জাবিতে অপূর্ব জ্যোৎস্না-স্নান
‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’
না, ঠিক বনে নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সেন্ট্রাল মাঠে প্রকৃতিপ্রেমী শিক্ষার্থীরা জ্যোৎস্না-স্নানে মগ্ন হয় প্রায়ই। বর্ষার মেঘ ভেঙে পূর্ণিমার অপূর্ব চাঁদের রুপালি জ্যোৎস্না যেকোনো মানুষেরই মন কেড়ে নিতে সক্ষম। এই জ্যোৎস্নার অপূর্বতায় মুগ্ধ জাবির শিক্ষার্থীরাও। আষাঢ়ের একটানা বৃষ্টির পর হঠাৎ আকাশ-ভরানো, ভুবন-মাতানো এমন জ্যোৎস্নায় স্নান করতে কে না ভালোবাসবে?
সারা দিন যানজট আর কর্মমুখর আমাদের শহুরে দিনগুলো। একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার অবসরও কারো নেই। তার ওপর কৃত্রিম আলোয় যেমন চোখ অতিষ্ঠ, তেমনি অতিষ্ঠ মনও। বাংলার গ্রামগুলোতে জ্যোৎস্না যে অপূর্ব সৌন্দর্য বিস্তার করে, তা দেখার ভাগ্য বৈদ্যুতিক আলোয় বসবাসকারী শহরবাসীর হয় না। চারদিকে জোনাকির ঝিলিমিলি আর রুপালি চাঁদের আলোয় গ্রামের মাঠে-ঘাটে এক মায়াপুরী সৃষ্টি হয় ভরা পূর্ণিমার রাতে। ঠিক এমনই একটি আমেজ পাওয়া যায় জাবির সেন্ট্রাল মাঠে। বিস্তৃত মাঠে চাঁদের জ্যোৎস্না যখন বন্যার ঢল নামায়, জ্যোৎস্নাপ্রিয় অসংখ্য তরুণ-তরুণী ভিড় জমায় এখানে। জ্যোৎস্নায় গা ভাসিয়ে কেউ বা সদলবলে গান ধরে গিটার হাতে, আবার কেউ নিশ্চুপ হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করে অপূর্ব মিষ্টি রুপালি আলো। সারা দিনের ক্লান্তি নিমেষেই উধাও হয়ে যায়, মনে আসে এক অনাবিল প্রশান্তি। কেবল মাঠেই নয়, লেকের পাড়েও জ্যোৎস্না বিস্তার করে মোহনীয় ইন্দ্রজাল। লেকের পানিতে চাঁদ আর জ্যোৎস্নার খেলা মুগ্ধ করে সৌন্দর্যপিপাসু শিক্ষার্থীদের মন, পদ্মের পাপড়িতে জ্যোৎস্নার ঝিলিমিলি অপূর্বতায় ভরে তোলে তাদের হৃদয়।
ঢাকা শহরের গাড়ির বিরক্তিকর শব্দ আর বায়ুদূষণ থেকে অনেকটাই মুক্ত জাবি ক্যাম্পাসটি। এখানকার শিক্ষার্থীদের কাছে যেমন ক্যাম্পাস প্রিয়, তেমনি এখানকার সৌন্দর্যও। প্রায় পাঁচ বছর এই ক্যাম্পাসে থেকে সেন্ট্রাল মাঠের জ্যোৎস্না যে উপভোগ করেনি, তাঁর জীবনই বৃথা। জ্যোৎস্নার অপূর্বতায় মুগ্ধ হয়েই লোককবি গেয়েছিলেন—
‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে /কদম তলায় কে?
হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে/সোনামুণির বিয়ে।’
বর্তমান যুগে কর্মের ক্লান্তি কেবল আমাদের শরীরকেই নয়, মনকেও ক্লান্ত করে তোলে। একটু শান্তির খোঁজে খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মতোই ছটফট করি আমরা। অথচ আমাদের দেশটা যে এত বেশি সুন্দর, তা কখনো দেখেও দেখি না। রবিঠাকুর যথার্থই বলেছিলেন—
‘দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে, একটি শিশির বিন্দু।’
তবে জাবির শিক্ষার্থীরা এই সৌন্দর্য উপভোগে পিছপা হয় না কখনো। হাতের কছে অসামান্য সৌন্দর্যই তাদের মনের খোরাক জোগায়। মনকে ভরে তুলতে তাই তাদের কোনো পার্কে বা কৃত্রিম স্পটে যেতে হয় না। প্রতি পূর্ণিমায় যখন জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হয় পুরো দেশ, যখন জাবির মাঠের বিস্তৃত সবুজ ঘাসে জ্যোৎস্না ঢেলে দেয় মায়াময় স্নিগ্ধতা, তখন ঘাসের ওপরেই বসে তরুণ-তরুণীরা উপভোগ করে চাঁদের আলো। চলে জমজমাট আড্ডা আর গানের সুরে জ্যোৎস্নার সঙ্গে ভেসে যায় মনের ক্লান্তি। মাঠে বসে জ্যোৎস্না উপভোগের যে কী আনন্দ, তা এই স্থানে উপস্থিত না থাকলে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
যারা কর্মব্যস্ততার কারণে নিজেকে একটু সময় দিতে পারে না, অথচ একটু শান্তির জন্য সারা দিন উশখুশ করে, এক রাতের একটু জ্যোৎস্না-স্নান তাদের মনে নিবিড় প্রশান্তি এনে দিতে পারে। জাবির মাঠের অপূর্ব জ্যোৎস্না-স্নানের সুযোগ তাই কেউ সহজে হাতছাড়া করে না। বর্ষার মেঘ কেটে ভেসে ওঠা চাঁদের জ্যোৎস্নায় যেমন সবাই পুলকিত হয়, তেমনি ফাল্গুনের মাতাল হাওয়ার সঙ্গে জ্যোৎস্না-স্নান করতেও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাসবাসী। জাবির প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্য, অসাধারণ সবুজ প্রকৃতি, গাছপালা, লেকের সমারোহ, শাপলা আর পদ্মের মনোমুগ্ধকর শোভার সঙ্গে পূর্ণিমার অপূর্ব জ্যোৎস্না যুক্ত হয়ে জাবি ক্যাম্পাসকে করে তোলে আরো আকর্ষণীয়! জাবি হয়ে ওঠে এক স্বপ্নের মায়াপুরী!