রম্য
আবেগ সম্রাট
নামের প্রতি সুবিচার আমরা বেশির ভাগ মানুষই করি না।
সেটা নিজের নামের বেলায় যেমন সত্য, অন্যের বেলায়ও তাই।
কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। সে তো পুরোনো গল্প।
আমাদের এলাকায় একজন আছেন। হাকিম।
হাকিম মানে সবাই জানি। যিনি বিচার করেন।
তো আমাদের এলাকায় যে হাকিম আছে সে বিচার করবে কি। দুদিন পরপর নিজেই বিচারের মুখোমুখি হয়। আজকে চুরির কেস তো কাল ছ্যাঁচড়ামি। জেলখানাকে মোটামুটি বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে।
যিনি নাম রেখেছেন তাঁর মুখে পুরো চুনকালি।
এলাকার মধ্যে আরো পাওয়া যাবে।
আমাদের দৌলত চাচা। খুব শান দেওয়া নাম। দৌলত। শুনলে মনে হবে আশপাশে অর্থের ছড়াছড়ি। কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো। দৌলত চাচার দৌলত বলতে আছে এলাকাভর্তি পাওনাদার। মোড়ের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বাজারের মুদি দোকান-সবাই তাঁর কাছে টাকা পায়। যে ভিটায় থাকেন সেটাও বন্ধক রাখা।
যিনি নাম রেখেছেন তাঁকে গ্রেস দিয়েও পাস করানো যাবে না।
পেয়ার মোহাম্মদ ভাইয়ের কথা না বললেই নয়।
পেয়ার মোহাম্মদ নামটা রেখেছিলেন তাঁর মা।
আরো অনেক নামের প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু পেয়ার মোহাম্মদের মা তাঁর স্বামীকে পেয়ার নামটা শেয়ার করলেন। নামটা তিনি নিয়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় গানের প্রথম শব্দ থেকে। ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া’।
স্বামীও এককথায় রাজি হয়ে যান। কারণ তাঁর নাম মহব্বত। মহব্বত যদি তাঁর ছেলের নাম পেয়ার না রাখেন, তাহলে রাখবেটা কে?
নাম হিসেবেও পেয়ার খারাপ না। অনেকটা ইন্ডিয়ার মতো। ইন্ডিয়ার যেমন দুটো নাম। ইন্ডিয়া আর ভারত। তেমনি পেয়ারের বাংলা নাম ভালোবাসা। ইংরেজিও আছে, লাভ। একনামে তিন নাম।
পেয়ার মোহাম্মদ শুনতে যদিও একটু সেকেলে। তবে অর্থের দিক দিয়ে দুর্দান্ত।
পেয়ার মোহাম্মদের বাবা-মাও নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন বড় হয়ে পেয়ার মোহাম্মদ সেই অর্থকে আরো অর্থবহ করবে। পেয়ারের বুকভরা থাকবে ভালোবাসা।
কিন্তু বাস্তবে হলো কী।
পেয়ার মোহাম্মদের দিলে এতটাই পেয়ার যে, এখন পর্যন্ত বিয়ে করেছে তিনটি। না, সেটা অতি ভালোবাসার কারণে না। প্রথম দুই বউ পেয়ার মোহাম্মদের মাইরের চোটে ভেগেছে।
তৃতীয় অর্থাৎ বর্তমান বউয়ের সহ্যশক্তি মাশা আল্লাহ পর্যায়ের। প্রায় রাতেই ও মাগো. . . ও বাবাগো. . . মরে গেলাম গো শোনা যায়। তবে তিনি এখনো পালিয়ে যাননি।
মানুষ ভাবে এক। ভবে হয় আরেক।
নামের বেলাতেও তাই।
অধিকাংশ নামই নামের মর্যাদা রাখতে পারে না।
তবে কেউ কেউ পারে।
যেমন আমাদের আবেগ ভাই।
আবেগ ভাইয়ের বাবার নাম মির্জা বেগ।
সন্তান হওয়ার পর তার বংশ বড় হলো। বংশ বড় করার মতো ছেলের নামও নিজের সঙ্গে মিলিয়ে বড় করলেন। মির্জা আবেগ।
বেগের ছেলে আবেগ হবে এতে দোষের কিছু নেই।
আর আমাদের আবেগ ভাইও তাঁর নামের প্রতি সুবিচার করেছেন।
তিনি আবেগে পুরো ডুবুডুবু।
ক্লাস নাইনে ওঠার পর যখন সায়েন্স নাকি আর্টস এই প্রশ্ন উঠল, আবেগ ভাই ইমোশনাল হয়ে পড়লেন। ঘোষণা দিলেন, তিনি আর্টসে পড়বেন। কারণ আর্টসে আবেগের পার্টসগুলো আছে।
সবাই যেখানে সায়েন্স নেওয়ার জন্য লবিং করছে, সেখানে তুমি যেচে আর্টস চাচ্ছ কেন?
রসায়নের খোরশেদ স্যার জানতে চান।
স্যার, সায়েন্স হলো আবেগহীন সাবজেক্ট। রস, কষ, শিঙ্গাড়া, বুলবুলি, মস্তান।
মানে!
খোরশেদ স্যার অবাক হন।
কেন স্যার, আপনি-ই তো বলেছেন, ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। আবেগ হয়ে আমার পক্ষে বিজ্ঞান পড়া সম্ভব না স্যার।
আবেগ ধরে রাখতে আমাদের আবেগ ভাই মানবিকেই পড়লেন এবং আবেগে মোটাতাজা হলেন।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আবেগ ভাইয়ের আবেগ দু’ধারি ছুরির মতো। দুদিক দিয়েই কাটে।
যখন কারো ওপর খুশি হন, তিনি হন জগতের সেরা। আবার কারো ওপর ক্ষেপে গেলেন তো তার চেয়ে খারাপ মানুষ আর হয় না। সবই অবশ্য আবেগের ফল।
উদাহরণ দেওয়া যাক।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলা চলছে। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। তামিম ইকবাল ডাউন দ্য উইকেটে এসে একটা ছয় মারলেন।
বল যতটা না ওপরে উঠল, তারচেয়ে বেশি লাফ দিয়ে উঠলেন আবেগ ভাই।
বাঘের বাচ্চা ... বাঘের বাচ্চা একটা...। ছয় না দিয়া বারো দেওয়া উচিত। দেখছস, ফিরিঙ্গিগো চোখে চোখ রাইখা খেলতাছে। এমন চোখ সবার হয় না। চোখ যে মনের কথা বলে ... এই পোলাডা আছে বইলাই ক্রিকেট এত সুন্দর।
আবার কোনো ম্যাচে যদি তামিম ইকবাল অহেতুক রান আউট হয়ে যায়, আবেগ ভাইয়ের মেজাজ হয় দেখার মতো।
ক্রিকেট তো আর চাচা-ভাতিজার খেলা না। চাচার কান্ধে চইড়া খাল পার হওন যায়, ক্রিকেটের বাইশ গজ পার হওন যায় না। ম্যাচ ও মেজাজ দুইটাই নষ্ট কইরা দিল।
আমরা মাঝে মধ্যে বিরক্ত হই।
ভাই, আপনার এত আবেগ ক্যান! কন্ট্রোল, কন্ট্রোল।
আবেগ ভাই হাসেন। শোন, আবেগ আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। ফুল ফোটে। পাখি ডাকে। কুহু ... কুহু ...
ক্যান ভাই আবেগ না থাকলে কি পৃথিবীতে আন্ধার নাইমা আসত!
আঁধার নেমে আসত কিরে পাগল! সূর্য তো উঠতই না। আবেগ দিয়েছে আমার ঠোঁটে হাসি। মায়ের চোখে জল। আবেগ ছিল বলেই হয়েছে তাজমহল। মিথ্যা কি না বল?
বলতে বলতে আবেগ ভাই আবেগাক্রান্ত হয়ে ওঠেন।
তাঁর চোখে জল।
পাশ থেকে বন্ধু রাজু বলল, তাড়াতাড়ি কেটে পড়ি চল।
জল বেশি দূর গড়ানোর আগেই আমরা কেটে পড়ি। তা না হলে আবেগের সেই জল (শুধু চোখের না। নাকেরও) আমাদের জামা-কাপড়ে মুছবেন আবেগ ভাই। তারপর মিষ্টি হেসে বলবেন, সার্ফ এক্সেল আছে না!