ক্ষুধার রাজ্যে একজন আনু
টিউশনি নেই। ভাত কেনার টাকাও ছিল না। দোকানে পড়ে আছে অনেক টাকার বাকি। তাই বাকিতে খাবারও দিচ্ছিল না দোকানিরা।
কিন্তু ক্ষুধা তো পিছু ছাড়ে না। তাই, শুধু জীবন বাঁচাতে আম খেতে শুরু করেন। আম খেয়েই টানা দুই দিন পার করেন তিনি।
তাঁর নাম আনোয়ারুল ইসলাম আনু। তিনি সমাজের কোনো ছিন্নমূল মানুষ নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) পপুলেশন সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আনু। কিন্তু, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে কেন খেতে পান না আনু, কেনই বা চুরি করে আম খেতে হয়েছিল তাঁকে?
গাছ থেকে আম পাড়ার অপরাধে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার পর এসব প্রশ্নের হৃদয় বিদারক কথা জানান আনু।
কেন আম খেয়ে বাঁচতে হলো আনুকে?
আনু যখন ছোট তখন পারিবারিক কলহের জেরে তাঁর বাবা-মা আলাদা হয়ে যান। পরে তাঁর এক আত্মীয় তাঁকে লালন-পালন করেন। সেখানে অনেক সংগ্রাম করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে রাবিতে ভর্তি হন তিনি। বর্তমানে ওই পরিবারের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই। এমনকি যে আত্মীয়ার কাছে বড় হয়েছেন তিনিও কোনো খোঁজ-খবর রাখেন না।
এতদিন টিউশনি করেই পড়াশুনা চালিয়ে আসছিলেন আনু। কিন্তু এখন আর টিউশনি না থাকায় তাঁর কাছে কোনো টাকা নেই। বেশ কয়েকদিন তিনি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দোকানে বাকিতে খেয়েছেন। কিন্তু দোকানদাররা আর বাকিতে খাবার দিতে চাইছিলেন না। তাই ক্যাম্পাসের আম খেয়েই দুই দিন পার করেন তিনি।
‘আমার ক্যাম্পাসের আম, শিক্ষার্থী হিসেবে আমি খাওয়ার অধিকার রাখি না?'
গত ৩০ মে সন্ধ্যায় রাবি ক্যাম্পাসে একটি গাছের আম পাড়তে যান আনুসহ কয়েকজন। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তরের প্রশাসক ড. এফ এম আলী হায়দার এসে তাঁদের আম পাড়তে বারণ করেন। তখন সবাই চলে গেলেও যাননি আনু। তিনি ভেবেছিলেন, এই আমগুলো ঘরে রেখে দিলে, পরে পাকা আম খেয়ে দুই একদিন থাকতে পারবেন তিনি।
প্রশাসক বকাঝকা শুরু করলে আনু প্রশ্ন করেন, ‘আমার ক্যাম্পাসের আম, শিক্ষার্থী হিসেবে আমি খাওয়ার অধিকার রাখি না?'
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা ঘটনাস্থলে এসে আনুকে পুলিশে ধরিয়ে দেন। মতিহার থানার পুলিশ আনুকে থানায় নিয়ে আটকে রাখে।
খবর পেয়ে থানায় আনুকে ছাড়িয়ে আনতে যান রাবি কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি আব্দুল মজিদ অন্তর। তিনি অপেক্ষা করছিলেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) রুমে। ওসি আনুকে হাজির করে আম পাড়ার কারণ জানতে চান। তখন আনু পেটের ক্ষুধা মেটাতে আম পাড়ার কথা এবং জীবন সংগ্রামের কথা বলেন।
আনুর কথা শুনে মন গলে ওসির। রাতেই আনুকে ছেড়ে দেন তিনি।
এদিকে আনুকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা। তিনি বলেন, ‘আম পাড়ার কারণে কাউকে পুলিশে দেওয়া হয়নি। ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করায় তাঁকে আমি বোঝাচ্ছিলাম। এ সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র ও পুলিশ কর্মকর্তা এখানে আসেন এবং বিষয়টি দেখবেন বলে আমাকে চলে যেতে বলেন। পরে আমি সেখান থেকে চলে আসি। এরপর সেখানে কি হয়েছে তা আমি জানি না।’
তবে, আনু পুলিশকে জানান, ক্ষুধার কারণে তাঁর মাথা ঠিক ছিল না। তাই তিনি খারাপ আচরণ করছিলেন।
‘আনু মাদকাসক্ত’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত মতিহার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুব আলম বলেন, ‘আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ছেলেটি মাদকাসক্ত। সে শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে, তাই আমরা নিজেরাই তাকে থানায় নিয়ে আসি। পরে উপ-উপাচার্য স্যার ছেলেটিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কয়েকবার ফোনও করেছেন।’
এদিকে, আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি আব্দুল মজিদ অন্তর তাঁর ফেসবুক ওয়ালে একটি পোস্ট করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অনেকে এটাকে উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে অপ-প্রচার চালানো হচ্ছে বলেও দাবি করেন।
‘আমরা কার কাছে নিরাপদ থাকব?’
রাবি কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি আব্দুল মজিদ অন্তর এ ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এ আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আনন্দ স্যার নিজের দপ্তরে নিয়ে গিয়ে ছেলেটিকে বুঝাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে উল্টো পুলিশের কাছে তুলে দেন, যা খুবই অমানবিক। আমরা যাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক মনে করছি তারাই যদি আমাদের পরিস্থিতি বিবেচনা না করে ছোট একটি বিষয়ের জন্য পুলিশে দেন, তাহলে আমরা কার কাছে নিরাপদ থাকব?’
তাঁর এ বক্তব্য প্রসঙ্গে উপ-উপাচার্য বলেন, ‘কয়েকদিন আগে অন্তরের সঙ্গে আমার একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। এ কারণেই অন্তর আমার বিরুদ্ধে এভাবে গুজব ছড়াচ্ছে। আমি এগুলোর কিছু জানি না। অথচ আমাকে নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
থাকা খাওয়ার সহযোগিতার আশ্বাস
এদিকে আটকের ঘটনার পর আনুকে সাহায্য করার জন্যও অনেকে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলে বিনামূল্যে সারা বছর থাকাসহ ডাইনিংয়ে খাবারের ব্যবস্থা করে দেওয়া ও হলের তহবিল থেকে তাকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন ওই হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে আনুকে সহযোগিতা করারও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
জানতে চাইলে শাহ মখদুম হলের প্রাধ্যক্ষ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ছেলেটিকে দেখে খুবই অসহায় মনে হয়েছে। সে আমার কাছে তার আর্থিক সংকটের কথা বলেছে। আমি ইতোমধ্যে হলের আবাসিকতার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এবং হলে ফ্রিতে খাবারের ব্যবস্থাও করা হবে।