দীপাবলি

আলোকেরই ঝরনাধারায় অবগাহন!

Looks like you've blocked notifications!

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে গতকাল মহাসমারোহে উদযাপিত হয় আলোক উৎসব ‘দিওয়ালি’ বা দীপাবলি। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাবমতে. অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই তিথি অনুযায়ী ‘দিওয়ালি’ উদযাপিত হয়ে থাকে।

যদিও বলা হয়ে থাকে, দিওয়ালি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব, কিন্তু অন্য সম্প্রদায় যেমন- শিখ, জৈন, আর্য সমাজ, বৌদ্ধরাও ‘দিওয়ালি’ উদযাপন করে। ফলে প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকায় আলোক উৎসব দিওয়ালি উদযাপিত হয়ে থাকে। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, মরিশাস, গায়ানা, ত্রিনিদাদ, সুরিনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ফিজিতে দিওয়ালি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত।

দিওয়ালি মূলত হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব হলেও আলোকের পুণ্যশিখার ব্যাপ্তি শুধুমাত্র হিন্দুদের ঘরে আটকে থাকে না। আলোক উৎসবের আলোকচ্ছটায় প্রতিটি মানুষের জীবন থেকে সব অন্ধকার দূর হয়ে যায়, সব অশুভ পালিয়ে যায়। এই হচ্ছে দিওয়ালি উৎসবের মূল বার্তা।

প্রদীপের মালা অথবা ‘রো অব লাইট’ থেকেই ‘দিওয়ালি’ নামকরণ হয়েছে। দিওয়ালির সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়ির চারদিক ঘিরে সারি সারি মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয়ে থাকে, যা সারা রাত জ্বালিয়ে রাখা হয়। প্রদীপ জ্বালিয়ে সমস্ত অন্ধকার এবং অশুভকে বিদায় করে ধনলক্ষ্মী দেবীকে আবাহন করা হয়। লক্ষ্মী দেবী প্রদীপের আলোতে পথ চিনে গৃহীর ঘরে প্রবেশ করেন এবং সংসারের আসনে অধিষ্ঠিত হন।

সন্ধ্যায় খুব ধুমধাম করে বাজি পোড়ানো হয়। পটাশ পটাশ করে বাজি পোড়ে, বিশ্বাস করা হয়, বাজি ফোটার আওয়াজে ভয় পেয়ে আশপাশে ওঁত পেতে বসে থাকা সব বিপদ-আপদ, অসুর-শয়তানরা দৌড়ে পালায়।

এই উৎসব উপলক্ষে সবাই নতুন জামা-কাপড় পরে প্রদীপ প্রজ্বালন করে, ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে বাজি পোড়ায়, বাজি পোড়ানো শেষে পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে সবাই মিষ্টিমুখ করে।

 

‘দিওয়ালি’র সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিশ্বাস

১. অনেকেই বিশ্বাস করেন, ত্রেতাযুগে ১৪ বছরের বনবাস কাটিয়ে এই দিনে রামচন্দ্র অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। রামচন্দ্রের প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানাতে ২০ সারিতে প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং প্রতিবছর দিবসটি রামচন্দ্রের প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়। আবার অনেকের মতে, মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব ১২ বছরের বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাস শেষে ফিরে এসেছিলেন নিজ গৃহে, এই দিনে। অন্ধকার গৃহ আবার আলোকিত হয়।

২. নরকাসুর বধ : অনেকের বিশ্বাস, দ্বাপর যুগে গ্রামবাসীর সঙ্গে নরকাসুরের যুদ্ধ বাধে, যুদ্ধের একপর্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে তাঁর স্ত্রী সত্যভামা দেবী নরকাসুরকে হত্যা করেন। গ্রামবাসী জয়ী হয়, নরকাসুরের মৃত্যুতে সবার মাঝে শান্তি ফিরে আসে। ঘরে ঘরে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং সেই থেকে দিওয়ালি উদযাপিত হয় নরকা চতুর্দশীতে।

৩. শিখ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ষষ্ঠ গুরু ‘গুরু হরগোবিন্দ সিং’ কারামুক্ত হয়েছিলেন এই দিনে। মহাসমারোহে তারা দিওয়ালি উদযাপন করে। পাঞ্জাবের অধিকাংশ শিখ পরিবারে সারা দিন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘গুরুগ্রন্থসাহিব’ পাঠ করা হয়, এই পবিত্র দিনে সবাই নিরামিষ খায়। সন্ধ্যায় যথারীতি আলোর মালায় সাজায় ঘর-বাড়ি, গুরুদুয়ারা। বাতাসে বাজি ছুড়ে দেয়, যার সরল অর্থ হচ্ছে, ‘ফ্রিডম’।

৪. বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেকেই দিওয়ালি উদযাপন করে। তারা দিনটিকে ‘অশোক বিজয়া দশমী’ হিসেবেও গণ্য করে থাকে। তাদের বিশ্বাস, এই দিনে সম্রাট অশোক সবাইকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

৫) আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ দেহত্যাগ করেন ১৮৮৩ সালের ৩০ অক্টোবর। সেই থেকে আর্য সমাজে দিওয়ালি উদযাপিত হয় ‘স্বামী দয়ানন্দ প্রভুর মৃত্যুবার্ষিকী’ হিসেবে। পুণ্য এই দিনে সবাই প্রার্থনা করে, সন্ধ্যায় মঙ্গলালোক জ্বালায়।

৬. বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মিথিলার হিন্দু সম্প্রদায় দিওয়ালি উদযাপন করে ভিন্ন নামে, ভিন্ন আঙ্গিকে। দুর্গাপূজার ঠিক দুই সপ্তাহ পরেই অনুষ্ঠিত হয় কালীপূজা বা শ্যামাপূজা, যার আরেক নাম ‘দীপাবলি’। কালীপূজা হয় অমাবস্যা তিথিতে এবং মাঝরাতে। পূজার সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়ি সেজে ওঠে সারি সারি মাটির প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোয়। শহরে-নগরে মাটির প্রদীপের পরিবর্তে জ্বালানো হয় রংবেরঙের মোমবাতি। ধর্মীয় বিশ্বাস, দীপাবলির সন্ধ্যায় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে পূর্বপুরুষদের আলো দেখানো হয়। বাঙালি হিন্দুরাও রাতভর বাজি পোড়ায়, একই উদ্দেশ্যে, বাজি পোড়ানোর শব্দে সব অশুভ শক্তি যেন দূরে পালিয়ে যায়।

মূল ভাব

দিওয়ালি বা দীপাবলি উৎসব মূলত ‘ফেস্টিভাল অব লাইট’ নামে পরিচিত হলেও ধর্মীয় দিক বিবেচনায় দিওয়ালির মূল অর্থ হচ্ছে ‘অন্তরের আলো’ বা আত্মার উজ্জ্বলতা। হিন্দু দর্শনের মূল কথাই হচ্ছে, দেহ ও মনের আড়ালে যা থাকে তার নাম অন্তর বা আত্মা, যা অসীম, অবিনশ্বর ও বিশুদ্ধ। সেই অন্তরের আলো জ্বালতে পারলেই শুভবুদ্ধির জয় হয়, অশুভ শক্তি পরাজিত হয়। মূর্খতা, অজ্ঞতা, হিংসা, ঈর্ষা, দ্বেষ, লোভ, অহংকার, চৌর্যবৃত্তির মতো অন্ধকারে যখন ঢাকা থাকে মানুষের অন্তর, তখনই মানুষের নৈতিক স্খলন ঘটে, হানাহানি, মারামারি, যুদ্ধ, ঝগড়া-বিবাদে মানুষ লিপ্ত হয়। এসব অশুভ রিপুর তাড়নায় মানুষের প্রকৃত অন্তর আড়ালে থেকে যায়। এই সমস্ত অশুভ আড়াল কেটে যখন মানুষের বিবেক জাগ্রত হয়, তখনই সত্যের জয় হয়। মানুষ তার নিজের আত্মাকে খুঁজে পায়, অজ্ঞতা কেটে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে, জ্ঞান বিকাশের এই অনুভূতির আরেক নাম আনন্দ বা শান্তি। যদিও গোষ্ঠী, জাতি, বর্ণ, স্থান বিশেষে ‘দিওয়ালি’ বিভিন্ন আঙ্গিকে উদযাপিত হয়, উৎসবের মূল বাণী এক—অন্তরের আলোয় দেখা, অন্তরের আলোকে দেখা।