শখের গাড়ি সাজাতে
শখের গাড়িটিকে সাজাতে কে না পছন্দ করে। সবাই চায় তার গাড়িটি দেখে অন্যরা অন্তত একবারের জন্য হলেও বলুক, ‘বাহ্! দারুণ তো!’ আর এই কথাটি শোনার আশায় গাড়ির মালিকরা কত কী যে করছেন !
তরুণদের মধ্যে যাঁরা মোটরসাইকেল অথবা প্রাইভেট কার ব্যবহার করেন, তাঁরা প্রায়ই নিজের শখের বাহনটিকে সাজানোর চেষ্টায় গাড়িতে আরো কিছু বাড়তি সরঞ্জাম লাগিয়ে নেন। গাড়িতে সব সময় নিত্যনতুন মডেলের সরঞ্জাম ব্যবহারের ফলে ব্যবহৃত গাড়িটা বেশ মানানসই হয়।
আমাদের দেশে নতুন গাড়ির তুলনায় রিকন্ডিশন্ড গাড়িই বেশি কেনাবেচা করা হয়। রিকন্ডিশন্ড গাড়িগুলোই আমাদের দেশে নতুন গাড়ি হিসেবে সমাদর পায়। গাড়ি কেনার পর প্রথমেই এতে লাগানো হয় বাম্পার। এরপর গাড়ি সাজানোর অংশ হিসেবে বিভিন্ন রকম সাউন্ড সিস্টেম, বডিকিট, মিররের পাশাপাশি কার ক্যামেরা, ব্যাক ক্যামেরা, কার অ্যালার্ম, স্টিয়ারিং লক ইত্যাদিও লাগিয়ে নেন অনেকে।
সব মিলিয়ে গাড়ি সাজানো আর গাড়ির জন্য নিত্যনতুন সরঞ্জাম কেনার উদ্দেশ্যই হলো নিজের শখের গাড়িটিকে সুন্দর দেখানো, যাতে তা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
শুরুর কথা
বাংলাদেশে প্রথম গাড়ি সাজানোর চল আসে আশির দশকের শুরুর দিকে। পুরানা পল্টন, কাকরাইল ও ইস্কাটনের গাড়ি ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় জাকির হোসেনের ‘জাকির মোটরস’, সালাম কবীরের ‘এসকে মোটরস’, সিরাজ উদ্দিন আহমদ লালের ‘সরদার মোটরস’ গাড়ি ডেকোরেশনের কাজ শুরু করে। ওই সময় ব্যবসাগুলো ছিল ইস্কাটন রোড কেন্দ্রিক। পরে সময়ের প্রয়োজনেই পল্টন, কাকরাইল, পুরান ঢাকার বংশাল, ধোলাইখাল, ইংলিশ রোড, উত্তরা, কুড়িলসহ ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এই ব্যবসা।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অনেকে এই ব্যবসা শুরু করেন। গাড়ি সাজানোতে অনেকের আগ্রহের ফলে ব্যবসাটা জমজমাট হয়ে ওঠে। ওই সময় বাইরের দেশের সরঞ্জাম ব্যবহার করা হলেও চলতি শতকের শুরুতে আমাদের দেশেও শুরু হয় গাড়ি ডেকোরেশন করার সরঞ্জাম তৈরির কাজ।
গাড়ি সাজাতে কোন কোন সরঞ্জাম
গাড়ি সাজানোর জন্য কত ধরনের সরঞ্জাম আছে। শখের গাড়িটিকে সুন্দর করে তুলতে রয়েছে বিভিন্ন রকমের বাম্পার, শোপিস, সাইলেন্সার, সাউন্ড সিস্টেম, স্টিকার, ফ্লোর ম্যাট, স্টিয়ারিং কভার, ফগলাইট, এয়ার ফ্রেশনার ও হরেক রকমের বাতি।
এ ছাড়া গাড়িকে আরামদায়ক ও সুন্দর দেখানোর জন্য আছে পিলো, হেডপিলো, সিট কভার, কেসিং, ডাস্টার, স্পয়লার লাইট, অ্যান্টেনা, রুফবার, রেইন শেড, বডি স্টিকার, ফ্লাশ লাইট, গ্লাস টয়, অয়েল বক্স কভার ইত্যাদি।
আছে নানা ধরনের হর্ন, নিয়ন লাইট, অ্যাম্বুলেন্স লাইট, ফ্রিভেন্ট ডাস্ট কভার, ডেকোরেটিভ রিফ্লেকটর, টেইল ল্যাম্প কভার, ডোর হ্যান্ড কভার, ডোর হ্যান্ড ডেকোরেশন, টার্ন এসাইড ল্যাম্প, সাইড ল্যাম্প রিম, ডোর মিরর কভার, আউটডোর হ্যান্ডেল কভার, রিয়ার ট্র্যাংক লি কভার ইত্যাদি।
লাইসেন্স প্লেট, ব্যাক অ্যার্ডনমেন্ট, ইনসাইড অ্যার্ডনমেন্ট, ফ্রন্ট মিডল হোল কভার, কোল লাইট ফুট বোর্ড, অটোমোবাইল ফুট বোর্ড, রুফ ক্যারিয়ার, রংবেরঙের বাতিসহ হাজারো রকম পণ্য আছে গাড়ি সাজানোর জন্য। এগুলোর প্রতিটিটি সরঞ্জামই আছে আবার বেশ কয়েক ধরনের। আছে গাড়ি পলিশের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও পণ্য। গাড়ির সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি গাড়ির সুরক্ষায় এই সরঞ্জামগুলোর প্রয়োজনীয়তাও অনেক।
কোথায় পাবেন, কোথায় যাবেন
দেশের নানা জায়গায় গাড়ি সাজানোর দোকান আছে। ঢাকার বাইরে দ্বিতীয় বৃহত্তম মার্কেট চট্টগ্রাম। এ ছাড়া সিলেট, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, কুমিল্লা, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে এসব দোকান।
দেশি-বিদেশি এসব পণ্যের বিশাল বাজার ঢাকার কাকরাইল ও বিজয়নগরে। সেখানে রয়েছে এসব পণ্যের শতাধিক দোকান। তাদের ব্যবসাও বেশ জমজমাট। বিজয়নগর ছাড়া আপনি যেতে পারেন বাংলামোটর ও ইস্কাটন, বংশাল, ধোলাইখাল, বারিধারাসহ বিভিন্ন এলাকায় গাড়ি সাজানোর দোকানে।
গাড়ি সাজানোর অনেক পণ্যই এখন তৈরি হচ্ছে দেশে। তবে এখনো কিছু পণ্য আমদানি করতে হয়। সাধারণত চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, জার্মানিসহ অন্যান্য দেশ থেকে এসব পণ্য আসে। কিছু প্রতিষ্ঠান গাড়ি সাজানোর বিভিন্ন সরঞ্জাম আমদানির পাশাপাশি উৎপাদনও করে।
আন্তর্জাতিক বাজারে গাড়ি সাজানোর কোনো নতুন পণ্য এলে সেটি উৎপাদনের এক মাসের মধ্যেই চলে আসে ঢাকার বিজয়নগরের দোকানগুলোতে। ব্যবসায়ীরাও আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব পণ্য নিয়ে আসেন বাংলাদেশে।
জেনে রাখা ভালো, গাড়ি ডেকোরেশনের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে দেশ কার ফ্যাশন, আন্নি অটো এক্সেসরিজ, জিতু এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক মোটরস, নিউ বাবুল মোটরস, ঐশী মোটরস, ফেমাস মোটরস, অয়েন মোটরস ও লাক্সারি মোটরস।
দরদাম
গাড়ি সাজানোর সরঞ্জামের বিভিন্ন ধরনের দাম। তবে দামাদামি ও যাচাই বাছাই করে কেনাই ভালো। বাইক সাজানোর সরঞ্জামের ক্ষেত্রে একদাম, আবার প্রাইভেট কার বা মাইক্রো সাজানোর সরঞ্জামের পণ্যের আরেক দাম। তা ছাড়া আপনি যদি দামাদামি করে কিনতে পারেন তবে আপনাকে ঠকানোর সাধ্য কারো নেই! দোকানগুলোতে ৫০ টাকা থেকে লক্ষাধিক টাকার সরঞ্জামও পেয়ে যাবেন অনায়াসে।
কয়েকজন গাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানালেন, নতুন গাড়ি কেনার পর প্রথমই বাম্পার লাগাতে হয়। আমাদের দেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশে গাড়িতে বাম্পার লাগাতে দেখা যায় না। যানজট বা সরু রাস্তায় গাড়িটি অন্য গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগা থেকে রক্ষার জন্য প্রথমেই বাম্পার লাগানো হয়। এর দাম মোটামুটি পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এখন দেশে তৈরি বাম্পারও চলছে বেশ। তবে তরুণ প্রজন্ম ব্যতিক্রমী গাড়ি সাজাতে গাড়িতে বিভিন্ন রকম সাউন্ড সিস্টেমের পাশাপাশি কার ক্যামেরা, ব্যাক ক্যামেরা, কার অ্যালার্ম, স্টিয়ারিং লক ইত্যাদি লাগিয়ে নিচ্ছেন।
গাড়ি সাজাচ্ছে ১০ লাখের বেশি মানুষ
গত কয়েক বছরে দেশের রাস্তায় গাড়ি বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে এই ব্যবসায় ঘটে গেছে চোখ ধাঁধানো সব বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কাকরাইলের দেশ কার ফ্যাশনের পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানালেন, বর্তমানে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন দেশের প্রায় ১০ লাখের বেশি মানুষ। কেউ পণ্য উৎপাদন করেন, কেউ বাজারজাত করেন, কেউ আমদানি করেন, কেউ কেউ আবার পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করেন।
নতুন কেনা অথবা পুরোনো গাড়িটিকে আরো আকর্ষণীয়, রুচিশীল ও মার্জিত করে তুলতে সবাই গাড়ি সাজানোর দোকানগুলোতে প্রায়ই ঢুঁ মারেন। দেশে এ ধরনের দোকানের সংখ্যা এখন প্রায় দুই হাজার। শৈল্পিকরূপে গাড়ি সাজিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলাই তাদের পেশা।
বাংলাদেশে তৈরি সরঞ্জাম
বাম্পার, সিট কভার, স্টিয়ারিং কভার, বিভিন্ন ধরনের পিলো, এয়ার ফ্রেশনার, গাড়ি ধোয়ার শ্যাম্পু, ডাস্টার এগুলো এখন বাংলাদেশেই তৈরি হচ্ছে। বিদেশি পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এসব পণ্য ক্রেতাদের মন জয় করেছে। কোনো ধরনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই কুটির শিল্পের মতো এসব পণ্য তৈরি ও বাজারজাত হচ্ছে বাংলাদেশে।
গাড়ি সাজানোয় বিধিনিষেধ
গাড়ি সাজানোয় আছে কিছু বিধিনিষেধও। বহুল প্রচলিত কিন্তু না মানা একটি আইনের কথা জানলে হয়তো অবাক হবেন আপনিও। গাড়িতে কালো গ্লাস ব্যবহারে আছে কড়া নিষেধাজ্ঞা। রাজধানীর যানবাহন চলাচলে কালো গ্লাসে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটি সম্পর্কিত একটি আইন ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে কার্যকর আছে। এ আইনে কালো গ্লাস ব্যবহারে মামলা দায়েরসহ সর্বোচ্চ দুই হাজার ও সর্বনিম্ন ১০০ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সর্বোচ্চ চার মাস থেকে এক মাসের কারাদণ্ডের বিধান।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ও ট্রাফিক বিভাগ কার্যালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, গাড়ির ওয়াইপার, লুকিং গ্লাস, হেডলাইটে কালো রং থাকলে এবং পূর্বে শাস্তি হওয়ার পরেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গাড়ি চালালে দুই হাজার টাকা জরিমানা অথবা তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হবে।
এ ছাড়া নগরবাসী নিরাপদে সড়ক ব্যবহারে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আইন মেনে গাড়ি চালাবেন বলে আশা করেছে ট্রাফিক বিভাগ।