রম্য

বাংলা ‘কান উৎসব’, চলছে নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে

Looks like you've blocked notifications!

৬৯তম কান চলচ্চিত্র উৎসব চলছে। ফ্রান্সের ওই উৎসবের দিকেই চলচ্চিত্রমোদি সবার চোখ। অন্যভাবে বলা যায় কানের দিকেই তাকিয়ে আছেন সবাই। পুরো বিশ্বের তাবড় তাবড় পরিচালক সেখানে হাজির হয়েছেন নিজেদের কাজের মুন্সিয়ানা দেখাতে। শুধু দেখানোই নয়, তারা কানও ছিনিয়ে আনতে চান। কান পুরস্কারের কথাই বলছি। আমাদের অতিপ্রিয় অভিনেতা পরিচালক তৌকির আহমেদও সস্ত্রীক সেখানে আছেন। সঙ্গে কেবল স্ত্রী-বিপাশা হায়াৎই নন, নিয়ে গেছেন আননেমড বা অজ্ঞাতনামা নামে তাঁর বানানো সিনেমাটিও। কানে দেখানো ছাড়া কি আর সিনেমার জাত ওঠে? আরেক গুণী পরিচালক অমিতাভ রেজাও কান উৎসবে আয়নাবাজি দিয়ে বাজিমাৎ করতে চান। কান বলে কথা। যেভাবেই দেখুন বিষয়টা কিন্তু কান টেনে মাথা আনার মতোই।

সুদূর ফ্রান্সের উৎসব নিয়ে আরো অনেক কথাই হয়তো বলা যেত কিন্তু কানে যে হাত দিয়ে ফেলেছেন এক মাস্টার মশাই। কানে হাত দিলে কি আর মান থাকে? যাক কানে হাত নিয়ে কথা বলার আগে আরেকটা তথ্য আপনাদের কানে গুজে দেই- প্রয়াত তারেক মাসুদ যে ‘মাটির ময়না’ নিয়ে কানে গিয়েছিলেন সেই কথা আবার ভুলবেন না। কারণ তাঁর আগে আর কেউ ওমুখো হওয়ার সাহস দেখাতে পারেননি কিন্তু। ‘মাটির ময়না’ সেবার কানের উৎসবে অনেকের কানেই পানি ঢেলে দিয়েছিল। পানি শুধু ঢেলেই দেয়নি সেই পানি প্রশংসার বান ডেকেছিল। এবারও অমিতাভ আর তৌকির ভাইয়াও কিছু প্রশংসা যে কুঁড়িয়ে আনবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখছে না। তা তাঁরা প্রশংসাটুকু কুঁড়িয়েই আনুক আর ছিনিয়েই আনুক তাতে আমাদের কান কিছুটা হলেও যে ভারী হবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। যাকগে, এবার কানে হাত দেওয়া যাক।

কানে হাত দিয়ে মাথাটা খানিক নিচু করে চোখ দুটি ভূমির দিকে রাখেননি এমন বাঙালি সন্তান বোধ হয় পাওয়াই যাবে না। যারা শৈশবে বা কৈশোরে অথবা যৌবনে সেই সুযোগটি পাননি তাঁরা যে আর কোনোদিনই তা পাবেন না তা আপনি হলফ করে বলতে পারবেন না। বুড়ো বয়সেও আপনাকে কানে হাত দিতে হতে পারে। নারায়ণগঞ্জের দিকে তাকান। বুঝতে পারবেন আমার কথার মর্মার্থ। বুড়ো মানুষটার চাকরিও শেষের দিকে। তিনি নিজেই সবাইকে কানে হাত দিতে বলেন দিনে কুড়িবার। আর সেই মানুষকেও কানে হাত দিতে হলো শেষমেশ। আহা কাণ্ড। লজ্জায় একেবারে ঘোলাজল হতে ইচ্ছে করছে। শুধু কি কানে হাত? সঙ্গে আবার ওঠবসের ব্যাপারও যে ছিল। বাতের ব্যথায় অমন বয়সে অনেকেই সবশেষ কবে উবু হয়েছেন তা হয়তো মনে করতে পারবেন না, অথচ বাবুকে কি না কড়গুণে ওঠবস করানো হলো? থুঃ বলতেও লজ্জা হচ্ছে যে।

যার হুকুমে তিনি কানে হাত দিলেন সেই মানুষটি কিন্তু আবার আইনের লোক। এই আমরাই তাঁকে ভোট দিয়ে আইনসভায় পাঠিয়েছি আমাদের জন্য ভালো ভালো সব আইন করার জন্য। কিন্তু তিনি যে রাস্তাঘাটে যাকে তাকে আইন শেখাবেন তা তো আর আগে ভাবতে পারিনি। বুড়ো মাস্টার মশাই নাকি ধর্ম নিয়ে কটুবাক্য করেছেন। সাহস বলিহারি। মাইক লাগলে হাজারটা নাও, চুঙা ফুকাও গলায় বজ্র এনে। বিচার করো বিধান মতে। ব্যস হলো হুকুম- ধরো কান, করো ওঠবস। কিন্তু জনাব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে শাস্তিদানের বিধান নাই তা কি ভুলে গেলেন? নাকি এই বিধান শুধু ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে? ছাত্রছাত্রীদের প্রহার করা তো দূরে থাক তারা কষ্ট পায় এমন কোনো আচরণও করা যাবে না। বছর কয়েক আগে এমন হুকুমই তো দিয়েছেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী। ‘মাস্টার সাব, মাংস আপনার হাড্ডি আমার, ছেলেটাকে মানুষ করে দেন’ এমন কথা বলার মতো মানুষ কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় ঠেকায় স্কুলের বেতগুলো যাতে অপমানে আত্মহত্যা না করে সেই চিন্তা করেই শিক্ষামন্ত্রী ওই কথা বলেছিলেন। ফলাফল চমৎকার। জিপিএর বন্যায় সারাদেশ ডুবে গেল। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী যদি একটিবারের জন্যও বলে দিতেন ছাত্র-শিক্ষক কাউকেই শাস্তি দেওয়া যাবে না, তাহলে আজকে কান উৎসবের গল্প নারায়ণগঞ্জে গিয়ে ঠেকত না।

স্কুল-কলেজে কান ধরে ধরে আমাদের অনেকের কানই লম্বা হয়ে গেছে। চিলে কান নেওয়া বিষয়ক কবিতায় শেখানোর চেষ্টা ছিল- কানকথায় কান না দিতে। আর ওই কবিতা মুখস্ত করতে না পারার জন্যই যে কত হাজার শিক্ষার্থীকে কান ধরতে হয়েছে তার হিসাব করা কঠিন। আমরা অনেকেই জজ-ব্যারিস্টার-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-সচিব তো হয়েছিই সেই কান ধরার সুবাদে। কান ধরা নিয়ে হাজারটা গল্পও বলা যাবে আর সেই গল্প শুনে হেসে গড়াগড়ি খাওয়া লোকেরও অভাব হবে না। কিন্তু এইবার নারায়ণগঞ্জের দৃষ্টান্তে হাসি নেই। রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ-ঘৃণা সব বলক দিয়ে উঠছে সবার হৃদয়ে। আর যার আভাস পাওয়া যাচ্ছে ফেইসবুকে। ফেইসবুকে সবার কান ধরা ছবি। কেউ ছবি বানায় ফ্রান্সের কানে তুলে ধরার জন্য আর কেউ ছবি বানায় কান ধরে। আর সেই কান ধরা ছবি ফেইসবুকে প্রকাশ হওয়ার পর লাইক আর কমেন্ট আর শেয়ার। কমেন্টে বলা হয়- দারুণ প্রতিবাদ করেছেন ভাই, আমিও দিচ্ছি দাঁড়ান যুৎ করে কানটা ধরে একটা সেল্ফি মেরে নেই। কেউ কেউ কান ধরে ছবি তুলতে গিয়ে শৈশবের কথা মনে করে হেসেও ফেলেছেন। আর সেই হাস্যসমৃদ্ধ কান ধরা ছবি প্রকাশ করে লিখছেন স্যরি স্যার। প্রতিবাদ হয়ে গেল।

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-পার্ক-অফিস-রাস্তা-টিভির স্টুডিও সর্বত্র কান ধরে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। এ যেন কান উৎসব। বাংলা কান উৎসব। মহাসমারোহে চলিতেছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে। আমার একদুষ্টু বন্ধু ফেইসবুকে লিখেছেন- ফ্রান্সের কান উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দাওয়াত না পেয়ে ওই এমপি মহোদয় নারায়ণগঞ্জে কান উৎসবের শুভ মহরৎ করেছেন। সবার কান ধরা ছবি দেখে মনে হচ্ছে এমপি সাহেবের হুকুম মানতে সবাই বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন- প্রতিবাদের এই ভাষাটা অভিনব, তাই কেউ কেউ মানতে পারছে না। নিজের কান নিজে ধরে আর যাকেই হোক নারায়ণগঞ্জের কাউকে যে লজ্জা দেওয়া যাবে এই কথা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ ওদের খুঁটির জোর কোথায় তা সবাই জানে। ফলে আপনি আমি কান ধরে ছবি তুলতে তুলতে ফেইসবুক তামাতামা করে ফেললেও ওদের কিচ্ছুটি হবে না। তাই বলে প্রতিবাদ করব না? অবশ্যই করব, একশবার করব।

প্রতিবাদ করার জন্যই তো আমাদের জন্ম হয়েছে। আজ একজন বলছিল- আমাদের এই প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও নিউজ হয়েছে। তার গর্বিত হওয়ার ভড়ং দেখে প্রশ্ন করেছিলাম- আমরা আর কত আকাম করে বিশ্বগণমাধ্যমে যাব? উত্তর পাইনি। অনেকেই নিরাশ। প্রতিবাদ করে কিচ্ছু হবে না। অথচ ওই এমপির কান যে ধরা ছোয়ার বাইরে নয় তা কেউ ভাবছে না। আরে ভাই অন্য সবার কান আর ওই মহান মানুষটির কানের অবস্থান একই জায়গায়, চোখের ঠিক ৫-৬ আঙ্গুল পেছনে। আপনার আমার না হয় সাহস নেই তাঁর কান ধরে টান মারার, তাই বলে ভাববেন না তার কান ধরা এখনো বাকি আছে। দুই-চার মাস পরপর যখন তিনি ক্ষৌরকর্ম করাতে সেলুনে যান, তখন? হাহা কান তিনি সারাজীবন ধরতে দিয়েছেন। শুধু সাহস করে এগিয়ে গেলেই হয়। আরেকটা কথা যারা শিক্ষকের সম্মান নিয়ে খুব বেশি ভাবিত তারা নিশ্চয়ই- ডাক্তারের সম্মান, ইঞ্জিনিয়ারের সম্মান, সাংবাদিকের সম্মান, পুলিশের সম্মান ইত্যাদি ভাগে ভাগে সম্মানের ভাগ করেন। মূল গলদটাই তো এখানে, সম্মানকে এতভাবে বিভক্ত না করে শুধু মানুষের সম্মান বলে চিন্তা করুন। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষই মানুষ। সবাইকে মানুষের সম্মানটুকু দিন। মানুষ অসম্মানীত হলেই প্রতিবাদী হন তবেই শিক্ষক আপনাকে যে শিক্ষা দিয়েছেন সেই শিক্ষাকেও সম্মান করা হবে। শিক্ষককে আপনি উপযুক্ত সম্মানী দেবেন না আর মুখ ভরা সম্মান দেবেন এমন অবস্থার মাথা কাটতে কানধরে টান দিতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশন