হওয়ার রাস্তা, তার পাশে হচ্ছে বাব-ই-জিব্রাইল দরজা, তার পাশে হচ্ছে বাব-ই-নিসা দরজা। মাঝখানে দ্বিতীয় অংশটুকু এটি আগে জানাজার জন্য লাশ রাখা হতো, বর্তমানে এটি খালি থাকে। 

আবু বকর (রা.)-এর বাসা এবং আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.)-এর বাসা বর্তমানে মসজিদে নববীর অংশ। আর মসজিদে নববীর সামনের অংশটুকু ছিল আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাসা। বর্তমানে এগুলো আপনারা খুঁজে পাবেন না।
এটি বর্তমান কিবলার দিকের দরজা। যদি আপনারা খেয়াল করেন, কিবলা এবং তার হুজরার সামনের অংশটুকু, এটি হচ্ছে সেই কিবলা দিক এবং এই অংশটুকু ছিল আবু তালহা (রা.)-এর বাগান।
 রওজা এবং বাব-ই-জিব্রাইলের বরাবর এই জায়গাটুকুতে রাসুল (সা.) তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন। মসজিদে নববী বর্তমানে অনেক বর্ধিত করা হয়েছে। পূর্ববর্তী যে মসজিদটুকু ছিল রাসুল (সা.)-এর সময়ে, সেই পিলার গুলো যখন আপনারা দেখবেন, পিলারের মধ্যে বিশেষ একটা নকশা খেয়াল করবেন। এই নকশা খেয়াল করলেই আপনারা বুঝতে পারবেন এটি হচ্ছে প্রথম মসজিদে নববীর অংশ।

আসুন আমরা রাসুল (সা.)-এর কবর জিয়ারতের অংশটুকু দেখে নেই এবং বুঝে নেই কীভাবে রাসুল (সা.)-এর কবর জিয়ারত করতে হয়। যেদিন আপনারা রাসুল (সা.)-এর কবর জিয়ারত করতে যাবেন অবশ্যই রাসুল (সা.)-এর মর্যাদা এবং সম্মানের প্রতি খেয়াল রাখবেন। উচ্চস্বরে কোনো কথা বলবেন না। ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করবেন না এবং কবরের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াবেন না।
 এটি হচ্ছে বাব আস সালাম গেইট। বাব আস সালাম গেইট দিয়ে রাসুল (সা.)-এর কবর জিয়ারত করার জন্য আপনারা যাবেন। কিছুদূর সামনে গেলেই দেখবেন জনাকীর্ণ জায়গা, সেই সঙ্গে দেখবেন এইখানে যে পিলারগুলো থাকে সেগুলোর নকশা যখন বদলে যাবে তখন রিয়াদিল জান্নাত শুরু হবে।
 রাসুল (সা.)-এর সমাধি কিংবা কবরের সামনের বর্তমান অংশটুকু এইভাবে পিতল দিয়ে ঘেরাও করে দেওয়া আছে।
আপনারা যখন সামনে যাবেন তখন অবশ্যই এই ছিদ্রগুলো খেয়াল করবেন। প্রথম এইখানে বড় যেই ছিদ্রটি দেখবেন এই ছিদ্রের সামনে রাসুল (সা.)-এর পরবর্তী সময়ে আবু বকর (রা.)এবং এর পরবর্তী সময়ে উমর (রা.)। যখন আপনাদের জিয়ারা শেষ হয়ে যাবে, সালাম দেওয়া শেষ হবে, আপনারা বাকি গেইট দিয়ে বের হয়ে যাবেন। বের হয়ে একটু সামনেই ফাঁকা জায়গায় কিবলামুখী হবেন এবং দোয়া করবেন। কবর জিয়ারা মহিলাদের জন্য নিষেধ। পৃথিবীর যেকোনো কবর জিয়ারত নিষেধাজ্ঞার মতো রাসুল (সা.)-এর কবরও এর অন্তর্ভুক্ত। তাই আমরা অনুরোধ জানাই মহিলাদের রাসুল (সা.)-এর কবর জিয়ারত না করার জন্য। 

আপনারা যাঁরা মদিনাতে যাবেন, তাঁরা অবশ্যই মসজিদে নববী জিয়ারত করার উদ্দেশ্যেই যাবেন। রাসুল (সা.)-এর কবরের জিয়ারার উদ্দেশে নয়। মসজিদে নববীতে যাবেন, সেখানে সালাত আদায় করবেন, পাশে রাসুল (সা.)-এর কবর, আপনারা সেটাও জিয়ারত করে আসবেন। বরকত লাভের আশায় আপনারা কবরের মধ্যে চুম্বন করবেন না এবং কবরের আশপাশে কোনো কিছু আপনারা স্পর্শ করবেন না।
মসজিদে নববীর পাশে আল বাকী কবরস্থান। এখানে প্রায় ১০ হাজার সাহাবির কবর আছে, রাসুল (সা.)-এর সব স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, চাচা, ফুফু, উনার নাতি, হজরত উসমান (রা.)-এর কবর এখানে আছে। তাই আপনারা অবশ্যই বাকি কবর জিয়ারত করবেন।
কবর জিয়ারতের জন্য রাসুল (সা.) আমাদের একটি দোয়া শিখিয়েছেন, ‘হে কবরের অধিবাসী মুসলিম এবং মুমিনগণ! আপনাদের প্রতি শান্তি ও সালাম বর্ষিত হোক। আল্লাহর চাহে তো আমরাও আপনাদের সঙ্গে মিলিত হব। (আমাদের ও আপনাদের মধ্য থেকে যারা পূর্বগামী ও পশ্চাতগামী, মহান আল্লাহ তাঁদের সবার প্রতি রহম করুন) আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য এবং আপনাদের জন্য নিরাপত্তা কামনা করছি।
 মসজিদে নববী থেকে মসজিদে কুবা প্রায় আড়াই মাইল দূরে। আপনারা হেঁটে যেতে পারেন কিংবা কোনো যানবাহন ব্যবহার করতে পারেন। কোরআন মজিদে এই মসজিদ সম্পর্কে বলা হয়েছে তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদ এবং এটিই ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ। রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে আপনারা জানি, পবিত্র অবস্থায় যে এই মসজিদে কুবায় দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে তাঁকে একটি উমরার সমান সওয়াব দেওয়া হবে। আবশ্যই আপনারা মদিনা যখন ভ্রমণে যাবেন, তখন মসজিদ আল কুবাতে দুই রাকাত সালাত আদায় করে নেবেন। মসজিদ আল কুবা এর পাশেই মসজিদ আল জুমার অবস্থান। ঐতিহাসিক কারণে এটি বিখ্যাত। সর্বপ্রথম জুমার সালাত সেখানে আদায় করা হয়। তৎকালীন সময়ে সেখানে কোনো মসজিদ ছিল না। পরবর্তী শাসকরা এখানে মসজিদ তৈরি করেন।
আরেকটি দর্শনীয় স্থান মসজিদ আল কিবলাতাইন। এটি মসজিদে নববী থেকে উত্তরে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানেই সর্বপ্রথম কিবলা পরিবর্তন করা হয়। আপনারা জানেন ইসলামের প্রথম দিকে আমাদের কিবলা ছিল মসজিদ আল আকসা। রাসুল (সা.)-এর আন্তরিক ইচ্ছার ফলে আল্লাহ সুবানাহু তায়ালা পরবর্তীতে আমাদের কিবলা পরিবর্তন করে দেন এবং এই মসজিদ আল কিবলাতাইনের এই জায়গাটিতেই কিবলা পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে দুটি কিবলাই অবস্থিত, শুধু দিক নির্দেশনা দেওয়া আছে, এটি বর্তমান কিবলা, আর এটি পূর্ববর্তি কিবলা।

এ ছাড়া দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আরো যেটি আছে, সেটি হলো, মসজিদ আল ফাতাহ বা বিজয়ের মসজিদ। খন্দকের যুদ্ধে রাসুল (সা.) এই জায়গা থেকে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছে বিজয়ের জন্য দোয়া করেছিলেন এবং এই দোয়া কবুল করা হয়েছিল। এ ছাড়া মসজিদে নববীর পাশে কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থান আছে, যেগুলোতে বর্তমানে কয়েকটি মসজিদ তৈরি করে রাখা হয়েছে।

এটাকে বলা হয় আল মুসালা। মসজিদে নববী থেকে মাত্র ৩০০ মিটার দূরে এটি অবস্থিত। মসজিদ আল মুসালাতে সর্বপ্রথম ঈদের জামাত আদায় করা হয়। এর পাশেই আছে মসজিদ আল আবু বকর, মসজিদ আল আলী, মসজিদ আল ওমর। 
 আপনারা যদি সুযোগ পান অবশ্যই ওহুদ পাহাড় ভ্রমণ করতে যাবেন। ওহুদ পাহাড় হচ্ছে মুসলিমদের সর্বপ্রথম বিজয়ের স্থান। রাসুল (সা.)-এর নির্দেশনা না মানলে মুসলিমরা কী পরিমাণ দুর্ভোগে পড়বে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ছিল এখানে। 
 এটি হচ্ছে হজরত হামজা (রা.)-এর কবর। উনি এই ওহুদের যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন। মদিনার আরেকটি স্থান হচ্ছে মিক্বাত। যেটি মদিনা থেকে যারা মক্কাতে গমণ করেন তাঁরা এই মিক্বাত জুলহুলাইফা, বর্তমান নাম বিড়িআলি এইখান থেকে ইহরাম করেন। 

আলহামদুল্লিল্লাহ এটিই ছিল আমাদের মসজিদে নববী জিয়ারার অংশ। যতটুকু সম্ভব আপনারা এর থেকে ইবাদত করার সুযোগ গ্রহণ করবেন। কারণ এই সময়টি হয়তো আপনারা জীবনে দ্বিতীয়বার নাও পেতে পারেন। 

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।