কম খরচে দক্ষ স্নাতকের র্যাংকিং হলে ঢাবিই শীর্ষে থাকবে
ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর জন্ম ১৯৫৩ সালে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে। তিনি ১৯৬৩ সালে সিরাজগঞ্জের বিএল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, ১৯৬৯ সালে খুলনার মহসীন বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৭১ সালে খুলনার সরকারি বিএল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৭৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে ভারতের মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফিলিপাইনের ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি।
ড. আরেফিন সিদ্দিক ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে সহকারী অধ্যাপক, ১৯৯০ সালে সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। এ ছাড়া অতিথি অধ্যাপক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৯ সালে ঢাবির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম কারিকুলাম উন্নয়ন কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) পরিচালনা বোর্ডের সদস্য, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) চেয়ারম্যান, ঢাবি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন (ভারপ্রাপ্ত), ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ড. আরেফিন সিদ্দিকের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘পোর্ট্রায়াল অব ভায়োলেন্স ইন মাস মিডিয়া’ (অধ্যাপক কিউ এ আই এম নুরউদ্দিনসহ), ‘হোয়াটস নিউজ’, ‘গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’, ‘জাতির জনক’ (সম্পাদনা), ‘এই দেশ এই মাটি’ (সম্পাদনা)। এ ছাড়া তাঁর প্রকাশিত বেশ কিছু গ্রন্থ এবং ২০টির বেশি গবেষণা-প্রবন্ধ বিভিন্ন স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর সাদামাটা জীবনযাপন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালনকালের নানা ঘটনা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের প্রধান ফকরউদ্দীন জুয়েল
এনটিভি অনলাইন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি ৯৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে। ২০২১ সালে ১০০ বছর উদযাপন করবে। প্রায় শত বছর বয়সী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আপনার কি মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম সঠিক পথে এগোচ্ছে?
ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : গত ১ জুলাই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন করেছি। প্রতিবছরই আমরা এই তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাউন্ডেশন ডে পালন করি, কারণ ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ জে হার্টজের হাত ধরেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যদিও ফিলিপ জে হার্টজ ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকায় এসে উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী সাত মাস বিশ্ববিদ্যালয় চালুর প্রস্তুতি নেন, শিক্ষক নিয়োগ দেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবিধান প্রণয়ন করেন। এরপর ১ জুলাই ১৯২১ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। আর কিছুদিন পরই আমরা শতবর্ষে উপনীত হব। যে আদর্শ, উদ্দেশ্য, ভাবমূর্তি নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় শত বছর পূর্বে যাত্রা শুরু করেছিল, সেটা এখনো অব্যাহত আছে। সেই দৃঢ় প্রত্যয় ও সংকল্প নিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে চলেছি এতে কোনো সন্দেহ নেই।
শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ঢাকা জেলা প্রশাসক বিজয় দিবস পদক প্রদান করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। ছবি : আনোয়ার মজুমদার
এনটিভি অনলাইন : বাংলাদেশের দুঃসময়ে, দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন সেই নেতৃত্বের জায়গায় আছে বলে মনে করেন কি?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সব সময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত রাজপথে তাঁর বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন কেন? কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা সব সময়ই অনুভব করেছেন, দেশের মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ করা তাঁদের দায়িত্ব। আর তখন তো ছিল ঔপনিবেশিক শাসন। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালির ওপর যে নিপীড়ন-নির্যাতন চলেছে, আমাদের ভাষার ওপর যে আঘাত এসেছে, পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝে যে বৈষম্য চলেছে, তার বিরুদ্ধে সব সময়ই সচেতন ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরো একটি কথা মনে রাখতে হবে, ১৯২১ সাল থেকে পঞ্চাশের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগপর্যন্ত এই ভূখণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক ক্ষেত্রেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হয়েছে এবং সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। আমাদের আজকের প্রজন্মের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা সেটা পালন করে চলেছেন। আমরা দেখেছি, এক-এগারোর পরে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কারাগারে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল। সেই সময়েও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই তাঁদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। কেউ কেউ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, জেল খেটেছেন। কিন্তু তার পরেও তাঁরা গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে এনেছেন। এই যে জাতির দুর্যোগে তাঁরা দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়, সেটার প্রশংসা করতেই হবে।
এনটিভি অনলাইন : প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয় সারা বিশ্বেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখে চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও খুব শিগগির শতবর্ষ অতিক্রম করতে যাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে অভিহিত করার পেছনেও কারণ আছে। আমাদের প্রথম উপাচার্য ফিলিপ জে হার্টজ দায়িত্ব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মৌলিক বিধিবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণ করেছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউটোরিয়াল পদ্ধতি চালু ছিল, তিনি এখানেও সেটা প্রচলন করলেন। টিউটোরিয়াল পদ্ধতিতে একজন শিক্ষক অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়ে ঘনিষ্ঠ পরিবেশে শিক্ষাদান করেন, পাঠ্যক্রমের বাইরেও শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত বিষয়, প্রাতিষ্ঠানিক নানা বিষয়, পেশাগত উৎকর্ষের বিষয়, এমনকি শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়েও আলোচনা করতেন। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠত। যদিও এখন সময়ের ব্যবধানে সেমিস্টার পদ্ধতির কারণে আমরা অনেক বিভাগেই টিউটোরিয়াল ব্যবস্থা চালু রাখতে পারছি না। তবে টিউটোরিয়াল পদ্ধতির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে চমৎকার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সেটার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
আমরা এখন শতবর্ষের পথে আছি। ছাত্রছাত্রীদের আমরা বিশ্বমানের গ্র্যাজুয়েট হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে গ্র্যাজুয়েট বেরিয়ে যাবে, সে শুধু বাংলাদেশে তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করবে, এটি আমরা আশা করি না। সে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় আরো উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেটিই আমরা চাই। এমন একটা বৈশ্বিক চিন্তা করে আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে গ্র্যাজুয়েট তৈরি করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সালে এক বিশেষ সমাবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আচার্য মো. জিল্লুর রহমান জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুনকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করেন। ছবি : আনোয়ার মজুমদার
এনটিভি অনলাইন : উদ্ভাবনে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে পড়ছে? এ বিষয়ে আপনি কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : এ বছর আমাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রতিপাদ্য ‘উদ্ভাবন ও উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা’। আমরা প্রতিবছরই একটা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকি। একে কেন্দ্র করে সে বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। আসলে উদ্ভাবন ছাড়া তো উন্নয়ন সম্ভব নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু উদ্ভাবনের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে সারা দেশে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। একে আরো গতিশীল করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে, সে জন্যই আমাদের এ প্রতিপাদ্য। শুধু তাই নয়, উন্নয়নের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব যেন সমাজে না পড়ে, সেটা নিয়েও চিন্তাভাবনা করতে হবে। উদ্ভাবনের ওপর গুরুত্ব দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইনোভেশন অ্যান্ড এন্টারপ্রেনারশিপ ল্যাব ( ডিইউ আইই- ল্যাব)’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা একাডেমিক লেখাপড়ার পাশাপাশি যাতে সৃজনশীল চিন্তা করতে পারে এবং কোনো একটি প্ল্যাটফর্মে সেটাকে প্রকাশ করতে পারে, সে জন্যই এই ল্যাব প্রতিষ্ঠা। একজন কলা অনুষদের শিক্ষার্থী হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাওয়া-আসার পথে যানজট নিরসন নিয়ে নতুন কোনো উদ্ভাবনী চিন্তা করতে পারে। সেই সৃজনশীল চিন্তা ভাবনা প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হলো ডিইউ আইই- ল্যাব।
এনটিভি অনলাইন : একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় ফুটে ওঠে তার গবেষণা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান দুর্বল?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : গবেষণার কথা উঠলেই পত্রপত্রিকায় বেশির ভাগ সময় গবেষণা খাতের বরাদ্দকে বড় করে প্রকাশ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে বরাদ্দ যেহেতু তুলনামূলকভাবে কম থাকে, সে কারণে গবেষণায় আমরা পিছিয়ে আছি বলে মনে করা হয়। এটা আসলে একধরনের সরলীকরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে গবেষণা খাতে আমরা যে বরাদ্দটা দেখাই, সেটা আসলে রাজস্ব বাজেটে গবেষণা বরাদ্দ। অন্যদিকে সরকারের কাছ থেকে উন্নয়ন বাজেটে আমরা গবেষণা খাতে আরো অনেক বেশি বরাদ্দ পেয়ে থাকি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা, জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থাগুলো থেকে আমরা প্রচুর অর্থ অনুদান পেয়ে থাকি। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষক, গবেষকরা তাঁদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে গবেষণার অনুদান পান। সব মিলিয়ে এই খাতের বরাদ্দ একেবারে অপর্যাপ্ত বলা যাবে না। আমাদের মেধাবী শিক্ষক-গবেষকরা অনেক ধরনের গবেষণাকাজে যুক্ত আছেন। আমাদের থিসিস কোর্সের শিক্ষার্থীরাও গবেষণা করে চলেছে এবং তাদের সেই গবেষণার ফল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে।
আমাদের গবেষণা নিয়ে সরলীকরণ মতামতের আরেকটি প্রধান কারণ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানবিষয়ক বা বিশেষায়িত গবেষণাগুলো যখন আমরা বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ করি, সেগুলোর ওপর ওয়ার্কশপ করি, তখন সেখানে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি কম থাকে। সে কারণেই গণমাধ্যমে এই গবেষণা কার্যক্রমের খবর খুব বেশি প্রতিফলিত হয় না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে সাংবাদিকতার মূল যে কাজ বলা যায়, ডিজরাপশন অব স্ট্যাটাসকো, অর্থাৎ কোনো স্থিতিশীল পরিবেশ নষ্ট হলে সেটাই বেশি সংবাদমূল্য বহন করে। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি কোনো সংঘর্ষ হয়, কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়, সেটা যেভাবে ফলাও করে প্রকাশিত হয়, সেভাবে বিজ্ঞান গবেষণার ফল প্রকাশিত হয় না। এর পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞান প্রতিবেদন প্রস্তুত করার মতো যোগ্য সাংবাদিকের সংখ্যাও হয়তো কমে গিয়ে থাকতে পারে। আবার আমরাও হয়তো বিজ্ঞান প্রতিবেদকদের জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার, ওয়ার্কশপ করানো দরকার, সেটাও সব সময় করাতে পারি না। নানা কারণে এ জায়গায় কিন্তু একটা ঘাটতি রয়েই গেছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে প্রদানের জন্য রচিত মানপত্র এবং উপহারসামগ্রী ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করেন উপাচার্য। ছবি : আনোয়ার মজুমদার
এনটিভি অনলাইন : বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান পেছনের সারিতে। আমরা কেন র্যাংকিংয়ে তলানিতে থাকছি?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : প্রচলিত র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে আছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে র্যাংকিং বিষয়টাই একটা বাণিজ্যিক কার্যক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অনেক সময় আমরা এই র্যাংকিংয়ের সার্বিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি না। এর জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে যে ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়া প্রয়োজন, যে ধরনের অংশগ্রহণ দরকার—সেগুলো আমরা সব সময় করতে পারি না। তবে সম্প্রতি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারা যদি সরাসরি আমাদের কাছ থেকে ডেটা বা তথ্য সংগ্রহ করে, তাহলে আমাদের র্যাংকিং অনেক ওপরে উঠে যাবে। আমরা জানতে পেরেছি, অনেক সময় ইন্টারনেটে তারা আমাদের সব তথ্য খুঁজে পায় না। তারা ইন্টারনেটভিত্তিক র্যাংকিং করে বলে আমরা অনেকটা পিছিয়ে থাকি। আমাদের শিক্ষকবৃন্দও অনেকটা আত্মপ্রচারবিমুখ। তাঁরা ভাবেন, আমরা গবেষণা করছি, গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি, একাডেমিক ইন্টারেস্টে গবেষণা করছি। এগুলো ওয়েবসাইটে দেওয়ার বিষয়টি তাঁরা অনেক সময় ভাবেননি বা করেননি। কিন্তু তাঁরা যদি এ গবেষণা প্রতিবেদনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দিয়ে দেন, তাহলে র্যাংকিংয়ে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যাব—এটা নিশ্চিত। তাই এখন আমরা চেষ্টা করছি, গবেষকদের সঙ্গে আরো বেশি যোগাযোগের মাধ্যমে এগুলোকে ওয়েবসাইটে নিয়ে আসার।
আরেকটি কথা, প্রচলিত র্যাংকিংয়ে হয়তো আমরা পিছিয়ে আছি, তবে যদি একটা রিভার্স র্যাংকিং করা হয় যে কত কম অর্থায়নে কত দক্ষ স্নাতক তৈরি করা হচ্ছে, সেই র্যাংকিংয়ে কিন্তু বিশ্বে আমরাই শীর্ষে থাকব। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বাজেট বরাদ্দ, তা অনেক কম, বিশ্বের অনেক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় কিছুই না। তাই এটাও একটা আনন্দের সংবাদ যে এত অল্প খরচে আমরা গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি। এই গ্র্যাজুয়েটরাই কিন্তু বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান, সেখানে সুনামের সঙ্গে আরো উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছে, কৃতকার্য হয়ে সুনামের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে, কেউ কেউ সেখানে শিক্ষকতায়ও যুক্ত হচ্ছে। তাহলে কী দাঁড়াল? হার্ভার্ড, প্রিন্সটন কিংবা অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েটের সঙ্গে আমাদের গ্র্যাজুয়েটদের তুলনামূলক সমীক্ষা করা হলে আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা পিছিয়ে থাকবে না। সেদিক থেকে আমি আশাবাদী, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কার্যক্রম, গবেষণা কার্যক্রম, আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যে মেধা, তা বিশ্বের অন্য নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
এনটিভি অনলাইন : আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণ-মান এবং সার্বিক শিক্ষাক্ষেত্রে আপনার কোন কোন উদ্যোগ আপনাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে বলে মনে করেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে আমি দায়িত্ব পালন করে চলেছি। আমার দায়িত্ব পালনকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের কতটা উন্নতি, কতটা সমৃদ্ধির দিকে গিয়েছে, সেটার মূল্যায়ন আমি আমার সহকর্মী, শিক্ষার্থী সর্বোপরি দেশবাসীর ওপর ছেড়ে দিতে চাই। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমি চাই সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধিত হোক। আমাদের দেশের, দেশের মানুষের উন্নয়নে আমাদের স্নাতকরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করুক। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের যেটা মূল লক্ষ্য যে একজন পরিপূর্ণ মানুষ গড়ে তোলা, সেই কাজটিই যেন আমরা করতে পারি, সে লক্ষ্যেই আমরা এগিয়ে যেতে চাই।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ২০১৩ সালে ইউপিএলের কনটেম্পরাইজিং ট্যাগোর অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড বইটির প্রথম কপি নয়াদিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির হাতে তুলে দেন উপাচার্য।
এনটিভি অনলাইন : দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে অস্থিরতা, সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এ বিশ্ববিদ্যালয় সাড়ে আট বছর ধরে একেবারেই শান্ত ছিল, ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়নি। সেশনজট নেই বললেই চলে। আপনি কীভাবে এটা সম্ভব করলেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : সেশনজট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় ধরনের দুর্বলতা ছিল। একসময় আমাদের স্নাতকরা চার বছরের কোর্স প্রায় সাত বছরে সম্পন্ন করেছে। মাস্টার ডিগ্রি শেষ করতে আট বছরের মতো লেগে যেত। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর ভেবেছি, আমাদের এই ছাত্রছাত্রী, যাদের অধিকাংশই অত্যন্ত অসচ্ছল পরিবার থেকে আসে, যাদের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে একেকটি দিন যাপন করাই কষ্টকর। অনেকেই প্রাইভেট টিউশন বা অন্যান্য কাজের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার আর্থিক খরচ বহন করে। সেই উপার্জন থেকে কেউ কেউ পরিবারকেও টাকা পাঠায়। আমি ভেবেছি, তাদের যদি আমরা দ্রুত লেখাপড়া শেষ করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করতে পারি, তাহলে তাদের ওপর থেকে অনেক চাপ কমে যায়, প্রজাতন্ত্রের কাজেও তারা অনেক বেশি সময় দিতে পারে। কিন্তু তারা যদি এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ১০ বছরের মতো সময় নষ্ট করে ফেলে, তাহলে প্রজাতন্ত্রের বা অন্যান্য চাকরিতে গিয়ে তারা কম সময় দিতে পারবে।
সেশনজট কমাতে আমাদের শিক্ষকবৃন্দ, সহকর্মী, সর্বোপরি শিক্ষার্থীরা সার্বিক সহযোগিতা করেছে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো নিয়েছি, তখন সারা শহরে আন্দোলন চলছিল, বাসে অগ্নিসংযোগ, বোমাবর্ষণ করা হচ্ছিল। হরতাল-অবরোধের মধ্যে শিক্ষার্থীরা যে বাসে করে ক্যাম্পাসে আসবে, তারও কোনো উপায় ছিল না। সেখানেও আমাদের শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছে। তারা আমাকে বলেছে, স্যার, আমরা পরীক্ষা দেব। পরের দিন হরতাল-অবরোধ থাকলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এনে তাদের থাকার বন্দোবস্ত করেছি। আমাদের পরীক্ষা কার্যক্রমকে আমরা ব্যাহত হতে দিইনি। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার কারণে, বিশেষ করে পরীক্ষার ব্যাপারে আমাদের অনমনীয় মনোভাবের কারণে সেশনজট আমরা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে পেরেছি।
এনটিভি অনলাইন : দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনি কোটি টাকার বেশি ভাতা নেননি, বিশ্ববিদ্যালয়কেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। কোন চিন্তাভাবনা থেকে আপনি এ সিদ্ধান্ত নিলেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা অনেক কিছু নিয়েছি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা প্রায় বিনা পয়সায় লেখাপড়া করেছি। এখন আবার আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছি, এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন-ভাতা নিয়ে, পরিবারের সঙ্গে আমরা জীবনযাপন করছি। আমি মনে করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের মাতৃসম প্রতিষ্ঠান। মা-কে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা সব সময় নিয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়কেও তো কিছু দেওয়া উচিত। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দায়িত্ব পালনের জন্য অতিরিক্ত কোনো ভাতা, যেটা সিটিং অ্যালাউন্স হিসেবে দেওয়া হয়, সেটা না নেওয়ার।
এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। গত সাড়ে আট বছরে আমি এটা প্রচার বা প্রকাশ করতে দিইনি। একেবারেই গোপন রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ বছর বাজেট অধিবেশনে আমাদের কোষাধ্যক্ষ তাঁর বাজেট বক্তৃতায় এটা বলে ফেলেছেন। আমি এ বিষয়ে আর বেশি কিছু বলতে চাই না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সালে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে সম্মাননা জানান উপাচার্য। ছবি : আনোয়ার মজুমদার
এনটিভি অনলাইন : বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে থেকেও আপনি নিয়মিত ক্লাস নেন। এমনটি তো সাধারণত দেখা যায় না। কোন চিন্তা থেকে আপনি ক্লাস নেওয়া অব্যাহত রেখেছেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : উপাচার্য হিসেবে ক্লাস নেওয়াটা সময়ের দিক থেকে মাঝেমধ্যে একটু সমস্যা হয়ে যায়। আমার ছাত্রছাত্রীরাও বুঝতে পারে যে অনেক ব্যস্ততার মাঝে আমাকে ক্লাস নিতে হয়। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবেও আমার যে দায়িত্ব, সেটা ধরে রাখতে হবে। সে কারণে আমার বিভাগ, অর্থাৎ গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের যোগাযোগ নীতি কোর্সটি আমি নিয়মিতভাবে নেওয়ার চেষ্টা করি। এতে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও একটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়। তাদের বোঝার জন্য আমার এই ক্লাসটা নিতে হয়। বিভাগে যেহেতু সব সময়ই আমি এই কোর্স নিয়েছি, তাই এখনো এটা নেওয়ার চেষ্টা করি।
এনটিভি অনলাইন : বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কথা চালু আছে, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের মানুষ আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারে। এ জন্য কারো কোনো অনুমতিও নিতে হয় না। কোন ভাবনা থেকে আপনি সবাইকে এ সুযোগ দেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : আমার ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের জন্য এই সময় দিই। নানাজনের নানা সমস্যা থাকে। অফিসের কর্মঘণ্টায় ফাইলপত্র দেখে, অফিসের অন্যান্য কাজকর্ম করতে গিয়ে অনেক সময় সহকর্মী বা শিক্ষকদের জন্য আলাদা সময় বের করা সম্ভব হয় না। সে জন্য সন্ধ্যার পরও আমি আমার আবাসিক অফিসে বসি। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের নানা সমস্যা থাকে। এটা শুধু একাডেমিক বা বিদ্যায়তনিক সমস্যা নয়। কখনো কখনো আর্থিকসহ অন্যান্য অনেক সমস্যা থাকে। আমি যদি তাদের কথাগুলো শুনি এবং তাদের পরামর্শ দিই, তাহলে সেটাই তাদের জন্য বড় পাওনা হয়। সে কারণেই আমি এ পন্থা অবলম্বন করি। আমার সঙ্গে কারো দেখা করতে পূর্বনির্ধারিত অ্যাপয়েন্টমেন্টের দরকার হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কেউ দরজা খুলে আমার রুমে প্রবেশ করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে আমি এই উন্মুক্ত নীতি অনুসরণ করেছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ক্রেস্ট উপহার দেন উপাচার্য। ছবি : আনোয়ার মজুমদার
এনটিভি অনলাইন : বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের আবাসন সংকট প্রকট। পরিবহন সংকটও বেশ। এ ব্যাপারে আপনার উদ্যোগ কী?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট, পরিবহন সংকটসহ বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে স্থান বা স্পেসের সংকট আরো প্রবল। আমাদের বহু বিভাগ আছে, যাদের যথেষ্ট পরিসরে জায়গা আমরা দিতে পারি না। আমাদের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে, সে তুলনায় হলের সংখ্যা কম। শিক্ষকের সংখ্যা বেড়ে গেছে, তাদের আবাসিক ভবনের সংখ্যা কম। এ সমস্যা নিয়েই আমি দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। তবে আশার কথা, গত সাড়ে আট বছরে আমরা এই সংকট অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। বেশ কয়েকটি হল নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যমান হলগুলোতে অতিরিক্ত তলা নির্মাণ করে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। শিক্ষকদের আবাসিক সংকট অনেকটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সংকটও দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে।
আমি এখানে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ দিয়েছেন। কয়েক মাস আগেই তিনি একসঙ্গে আমাদের ৬২০ কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ দিয়েছেন। একসঙ্গে ৬২০ কোটি টাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে এককালীন সর্বোচ্চ বরাদ্দ। এর প্রথম পর্যায়ের টাকা আমরা এরই মধ্যে পেয়ে গেছি, কাজকর্মও শুরু হয়েছে। উন্নয়ন বাজেটের এই প্রকল্পগুলো শেষ করা গেলে আবাসিক সংকট এবং অন্যান্য সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আশাবাদী।
এনটিভি অনলাইন : গণমাধ্যমে খবর এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে অনেক ভিড়। সেখানে অধিকাংশই নিচ্ছেন বিসিএসের প্রস্তুতি। শুধু সরকারি চাকরি পাওয়াই কি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য? বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের এই সমস্যা আমরা প্রতিদিনই মোকাবিলা করি। এই গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্য। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩৫ হাজারের বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের হাজার হাজার প্রাক্তন শিক্ষার্থী, যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। তারা এখন বিসিএসের পরীক্ষা দেবে, ব্যাংকিংয়ের পরীক্ষা দেবে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও অনেক সময় থাকে। অথবা হয়তো তারা ঢাকা শহরের কোথাও থাকলেও পড়াশোনার প্রস্তুতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারে চলে আসে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে নিয়মিত ছাত্রদের সঙ্গে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের যে চাপটা পড়ে, সেটা ধারণ করা সম্ভব হয় না। এখানেই হয়ে গেছে সমস্যা। আমাদের যে ছাত্রছাত্রী, তাদের জন্য একটা সুপরিসর, সুউচ্চ ভবন দরকার—যেটাকে গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আমরা সেটা নিয়েও চিন্তাভাবনা করছি।
প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আমি বলব, আমাদের হলের পাঠাগারগুলো সকাল থেকে খালি থাকে। কারণ, ছাত্রছাত্রীরা তখন ক্লাসে বা লাইব্রেরিতে চলে যায়। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের যদি পড়ালেখার কোনো জায়গা না থাকে, তাহলে তারা ক্যাম্পাসে এসে হলের পাঠাগারগুলো ব্যবহার করতে পারে। এতে লাইব্রেরির ওপর চাপ কমে যাবে। লাইব্রেরির টেক্সট বইগুলো পড়ার জন্য নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সুযোগ দিতে হবে। আমি কয়েকবার গ্রন্থাগারে আকস্মিক ভিজিটে গিয়ে দেখেছি, সেখানে নবম-দশম-একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বই, গাইড বই নিয়ে পড়ছে। তো, এই গাইড বই বা এসএসসি-এইচএসসি স্ট্যান্ডার্ডের বই নিয়ে তো গ্রন্থাগারে পড়ার দরকার নেই। এ জন্য পাবলিক লাইব্রেরি বা অন্যান্য লাইব্রেরি আছে। সে জন্য বর্তমানে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ দেওয়াটা জরুরি।
আর সরকারি চাকরি পাওয়াটাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য নয়। তাদের সুশিক্ষিত করা, ভালো মানুষ, সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে গিয়ে কেউ সরকারি চাকরি করবে, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, কেউ রাজনীতি করবে, কেউ বিদেশে চলে যাবে, এই স্বাধীনতা তো সবারই আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জননিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ড. সারাহ সেওয়ালকে ক্রেস্ট তুলে দেন উপাচার্য। ছবি : আনোয়ার মজুমদার
এনটিভি অনলাইন : ডাকসু নির্বাচন হয় না ১৯৯০ সালের পর থেকে। কেন এমনটি হলো? আপনি কি কোনো উদ্যোগ দিয়েছেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আমরা সব সময়ই কথা বলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বহু বছর ধরে, প্রায় ২৭-২৮ বছর ধরে নিষ্ক্রিয়। এগুলো পেছনের কারণ আমরা সবাই জানি। এই ডাকসু নির্বাচন করতে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদের মধ্যে, একই সংগঠনের ছাত্রদের মধ্যে খুনোখুনি পর্যন্ত হয়েছে। সেই সময় এটা বন্ধ হয়ে যায়। আমার আগেও বহু উপাচার্য এই নির্বাচনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁরা সেটি আর করতে পারেননি। আমরা চেষ্টা করব, ডাকসু নির্বাচন যাতে আবার করা যায়। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন করতে গেলে যে একটা স্থিতিশীল, সহায়ক পরিবেশ দরকার, সেটি করা বেশি প্রয়োজন। যেমন আজকে ছাত্রসংগঠনগুলোর অধিকাংশই অছাত্র, প্রাক্তন ছাত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নিয়মিত ছাত্ররা যদি ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দেয়, তাহলে আমার মনে হয় ডাকসু নির্বাচনসহ বিভিন্ন সংগঠন, ছাত্রছাত্রীকেন্দ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করাটা সহজ হয়। ডাকসু নির্বাচনে প্রথম শর্তই হবে সব ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থান। এখানে নিয়মিত ছাত্ররা সহাবস্থান করতে পারবে। কিন্তু নিয়মিত ছাত্রদের সঙ্গে যদি ছাত্রত্ব নেই এমন নেতৃবৃন্দের সহাবস্থানের প্রশ্ন আসে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আরো একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
কিছু কিছু ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব ছাত্রদের মধ্যে এসেছে। আমরা এর প্রশংসা করি। আমরা আশা করব, আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁদের স্ব-স্ব ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব নিয়মিত ছাত্রদের হাতে তুলে দেবেন। নিয়মিত ছাত্ররা একবার নেতৃত্বে চলে এলে ডাকসু কেন, অন্য সব ছাত্রছাত্রীকেন্দ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজ হবে। ছাত্ররা ক্লাসে যাবে, পরীক্ষা দেবে, ক্লাসের ফাঁকে বেরিয়ে এসে আন্দোলন করবে, ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব দেবে—এটাই আমরা দেখতে চাই।
এনটিভি অনলাইন : একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনিয়মিত ছিল। এখন কি সমাবর্তন নিয়মিত হচ্ছে?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন আমরা নিয়মিত করছি। একজন ছাত্রছাত্রীর জীবনে সমাবর্তন একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত। চার-পাঁচ বছর লেখাপড়া করে যখন তারা বের হয়ে যায়, তখন তাদের আমরা সমাবর্তনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্টিফিকেট হাতে তুলে দিই। সমাবর্তন বক্তা যখন তাদের সামনে আসেন, তাদের সামনে কিছু পরামর্শমূলক বক্তব্য দেন, আমাদের আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি যখন এই সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করেন, সেটি একজন শিক্ষার্থীর জীবনে একটি সোনালি অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। এই সমাবর্তন একসময় একেবারেই অনিয়মিত ছিল। এটা যেন আমরা নিয়মিত করতে পারি, সে জন্য আমাদের সবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা দরকার। আমাদের সহকর্মীবৃন্দও এ ব্যাপারে আমাদের নিয়মিত সাহায্য-সহযোগিতা করেন। ছাত্রছাত্রীরাও এটা নিয়ে খুবই উৎসাহী। সমাবর্তনের দিন তো বটেই, এর আগের ও পরের কয়েকটা দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়।
এনটিভি অনলাইন : বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ভূমিকা থাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষাবিনিময় করার, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। এ ক্ষেত্রে আপনার কোনো উদ্যোগ আছে কি?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : গত সাড়ে আট বছরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভূমিকা, সেটাকে আরো অনেক জোরদার করেছি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে। তাদের সঙ্গে কার্যক্রম চলছে। গত আট বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বকে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি এবং তাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সামনে পাবলিক লেকচার দিয়েছেন। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শিক্ষার্থীরা বিশ্বনেতাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। আমার মনে হয়, এতে ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হয়েছে, বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ড. আরেফিন সিদ্দিক : এনটিভি অনলাইনকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।