রমজানে সর্বদিকেই সংযমী হওয়া প্রয়োজন

আরবি হিজরি সনের নবম মাস হলো রমজান। রমজানের আগের অষ্টম মাস শাবান এবং রমজানের পরের দশম মাস হলো শাওয়াল, যা ঈদুল ফিতরের মাস হিসেবেও পরিচিত। আমরা অনেকেই হয়তো হিজরি বারো মাসের নামগুলোই বলতে পারব না। কারণ তার অভ্যাসে নেই বলে। সে জন্য রমজান মাস মানেই রোজা হিসেবে বুঝে থাকি।
এটা আরবি ১৪৩৭ হিজরি সন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় থেকে ইংরেজির পাশাপাশি এ সন আরবি সন হিসেবে গণনা করা হয়ে আসছে। চান্দ্র মাসিক হিসেবে হিজরি সন গণনা করা হয় বিধায় ইংরেজি খ্রিস্টাব্দের প্রতিবছরে ১১ দিন এবং প্রতি ৩৩ বছরে এক বছর সময় পিছিয়ে যায়। সে হিসাবে দেখা গেছে, ১৪৩৭ বছরে ইংরেজি সন প্রায় ৪৩ বছর পিছিয়ে গেছে। রমজান মাসকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ধর্মীয়ভাবে মাহে রমজান, রজানুল মোবারক, পবিত্র রমজান ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে, সেগুলো মুসলমানদের জন্য ফরজ ইবাদত হিসেবে নাজিল হয়েছে, আর তা হলো- কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত। তার মধ্যে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফরজ হলো রোজা। রোজা একটি ফার্সি প্রতিশব্দ। এর মূল আরবি শব্দ হলো সাওম। আর সাওমের বহুবচন হলো সিয়াম। রমজানে ৩০টি রোজা করতে হয় বিধায় একে সিয়াম নামে বহুবচনেই প্রকাশ করা হয়। সিয়াম মানে হলো সংযম। আর সংযম মানে হলো ধৈর্য বা কোনো কিছু থেকে বিরত থাকা। অর্থাৎ একটা কিছু করতে কারো ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু বিশেষ অনুশাসন কিংবা বিধিনিষেধ থাকার কারণে তা না করতে পারাই হলো সংযম।
আমরা সাধারণত রোজার মানে যে সংযম সেটা অনেকেই জানি, কিন্তু সেটার মানে শুধু খাবার-দাবারে নয়। সবকিছুতেই সংযম প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। এখন আমি এখানে আরো কিসে কিসে সংযমী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করব। খাওয়া-খাদ্যে সংযম দেখাতে হবে। রমজানের মূল শিক্ষা হলো সেটা অনুধাবন করা যে, একজন অভাবী মানুষ যারা দিনে দুবেলা ঠিকমতো খাবার পায় না, ধনী-গরিব সবাই সমানভাবে রোজা রেখে সেই সব অভুক্ত গরিব-দুঃখী মানুষের কষ্ট কিছুটা হলেও অনুভব করা। অথচ আমরা রমজান মাস এলে এর পুরো বিপরীত চিত্র ফুটে উঠতে দেখি।
যেদিকেই তাকানো যায়, চারিদিকে শুধু খাওয়ার প্রস্তুতি। মানুষ খেতে খেতে রমজান মাসে নিত্যভোগ্য পণ্যের দাম আকাশচুম্বী করে দেয়। বাজারে জিনিসের টান পড়ে যায়। ইফতার, রাতের খাবার, সেহরি ইত্যাদিকে কে কত ভালো খেতে পারে, সেই নিয়ে বাসায় বাসায় শুরু হয়ে যায় প্রতিযোগিতা। একে অপরের বাসায় দাওয়াত দেওয়া-নেওয়া শুরু হয়ে যায়। ইফতার নিয়ে একপ্রকার রাজনীতি চলে এখন হরহামেশাই পুরো রমজান মাসজুড়ে। অথচ দেখা গেছে, কোনো সচ্ছল ও ধনাঢ্য ব্যক্তির বর্ণিল ইফতার পার্টির পাশেই হয়তো একটি পরিবার, একজন অনাথ, একজন ছিন্নমূল, দরিদ্র, বঞ্চিত মানুষ অভুক্ত আছে, তার খোঁজখবর কেউ-ই রাখছে না।
রমজানে কথাবার্তায় সংযমী হতে হবে। সেটা কী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে, কী অফিস স্টাফদের সঙ্গে, কী সহকর্মীদের সঙ্গে, কী দোকানির খদ্দেরদের সঙ্গে। প্রায়ই দেখা যায়, রোজা রেখে অনেকের মেজাজ খিটখিটে করে ফেলে। সেটা ঠিক নয়। দেখা যায় বাসে, গাড়িতে, ভ্রমণে, হাটে, বাজারে, ঘাটে সর্বত্র মানুষ একজনের সঙ্গে অপরজন খারাপ ব্যবহার করছেন। কিন্তু সেখানে সতর্কভাবে বুঝতে হবে যে, আমি যে লোকটির সঙ্গে খারাপ আচরণ করছি তিনিও রোজা রেখেছেন। সারা বছরের মতো রমজানেও নিত্যভোগ্য পণ্যের সঙ্গে ভেজাল মিশ্রিতকরণ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেখানে রোজার মাস বলে কিন্তু সংযম প্রদর্শিত হচ্ছে না।
এমনিতেই রমজানে সারা দিন রোজা রাখার সময় পাকস্থলী একেবারে খালি থাকছে। সেই খালি পাকস্থলীতে যখন ইফতার ও সেহরির সময় কোনো ভেজাল খাবার খাওয়া হয় তখন সেটা শরীরের ওপর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কাজেই সেখানে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে সারা বছরই ভেজালমুক্ত পণ্যের ব্যবসা করা উচিত, আর রমজানে তো আর কোনো কথাই নেই। আগেই বলেছি, একদিকে রমজান এলে যেমন বাঙালির রসনাবিলাস বেড়ে যায়, সে জন্য নিত্যপণ্যের মূল্যও বাড়িয়ে দেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা।
অপরদিকে কম সময়ে অধিক মুনাফা লুটে নেওয়ার জন্য পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অনৈতিকভাবে বেশি বেশি মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ফলে বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের নাভিশ্বাস উঠে যায়। এখানে মানবকল্যাণে খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে ভেজাল না মিশিয়ে এবং জিনিসপত্রের দাম না বাড়িয়ে সংযম প্রদর্শনের সুযোগ রয়েছে, যা স্বাভাবিকভাবে না দেখালে সরকারি মেশিনারি ও মেকানিজম ব্যবহারে তা করতে বাধ্য করতে হবে। তবে আশার কথা, চিনি, রসুন ইত্যাদি দু-একটি নিত্যপণ্য ছাড়া বেশির ভাগ পণ্যের দামই এবারে অনেকাংশই কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। অল্পবিস্তর বাড়লেও তা ক্রেতার নাগালের বাইরে যায়নি।
অপরদিকে রমজানের একেবারে নিত্য অনুষঙ্গ হিসেবে আম, লিচু, খেজুর, মাল্টা, আপেল ও আঙ্গুর ইত্যাদি ছয়টি ফলে কোনো ফরমালিন এবং মুড়িতে কোনো ইউরিয়া কিংবা হাইড্রোজ মেশানো হয়নি বলে এবার বিএসটিআই কর্তৃক তাদের ল্যাবে পরীক্ষার মাধমে প্রমাণ পেয়েছে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা থেকে সংশ্লিষ্টদের ভেতর বিবেকবোধ জাগ্রত হওয়ার কারণেই এমন সংযম সাধন করা সম্ভব হয়েছে এবার। সবাইকে মিথ্যা কথা বলা থেকে সংযম প্রদর্শন করতে হবে। ঘুষ-দুর্নীতি থেকে সংযমী হতে হবে। মানুষের একটি স্বভাবজাত ধর্ম হলো তাদের সব কিছুতেই ধৈর্য খুব কম থাকা এবং অপেক্ষার প্রহর গুনতে অভ্যস্ত না হওয়া।
তা ছাড়া ডিসিপ্লিন না মানাটা তাদের ক্রেডিট মনে করেন অনেকে। রমজানের গুরুত্ব অনুসরণ করেই প্রতিবছর সে মাসে অফিস সময়সূচি স্বাভাবিকের চেয়ে একটু কমিয়ে দেওয়া হয়। কারণ সবাই যেন তাদের নিজের বাসা-বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সবার সঙ্গে শান্তিমতো ইফতার করতে পারে। কিন্তু সেখানেও দেখা যায় এক বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা, সর্বোপরি অসংযম ও অসৌজন্যবোধ। সরকারি অফিস-আদালত সাড়ে ৩টায় ছুটি হওয়ার পর দেখা যায় হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। কে কার আগে যাবে! সব মানুষ একসঙ্গে গিয়ে গাড়িতে ওঠার জন্য ভিড় করছে। এতে দেখা যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে বরং আমরা দেরি করে ফেলছি।
এটি যে এখন শুধু রাজধানী ঢাকা শহরের অবস্থা তা নয়, বাংলাদেশের সব ছোট-বড় শহর, রাস্তাঘাট সবখানেই একই অবস্থা। আমি যে ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহরে থাকি, সেখানকার অবস্থা আরো খারাপ। আর তার ওপর ব্যাটারিচালিত অটোবাইক তো রয়েছেই। লম্বা হচ্ছে মানুষ ও গাড়ির লাইন, সৃষ্টি হচ্ছে কৃত্রিম যানজট ও ভিড়ে পড়ে এগুতে পারছে না কেউ-ই। অথচ সবাই যার যার জায়গায় একটু ছাড় দিলেই কিংবা একটু সিস্টেমেটিক্যালি ধৈর্য ধরলেই এ সমস্যা সহজেই সমাধান করা সম্ভব। কারণ দেখুন না, রমজানের আগে-পরে তো এই মানুষগুলোই, এ গাড়িগুলো দিয়েই চলাফেরা করে, কই তখন তো এ ধরনের তেমন কোনো অসুবিধা হতে শোনা যায়নি? তাহলে আমরা যথাযথ সংযম দেখাতে পারছি না।
রমজানের শিক্ষা হিসেবে সব স্থানে কার্যকরী সংযম দেখাতে না পারলে এর প্রকৃত শিক্ষা আমাদের শাণিত করবে না। তাহলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা রোজা রেখে কষ্ট করছি তা যেন শুধু উপবাসে পরিণত না হয়, সেদিকে নজর দেওয়ার জন্যই মহান আল্লাহ্ নির্দেশিত পথেই সংযমের আওতা সম্প্রসারিত করে তা যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। ধনী-গরিব সবাই একাকার হয়ে রমজানের প্রকৃত সওয়াব কামিয়াব করার জন্য সব ক্ষেত্রে সংযম প্রদর্শনের কোনো বিকল্প নেই। এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ সহজ ও সাবলীল ধর্ম হিসেবে ইসলামের শিক্ষা।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।