রম্য

১০০ পাবলিক টয়লেট, মেয়রকে ধন্যবাদ পত্র

Looks like you've blocked notifications!

শ্রদ্ধেয় মেয়র, 

শ্রদ্ধা নেবেন। আশা করি, ভালো আছেন। সম্প্রতি ঢাকার রাস্তাঘাটে একশ পাবলিক টয়লেট স্থাপন করেছেন জেনে আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। তাই আপনাকে ধন্যবাদ জানাতেই এই পত্র। ধন্যবাদ জানানোর আগে কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার না করে পারছি না। 

আমার নাম মোজাম্মেল। পড়াশোনার খাতিরে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বাসিন্দা। ঢাকায় আসার পর আমার মধ্যে নতুন একটা সমস্যা দেখা দিল। ঘন ঘন বাথরুম পেত। ছোটটা। বুড়িগঙ্গা আর ওয়াসার পানি খাওয়ার পর থেকেই এ সমস্যা। লজ্জায় ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি। প্রতিদিন ভার্সিটি যেতে নানামুখী সমস্যায় পড়তে হতো। বনানী থেকে শাহবাগ। বোঝেনই তো। রাস্তার যে জ্যাম। এক ঘণ্টার রাস্তা যেতে চার ঘণ্টা লাগে। এমনই একদিনে সকালে বাসা থেকে বাথরুম করেই বাসে উঠেছিলাম। দুই ঘণ্টা পরও যখন মহাখালী পার হতে পারলাম না, তখন ক্লাস মিসের টেনশনেই ছোট বাথরুম পেয়ে গেল। কিন্তু উপায় কী? 

বাস থেকে নামলেই জ্যাম ছেড়ে দেবে, এই ভয়ে নামতেও পারলাম না। এদিকে চাপ ক্রমে বাড়ছে। মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর বাস যখন দ্বিতীয় দফায় জ্যামে পড়ল, তখন আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। বাসের আশা বাদ দিয়েই নেমে পড়লাম। কিন্তু নেমেই পড়লাম বিপদে। চারদিকে ধু-ধু প্রান্তর আর প্রাইভেটকারের মেলা। এদিক-ওদিক খুঁজেও কোনো ঝোপঝাড়ের দেখা মিলল না।

ফ্লাইওভারে ঝোপঝাড় থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার অবস্থা বর্ণনাতীত। রাস্তার একপাশে যে কর্মসমাধা করব, তারও উপায় ছিল না। যে কয়েকবার চেষ্টা করেছি, সে কয়বারই প্রাইভেটকারের ভেতর থেকে মেকআপ করা সুন্দরী রমণীরা উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেছে। লজ্জায় আমি হাঁটতে লাগলাম। 

কে যেন বলেছিল, প্রস্রাব চেপে রাখলে কিডনির ক্ষতি হয়। কিডনির ক্ষতি করে মাথার ওপর মার্চ মাসের সূর্য সহ্য করে একটু একটু করে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটার জন্য যতবারই পা ফেলেছি, ততবারই একটা তীব্র ব্যথা কোমর থেকে শুরু করে বিজলির মতো শরীর বেয়ে বেয়ে মাথায় গিয়ে ঝাঁকুনি দিচ্ছিল। এমতাবস্থায় ফ্লাইওভারটাকে আমার সাহারা মরুভূমি মনে হচ্ছিল। অবশেষে একসময় সাহারা মরুভূমি শেষ হলো। ফ্লাইওভারের নিচে গিয়ে দেখা মিলল মরুভূমির শীতলতা। ফুটপাতের এক কোনায় লাল কালি দিয়ে ভুল বানানে কে যেন লিখে রেখেছে, ‘এখানে পেচ্ছাপ করিবেন না। করিলে ১০০ টাকা জরিমাণা’। লেখা দেখে নিশ্চিত হলাম, এতক্ষণ যা খুঁজছি এটাই সেই স্থান। আরেকটু এগিয়ে দেখলাম রিকশাওয়ালারা রিকশা পার্ক করে দেয়ালে কর্ম সারছে। পাশে নেড়ি কুকুরও একই কাজ করছে। নিরুপায় আমি কিডনি বাঁচাতে কুকুরের পাশে বসে পড়লাম। 

মেয়র সাহেব, এ ধরনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য ক্ষমা চাইছি। আপনি যে কতটা ভালো কাজ করেছেন, সেটা উপলব্ধি করতেই এই গল্পের বর্ণনা দেওয়া দরকার ছিল। আরেক দিনের কথা বলি, ভার্সিটির একটা জুনিয়র মেয়ে পাপড়িকে খুব পছন্দ করতাম। পাপড়ির সঙ্গে আবার আমার ক্লাসমেট সাথীর খুব ভাব ছিল। সাথীকে বলেছিলাম, পাপড়ির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলে ওকে খাওয়াব। একদিন ভার্সিটি থেকে বের হয়েছি। আবার সেই একই চাপ। ফুটপাত আর দেয়াল দেখে বসে পড়লাম। আমি যখন কাজ সারছিলাম, ঠিক তখনই মেয়েলি কণ্ঠে ডাক, ‘এই মোজাম্মেল। ওখানে কী করিস? এদিকে আয়, পাপড়ির সঙ্গে নাকি পরিচিত হইবি? পাপড়িকে নিয়ে এসেছি দ্যাখ...।’

পেছনে তাকিয়ে দেখি, সাথী আর পাপড়ি দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় আমার মাথা কেটে গেল। যে মেয়েকে ভালোবাসি, তার সঙ্গে প্রথম দেখা হবে এমন অবস্থায়! সাথীর ওপর মেজাজ গরম করে প্যান্টের জিপার লাগাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম! কাঁদো কাঁদো চোখে যখন ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন আমার অবস্থা দেখে পাপড়ির মনে হয় করুণা হলো। সে বলল, ‘ভাইয়া এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। টয়লেট একটা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক ব্যাপার। একজন নারী হিসেবে আমরা বুঝি, ঢাকার রাস্তায় পাবলিক টয়লেটের কী ভীষণ প্রয়োজন। যেহেতু পাবলিক টয়লেট নেই, তাই আপনি খোলা জায়গায় করতে বাধ্য হয়েছেন। থাকলে নিশ্চয়ই করতেন না...।’  

উত্তরে আমি শুধু মাথা ঝাঁকালাম আর ভেবে দেখলাম, আসলেই তো, একজন পুরুষ হয়ে আমি না হয় ফুটপাত বেছে নিতে পারছি; কিন্তু একজন নারী? তাঁদের প্রয়োজন হলে তাঁরা কী করবেন, এটা কি কখনো ভেবে দেখেছি? তাঁরা অনেক কিছুই মুখ ফুটে বলে না, এ জন্যই আমরা অনেক সমস্যার কথা জানতে পারি না। 

প্রিয় মেয়র সাহেব, ঢাকায় অনেক ডায়াবেটিস (বহুমূত্র) রোগী আছে। আছে আমার মতো যুবক আর আছে হাজার হাজার, লাখ লাখ নারী। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই পাবলিক টয়লেট একটা অত্যন্ত জরুরি চাহিদা ছিল। আপনি সেই চাহিদা পূরণ করে আমাদের বাধিত করেছেন। টয়লেটগুলো নাকি আপনার বাসার টয়লেটের চেয়েও ভালো মানের হয়েছে, এটা জেনে আরো ভালো লাগছে। পাবলিক টয়লেট অনেক মানুষ ব্যবহার করবে, সুতরাং মানের দিক দিয়ে এটা ভালো হলে আমাদেরই লাভ। আপনার মঙ্গল কামনা করে আজ এখানেই শেষ করছি। 

ধন্যবাদান্তে—

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভুক্তভোগী ঢাকাবাসীর পক্ষে

মোজাম্মেল মওলা

বনানী, ঢাকা