আলোর পথে আলোর তরী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাফেটেরিয়া প্রাঙ্গণ, সবুজ কচি ঘাসের ওপর গোল হয়ে বসে আছে একদল কচিকাঁচা। তাদের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছে ‘এ’ ফর অ্যাপল, ‘বি’ ফর বল। অ-তে অজগর, অজগরটি আসছে তেড়ে। আ-তে আম, আম খেতে ভারি মজা। চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়ে অজগর হয়তো দেখানোর তাদের কেউ নেই। আপেল কিংবা আমের স্বাদ গ্রহণ করার ভাগ্য তাদের সচরাচর হয় না। তবু তাদের চোখে-মুখে পড়ালেখা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন। এরা সবাই ক্যাম্পাসের আশপাশের গ্রামের হতদরিদ্র রিকশাওয়ালা, শ্রমিক কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনাদরে-অবহেলায় বেড়ে ওঠা সন্তান। কারো বাবাও বেঁচে নেই। এদের অধিকাংশই আবার পথশিশু। ক্যাম্পাসে কেউ হয়তো বিক্রি করে বাদাম, কেউ বিক্রি করে চা-সিগারেট, কেউ বা কুড়ায় কাগজ-পানির বোতল ইত্যাদি। প্রাইভেট পড়িয়ে কিংবা কোচিং করিয়ে পড়ালেখা করানোর সাধ্য এদের মা-বাবাদের নেই। বাড়িতে পড়া দেখিয়ে দেওয়ারও তাদের কেউ নেই।
জীবন-জীবিকার সংগ্রামে যেখানে এদের জীবন এই কচি বয়সেই সংগ্রামমুখর, সেখানে তাদের পড়ালেখা করাই প্রায় স্বপ্ন। প্রাইভেট পড়া কিংবা কোচিং করা তো আকাশকুসুম। বলতে গেলে এই স্বপ্ন আর আকাশকুসুমকেই বাস্তবে রূপায়িত করেছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষায় নিয়োজিত জাবি শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন ‘তরী’। ২০০৮ সালে ‘আলার পথে আমরা’ স্লোগান নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সংগঠনটি। আলোর পথে তাদের পথচলা সাত বছরের। পথশিশুদের মধ্যে নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষার আলো বিলিয়ে যাচ্ছেন এ সংগঠনের আত্মত্যাগী সদস্যরা। ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত এখানে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ১২০ জন। প্রতি শনি, সোম ও মঙ্গলবার বিকেল বেলা এদের বিনামূল্যে পড়াচ্ছেন তরীর স্বেচ্ছাসেবী ২০-৩০ জন শিক্ষক। এখানে সময় না দিলে এ সময় দু-একটা টিউশনি করিয়ে মাসিক খরচের টাকাটা জোগাড় করে নেওয়া যেত সহজেই। কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে চলত জমজমাট আড্ডা। এসব কিছুকেই স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছেন তাঁরা। দায়িত্ব নিয়েছেন সেই শিশুদের পড়ালেখার, যাদের দায়িত্ব কেউ নেয় না।
তরীর পক্ষ থেকে শিশুদের খাতা-কলম ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা হয়। রীতিমতো পরীক্ষাও নেওয়া শিশুদের। যারা ভালো করে, তাদের জন্য থাকে পুরস্কারের ব্যবস্থা। পড়ালেখাকে আনন্দময় করার জন্য বিভিন্ন সময় আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলার। এসব আয়োজনেও রাখা হয় পুরস্কারের ব্যবস্থা। এ ছাড়া শিশুদের জন্য নাশতার ব্যবস্থা করারও চেষ্টা করা হয়। সব শিশুকে নিয়ে বছরে দুবার আয়োজন করা হয় পিকনিকের। এসবই আসে স্বেচ্ছাসেবীদের দেওয়া চাঁদার টাকা থেকে। এ ছাড়া ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় তিন কিস্তিতে ৪০ জনকে ছয় মাসে এক হাজার ২০০ টাকা করে বৃত্তি দিয়েছিল। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় তা বন্ধ হয়ে গেছে। আপাতত আর কোনো সংস্থা থেকে সাহায্য পাচ্ছে না তরী। কিন্তু বৃত্তি দেওয়া না গেলে অনেকেরই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করেন তরীর শিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক জাবি ইতিহাস বিভাগ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাকিব। ‘এ ধরনের সংগঠন চালানো কিছুটা কষ্টকরই বটে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতাটাই সবচেয়ে বড়। সবাই এসব উদ্যোগকে বাহবা দিলেও সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে আসে খুব কমই। তার পরও সব প্রতিকূলতা মাড়িয়ে আমরা চালিয়ে যাচ্ছি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলার সুরে বললেন সাকিব। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়িয়ে যে এক ধরনের প্রশান্তি বোধ হয়, তা তৃপ্তির সঙ্গে স্বীকার করলেন সাকিবসহ অন্য সদস্যরা। তরী হয়তো এগিয়ে যাবে এর সদস্যদের নিষ্ঠার কারণে। তবে এসব উদ্যোগকে প্রণোদনা দিতে সামর্থ্যবানদের অবশ্যই এগিয়ে আসা উচিত।
সাকিব মনে করেন, আমাদের দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাইলে অধিকাংশ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব। এসব শিশুকে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ এবং আগ্রহী করে তুলতে বৃত্তি প্রদান ও খাবার বিতরণ করার জন্য প্রয়োজন আর্থিক সহযোগিতা। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে সাহায্য নিয়ে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও থাকতে হবে ভালো কিছুর জন্য ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা।