শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাস পূরণে দীর্ঘসূত্রতা হতাশ করেছে, স্প্লিন্টারবিদ্ধ ছাত্রের বিবৃতি
শরীরে ৭৫টির বেশি স্প্লিন্টার নিয়েই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সিলেটে ফিরেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী সজল কুণ্ডু। গত ১৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশের ছোড়া শটগানের গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও লাঠিপেটায় আহত হয়েছিলেন তিনি। সে সময় তাঁর শরীরে বিদ্ধ হয়েছিল ৮৩টি স্প্লিন্টার। সম্প্রতি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সজল বলেছেন, ‘চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী আমাকে এসব স্প্লিন্টার শরীরে নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে, যা থেকে ভবিষ্যতে নতুন নতুন শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কাও অমূলক নয়।’
সজল কুণ্ডু গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে এসব জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, শিক্ষার্থীদের দাবি এবং শিক্ষামন্ত্রীর দেওয়া আশ্বাস পূরণে দীর্ঘসূত্রতা তাঁকে হতাশ করেছে। এ ছাড়া গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অনুষ্ঠানে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদের বক্তব্য অন্যান্য শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাঁকেও ক্ষুব্ধ করেছে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।
বিবৃতিতে সজল কুণ্ডু বলেন, ‘গত ১৬ জানুয়ারি নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর যে পুলিশি হামলার ঘটনা ঘটে, তাতে আমার শরীরে শটগান ও সাউন্ড গ্রেনেডের অন্তত ৮৩টি স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। এ ছাড়া পুলিশের লাঠিচার্জে শরীরের বহু স্থানে সাংঘাতিক আঘাত পাই। মারাত্মক আহত অবস্থায় প্রথমে কিছুদিন সিলেটে এবং গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১৫ দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলাম। এর মধ্যেই আমার হাতে একটি অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়, যাতে ডান হাতের গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ুর আশপাশের স্পর্শকাতর অঞ্চল থেকে চারটি স্প্লিন্টার অপসারণ করা হয়।’
সজল আরও বলেন, ‘এখনও আমার মাথা, ঘাড়, বুক, পেট-পিঠ, হাত-পাসহ শরীরের বেশ কিছু স্থানে ৭৫টির বেশি স্প্লিন্টার রয়েছে। প্রাণঘাতী সংক্রমণের আশঙ্কা থাকায় চিকিৎসকেরা আরও অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি আপাতত নিচ্ছেন না। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, আমাকে হয়তো এসব স্প্লিন্টার শরীরে নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে, যা থেকে ভবিষ্যতে নতুন নতুন শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কাও অমূলক নয়। তবে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে সম্মানিত চিকিৎসকেরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এতদিন ধরে আমাকে যে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন, তাতে আমি কৃতজ্ঞ।’
বিবৃতিতে সজল কুণ্ডু বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আমি সিলেটে ফিরেছি। গত কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করে এবং সিলেটে ফেরার পর আমাদের সতীর্থ ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে কিছু ব্যাপারে আমি অবহিত হয়েছি, যা আমাকে অত্যন্ত মর্মাহত করেছে। গত ১২ তারিখ আমাদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার পর সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, আমাদের সব দাবির ব্যাপারে অচিরেই যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি একই সঙ্গে বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা হবে এবং সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের যেসব ব্যাংক ও অনলাইন লেনদেনের অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তা অচিরেই খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু, তাঁর আশ্বাসের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মামলাগুলো তোলার বা অ্যাকাউন্টগুলো খুলে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ আমি দেখতে পাইনি। শিক্ষামন্ত্রীর স্পষ্ট আশ্বাসের পরও এসব বিষয়ে এমন দীর্ঘসূত্রতা আমাকে প্রচণ্ড হতাশ করেছে।’
সজল কুণ্ডু আরও উল্লেখ করে, ‘গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অনুষ্ঠানে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ যে নির্জলা মিথ্যাচার করেছেন, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আমাকেও ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘সত্যের জয় হয়েছে, মিথ্যা পরাভূত হয়েছে!’ ১৬ জানুয়ারি যে নারকীয় হামলা হয়েছে, তার একজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হিসেবে আমি বলতে চাই, আমার কাছে সত্য হচ্ছে আমার শরীরে এখনও বিঁধে থাকা স্প্লিন্টারগুলো, এতদিনের অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা, আমার আহত সতীর্থদের আর্তনাদ। আমি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের মিথ্যাচার ও মনগড়া বক্তব্যের প্রতিবাদ করছি।’
সজল বলেন, ‘আমি জানতে পেরেছি, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় উত্থাপিত শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে আমাকে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি প্রদান, আমার ভবিষ্যতের সব চিকিৎসার খরচ সরকারের পক্ষ থেকে বহন ও আমাকে এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি ছিল। আমাকে চাকরি প্রদানের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী মৌখিক আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত আমার ভবিষ্যতের চিকিৎসা খরচ বহন ও এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট আশ্বাস পাইনি। আমার বাবা মৃত, অসুস্থ মা, অসচ্ছল পরিবার। সম্প্রতি কিছু ঋণ করে আমি সামান্য ব্যবসা শুরু করেছিলাম। পড়াশোনা শেষ করে হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই চাকরির চেষ্টা শুরু করতাম। স্বপ্ন ছিল আমার উপার্জনে পরিবারে সুদিন আসবে। একটি দিনের ব্যবধানে যে আমার স্বপ্নগুলো এলোমেলো হয়ে গেল, সারা শরীরে অসংখ্য আঘাত ও স্প্লিন্টার নিয়ে অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণায় সামনের বিপদসংকুল দিনগুলো কীভাবে কাটবে, তার আশঙ্কায় এখন যে আমাকে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে, তার দায় কে নেবে? আমাদের প্রত্যেকটি দাবি মেনে নিয়ে যে কারণে আমাদের জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে, তা থেকে আমাদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হোক। পরিশেষে আমি আমার সতীর্থ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমস্বরে মহামান্য আচার্য এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ আবেদনই করতে চাই।’
গত ১৩ জানুয়ারি শাবিপ্রবি’র বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েকশ ছাত্রী। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ১৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগ হামলা চালায়। পরদিন ১৬ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ লাঠিপেটা করে এবং শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পরে আন্দোলনটি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়।
কর্মসূচির একপর্যায়ে ১৯ জানুয়ারি থেকে এক দফা দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন ২৪ জন শিক্ষার্থী। অনশনের আট দিন পর ২৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ২০ মিনিটে বরেণ্য কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনুরোধে অনশন ভাঙেন শিক্ষার্থীরা।
এর ১৪ দিন পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে পরপর দুদিন উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনের ছবি, ব্যঙ্গচিত্র সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁরা বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন চলছে ও চলবে।’ এদিন তাঁরা অবিলম্বে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে উপাচার্যের পক্ষ নেওয়াদের হুঁশিয়ারি দেন। এরপর গত ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে শাবিপ্রবি’র আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে ও চলমান সংকট নিরসনে সিলেট পৌঁছান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
পরদিন শনিবার সকালে শাবিপ্রবি’র উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে চলমান ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন। পরে সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা তাঁদের আন্দোলন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তের কথা জানান।